সর্বাঙ্গ ঢাকা বর্ম পরিয়ে দেওয়া হতো কবর! চিনের মৃতদের এই রহস্য তাক লাগাবে...

Chinese Mysterious Death Suit: এই বর্ম সোনার তারের সাহায্যে একত্রে বেঁধে রাখা জেডের হাজার হাজার ছোট অংশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।

কবরে আর চিতাতে মানুষ কীই বা নিয়ে যায়- এ জাতীয় দর্শনকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল বহু বহু শতাব্দী আগে মিশরীয়রাই। পিরামিড আর মমির রহস্য আজও সম্পূর্ণ উদ্ধার করা যায়নি তাই। কিন্তু মৃতদের বিষয়ে মিশরকে গুণে গুণে গোল দিতে পারে চিন। চিনারা মৃতদেহের সঙ্গে যা যা প্রথা পালন করত তা নিয়ে গবেষণা চলছে এখনও। চিনে প্রায় হাজার দুয়েক বছর আগে রাজা রাজড়াদের সমাহিত করা হতো বিশেষ এক বর্ম পরিয়ে। চিনে হান রাজবংশের সময়, প্রাচীন চিনা রাজাদের জেডের টুকরো দিয়ে হাতে তৈরি বর্ম পরিয়ে সমাধিস্থ করা হতো। এই জেড পাথরের কাটা কাটা অংশগুলি সোনা এবং রুপোর সুতো ব্যবহার করে একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো। এটি সেই সময়কার সবচেয়ে ধনী এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য ছিল বিশেষ শেষকৃত্য। কেন এমন বর্মের আড়ালে রাখা হতো মৃতদেহ?

প্রাচীন চিনের ইতিহাসে জেড বা নেফ্রাইটের বিশেষ স্থান রয়েছে। নেফ্রাইটের স্থায়িত্ব এবং শক্তির জন্য এটি সেই সুপ্রাচীন নিওলিথিক সময়কাল থেকেই (প্রায় ৩৫০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিখ্যাত। সেই সময় সরঞ্জাম এবং অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হতো এই পাথর। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক, সুদৃশ্য বস্তুতে, গয়নাতেও ব্যবহৃত হতে থাকে এই পাথর। হান রাজবংশের আবির্ভাবের (২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে) পর থেকে জেড পাথর অভিজাতদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন- নুন দিয়ে দেহ শুকনোর পর কী এমন মাখানো হতো দেহে? অবশেষে ফাঁস মমি তৈরির রহস্য

এর স্থায়িত্ব এবং স্বচ্ছ রঙের কারণে জেড বিশুদ্ধতা, নৈতিক সততা এবং অমরত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। হানরা বিশ্বাস করত, একজন ব্যক্তির আত্মার দু'টি অংশ থাকে। একটি অংশ, অন্তর-আত্মা মৃত্যুর পর পরজীবনে চলে যায়। সেখানে অমরদের স্বর্গে (জিয়ান) বসবাস শুরু করে আর অন্য অংশটি অর্থাৎ দেহ-আত্মা, কবরের মধ্যে এই পৃথিবীতেই রয়ে যায়। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক আচারের মাধ্যমে এই দেহ-আত্মা ফের অন্তর-আত্মার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। জেড পাথর এই আচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কারণ, হানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এর রহস্যময় বৈশিষ্ট্যগুলি দেহের পাশাপাশি কবরে সংযুক্ত আত্মাকেও সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে।

আত্মা এবং দীর্ঘায়ুর মধ্যেকার এই সম্পর্কটি চিনা ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ান খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, হান সম্রাট উ-এর (১৫৭-৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জেড বর্মে লেখা ছিল, "মানুষের প্রভুর দীর্ঘ জীবন"। হানদের বিশ্বাস ছিল, শরীরের অমরত্ব রক্ষা করার জন্য জেডের তৈরি সারা শরীর ঢাকা বর্ম খুবই দরকার। সম্রাট উ তাঁর জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে ৬ মিটার (২০ ফুট) ব্রোঞ্জের প্লেটে সকালের টাটকা শিশিরের সঙ্গে গুঁড়ো জেড মিশিয়ে তৈরি একটি পানীয়ও গ্রহণ করতেন। যদিও তা বিশেষ কাজে আসেনি।

আরও পড়ুন- মৃত্যুর পরেও মেলেনি কবর! কীভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা?

৩২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনা সাহিত্যে প্রথম জেড বর্মের কথা মেলে, তবে ২০ শতকের শেষের দিকে এগুলিকে মিথ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। তারপরে, ১৯৬৮ সালে, দু'টি অক্ষত জেড বর্ম আবিষ্কৃত হয়। এই বর্ম সোনার তারের সাহায্যে একত্রে বেঁধে রাখা জেডের হাজার হাজার ছোট অংশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। হান রাজবংশের শাসক লিউ শেং এবং তাঁর স্ত্রী রাজকুমারী ডু ওয়ানের সমাধিতে এই বর্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল।

লেটার হান বই অনুসারে, বর্মে ব্যবহৃত সুতোর ধরন ব্যক্তির অবস্থার উপর নির্ভর করে। প্রত্যেকেরই সোনার তারে বাঁধা বর্ম রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সম্রাটরাই কেবল সোনার তাতে বাঁধানো জেড বর্ম পরতে পারতেন। রাজকুমার, রাজকন্যা, ডিউক এবং মার্কুইসরা রুপোর সুতো ব্যবহার করতেন। এই অভিজাতদের পুত্র-কন্যাদের তামার সুতো দেওয়া হত এবং আরও কম পদাধিকারী অভিজাতদের রেশম দেওয়া হতো। এই সামাজিক স্তরের নিচে থাকা কোনও মানুষই নিজেদের কবরের জন্য এই জাতীয় বিশেষ বর্ম ব্যবহার করতে পারত না।

প্রথাটি ওয়েই রাজ্যের প্রথম সম্রাটের শাসনামলেই শেষ হয়ে যায় বলে মনে হয়। ভয় ছিল যে, এই ধরনের বিলাসবহুল জিনিসগুলি ডাকাতদের নজরে পড়বে এবং তারা সোনা এবং রুপো পেতে বর্মগুলি পুড়িয়ে ফেলবে।

 

More Articles