মমতার সঙ্গে একান্তে কথা! রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরছেন মুকুল রায়?
Mukul Roy: যে মুকুল তৃণমূলের জন্ম থেকে সংগঠন বাড়ানোর কাজে দক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই মুকুলই ২০১৭ এর পর দল ভাঙাতে সফল হয়েছেন।
২০১৭ সাল। সেপ্টেম্বর মাস। রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন আসতে মাত্র কয়েকমাস বাকি। বছর ফুরোলেই নির্বাচন। ঠিক সেই মুহূর্তেই সমস্ত জল্পনা-কল্পনা সত্যি করে তৃণমূল ছাড়লেন রাজ্যের রাজনৈতিক চাণক্য। মুকুল রায় যোগ দিলেন ভারতীয় জনতা দলে। 'ভাগ মুকুল ভাগ' বলা উত্তর প্রদেশের গেরুয়া নেতা সিদ্ধার্থদের ভাগিয়ে জাঁকিয়ে বসলেন মুকুল। দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বাধীন বঙ্গ-বিজেপির রাশ খানিকটা নিলেন নিজের হাতে। একাই একশো দেখিয়ে একে একে ঘর ভাঙতে শুরু করলেন পুরনো দল তৃণমূলের! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একদা বিশ্বস্ত সঙ্গীর গদ্দারিতে চাপে পড়ল সবুজ শিবির। অভিষেকময় তৃণমূলে বিরোধী-মুকুল ঠেকাতে আগমন ঘটল ভোট কুশলীর। এবার কে? মমতার এই আতঙ্কে দিন গুজরানে মুখ্য ভূমিকা নিলেন কাঁচরাপাড়ার রায়বাহাদুর।
তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়েছে অনেক জল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তিত হয়েছে পরিস্থিতি। মুকুল একদা বিরোধী অভিষেকের হাত ধরে ফিরেছেন ঘরে। ফের আপন করেছেন মমতাকে। কিন্তু সেই মুকুলকে আর পাওয়া যায়নি নতুন করে। পাবলিক অ্যাকাউন্টস্ কমিটির পদ, আদালতে মামলা, সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় মায়াজালে একপ্রকার অন্তর্ধানে গিয়েছেন মুকুল। বঙ্গের রাজনীতিতে প্রায় রায়হীন থেকেছেন তিনি। এবার সেই মুকুল নিয়েই ফের শুরু হয়েছে জল্পনা। একটি বৈঠকেই পারদ চড়ছে ফের। কারণ?
দেখা গিয়েছে দ্বাদশীর দিন কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘণ্টা খানেক বৈঠক করেছেন কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়ক মুকুল রায়। যে বৈঠক ২০১৭ সালের আগে হয়েছে একাধিকবার। অর্থাৎ দল ছাড়া, বিজেপি ছেড়ে আবার মমতার দলে ফেরার এক বছর পূর্ণ হলেও এমন একান্তে বৈঠকে বসেননি রাজ্যের দুই পোড়খাওয়া রাজনীতিক। তাহলে কেন এই বৈঠক? এই প্রশ্নেই শুরু হয়েছে একাধিক জল্পনা। তাহলে কি ফের নতুন উদ্যমে ফিরছেন মুকুল! অর্থাৎ রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হচ্ছেন বাংলার চাণক্য! সোডিয়াম-পটাশিয়ামের ভারসাম্য, মানসিক সমস্যা কাটিয়ে আবার মমতার ডানহাত হতেই কি এগিয়ে যাচ্ছেন প্রবীণ রাজনীতিক মুকুল রায়।
অনেকেই বলছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বিদেশে। ঠিক তাঁর অনুপস্থিতির মধ্যেই এই বৈঠক জল্পনা বাড়িয়েছে বেশি। মুকুল রায় আবার সক্রিয় হতে চলেছেন, এই আবহ তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, মুকুলের তৃণমূল ছাড়ার পিছনে শুধু সারদা, নারদা দুর্নীতিকাণ্ড বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাত থেকে বাঁচার যে অভিযোগ ছিল, তাই-ই নয়, সামগ্রিকভাবে মমতার দলে একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসানের আঁচ ছিল বেশি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় 'কাঁটা মুকুল'কে দলত্যাগে উৎসাহিত করেন বলেই দাবি অনেকের।
যদিও সেই প্রেক্ষাপট ছাড়িয়ে আজ মুকুল আবার দিদির ঘরে। প্রায় এক বছর নানা জল্পনা আর নিষ্ক্রিয় থাকার পর আবার তিনি চর্চায়। এই প্রসঙ্গে কী বলছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
আরও পড়ুন- পান থেকে চুন খসলে ইলেকট্রিক শক! বিদেশে চাকরির নামে যেভাবে নয়া দাসত্বের শিকার ভারতীয়রা
রাজ্যের প্রবীণ রাজনীতিক তথা তৃণমূল বিধায়ক, নেতা তাপস রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ইনস্ক্রিপ্ট। যদিও মুকুল প্রসঙ্গ উঠতেই তাঁর জবাব, ''আমি ওঁর বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আমি তো জানতাম ওঁ অসুস্থ। এসব নিয়ে নেতৃত্ব বলতে পারবেন। আমি নই।''
নৈহাটির বিধায়ক, রাজ্যের বর্তমান সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক আর মুকুল রায়ের সম্পর্ক নিয়ে ২০১৭ সালের আগে-পরে কম আলোচনা হয়নি। তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করি আমরা। তিনি ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, ''কী বৈঠক হয়েছে আর কী হবে, মুকুলদা বলতে পারেন। একমাত্র তিনিই জানেন। আমি কিছু বলতে পারব না এই প্রসঙ্গে।'' যদিও পার্থ ভৌমিক মুকুল রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন, এই খবর প্রকাশ্যে আসে সম্প্রতি। তাহলে কি নতুন কোনও ইঙ্গিত। এই প্রসঙ্গে তিনি জানান, ''আমি বিজয়া দশমীর প্রণাম-শুভেচ্ছা জানাতে জেলার একাধিক প্রবীণ নেতার সঙ্গে দেখা করেছি, মুকুলদার সঙ্গেও সেই সূত্রেই। সেটা ওই বৈঠকের আগে।''
মুকুলের সক্রিয় হওয়ার খবরে কী বলছেন তৃণমূল বিরোধীরা। সিপিআইএম নেতা শমীক লাহিড়ী ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, "আমরা ওঁর (মুকুল রায়) সম্পর্কে একটুও আগ্রহী নই। চোরেরা কখন কী করছেন, এই বিষয়ে বলে বা জেনে আমাদের কোনও লাভ নেই!'' প্রায় একই মত রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের। ইনস্ক্রিপ্টকে তিনি জানান, ''ওঁর (মুকুল রায়) প্রসঙ্গ নিয়ে ভালো বলতে পারবেন বিধানসভার অধ্যক্ষ। তাঁকে জানতে চান, বলে দেবেন হয়তো। ওঁর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমাদের।''
তৃণমূলের নেতারা, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রকাশ্যে মুকুল প্রসঙ্গে বলতে আগ্রহী না হলেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার খবরে, রাজনীতিতে ঠিক কী আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনীতিক কারবারিদের একাংশের মতে; মুকুল রায় ২০১৬ পূর্ববর্তী সময়ে মমতার দলের সংগঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করতেন। এমনকী জেলায়, জেলায় মুকুলের প্রভাব ছিল মমতার পরেই। অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি বা সরকারের মন্ত্রী না হয়েও শুধুমাত্র দলীয় ক্ষেত্রে সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায় তুলনায় মুকুলের প্রভাব ছিল বেশি। উত্তর ২৪ পরগনা নয়, মুকুল-নিয়ন্ত্রণে ছিল উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলাও। যে প্রেক্ষাপটে সংগঠন বাড়াতে, সিপিআইএম, কংগ্রেস ভেঙে নিজেদের দল ভারী করতেও মুকুলের সক্রিয় ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো!
দাবি, অনেকাংশেই সুবক্তা না হলেও দলের নির্বাচনে জয়লাভ, বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টায় মুকুল ছিলেন নেপথ্য নায়ক। অর্থাৎ মমতার মুখ আর মুকুলের কৌশলেই চলছিল তৃণমূল। এই একচ্ছত্র আধিপত্যের বিস্তার খুব একটা ভালো চোখে নেয়নি তৎকালীন তৃণমূলের একাংশ। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সক্রিয় হওয়ার পর আগুনে ঘি পড়েছে। ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়েছেন মুকুল। আর এই অবস্থায় বিজেপির বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ নেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকরাও মুকুলের হাত ধরেই দলবদল করেন ধীরে ধীরে। যে তৃণমূল মুকুলকে 'সাইড' করতে চেয়ে হারিয়েছিল, সেই তৃণমূলের দেওয়ালে ধাক্কা মারতে শুরু করেন রায়বাবু। ভাঙতে থাকে তৃণমূল। অনেকেই বলেন, মমতা অভিষেক ছাপিয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ যদি মুকুলের হাতে চলে যেত, সেই ক্ষেত্রেও খুব একটা অবাকের কিছু ছিল না। কারণ, তৃণমূলের সংগঠনে নাকি এতটাই ভূমিকা ছিল মুকুলের!
আরও পড়ুন-কংগ্রেস-বিজেপির আধিপত্য ছাপিয়ে যাদব রাজত্বের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদব
ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মুকুলের দল পরিবর্তন। সারদা-নারদায় জড়িয়ে যাওয়া, সিবিআই তদন্তের হাত ঘর বাঁচতে গদ্দারির মতো অভিযোগ উঠলেও এই মুকুল রায়, দিলীপ, রাহুল সিনহা প্রভাবেই বঙ্গ বিজেপিকে তুলে ধরেছিলেন অন্যভাবে। রাজ্যের নেতৃত্বের সঙ্গে খানিকটা অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও মুকুলই মূলত বিজেপিকে বঙ্গে আরও শক্ত করেন। ছেলে শুভ্রাংশু রায়কে প্রথম অবস্থায় পুরনো দলে রেখে অন্য দলের নেতা হওয়া কেন্দ্রে ফের ভূমিকা বাড়ানোর কৌশলেও প্রশ্ন উঠেছিল তলায় তলায় মমতার সঙ্গে যোগাযোগের তত্ত্ব নিয়ে। যদিও শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপি যোগে স্পষ্ট হয় মুকুল-অসন্তোষ। ক্রমশ কোণঠাসা মুকুল অবশেষে ছাড়েন দল। এই সুযোগেই ফের তৃণমূলে ফেরেন তিনি। ততদিনে বিজেপির রাজ্যে ক্ষমতা লাভের স্বপ্ন ভেঙেছে। এই অবস্থায় ফের বিশ্বাসঘাতক তকমা আর বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস্ কমিটির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন। আদালতে মামলা। পদ হারানো। একের পর এক মন্তব্য। তিনি বিজেপি না তৃণমূলের বিধায়ক, তাই নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয় বারবার। মুকুল থাকেন মুকুলেই। তবে এদিনের এই বৈঠক সেই পুরনো মুকুলের দিকেই ইঙ্গিত করছে ফের।
মুকুল রায় ১৯৯৮ সালের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বের সঙ্গী তিনি। এই মুকুলকে সঙ্গে নিয়েই নতুন দল গঠন করেন মমতা। তৈরি হয় তৃণমূল কংগ্রেস। দেশে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী হন মুকুল রায়। মমতার রেলমন্ত্রক ছাড়া, দীনেশ ত্রিবেদীর উপর ভরসা রাখার পরেও একটা সময় ভাড়া বাড়ানো বিতর্কে দীনেশের পরিবর্তে রেলমন্ত্রী হন মুকুল। এর আগে থেকেই মমতার বিকল্প হিসেবে দিল্লির অলিন্দে প্রভাব বাড়ে তাঁর। ২০০৬ সাল থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন মুকুল।
অনেকেই বলছেন, একের পর এক দুর্নীতি ইস্যু আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডলের মতো তৃণমূল নেতার জেলবন্দি অবস্থায় ফের চাপে রয়েছে তৃণমূল। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি এবং সংগঠনের বিস্তারে, দল ভাঙাকে আটকে দিতে কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে চাইছেন মমতা! অর্থাৎ যে মুকুল তৃণমূলের জন্ম থেকে সংগঠন বাড়ানোর কাজে দক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই মুকুলই ২০১৭ এর পর দল ভাঙাতে সফল হয়েছেন। ঠিক সেই কারণেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই মুকুলকে দিয়েই এক ঢিলে দুই পাখি তাড়াতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী। এক, তৃণমূল শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ বৃত্ত সহ, সংগঠনের ক্ষেত্রে মুকুলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো। দুই, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে গ্রামে গঞ্জে বিজেপির সংগঠনের হালহকিকত জানা মুকুলের সাহায্য নিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করার চেষ্টা। যেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় খুব একটা আপত্তি জানাবেন না বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।