গুজরাতে ৫০০ মৃতদেহের কবর উদ্ধার! মাটির নিচে আজও চাপা পড়ে হরপ্পার মৃতরা?

Gujarat Mass Graveyard : কবরগুলিতে মেলা মৃতদেহের স্বাস্থ্য বলে দিচ্ছে বেশিরভাগই ভালো খাওয়াদাওয়া করা মানুষ ছিলেন, স্বাস্থ্যবানও ছিলেন কেউ কেউ।

২০১৯ সালে ভারতের পশ্চিমে গুজরাত রাজ্যের স্বল্প জনবসতিপূর্ণ কচ্ছ অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে খননকাজ শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। জায়গাটা পাকিস্তান থেকে খুব দূরেও না। বালিতে ভর্তি জমি। সেরকমই একটি বেলেমাটির ঢিবি খুঁড়তে শুরু করে বিজ্ঞানীরা। তখনও তারা জানেন না, কী অসীম ঐশ্বর্য অপেক্ষা করে রয়েছে তাদের জন্য। যখন খনন শুরু হয়, প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভাবেন প্রাচীন বসতি আবিষ্কার করতে চলেছেন তারা। এক সপ্তাহের মধ্যেই ভুল ভাঙে। ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে, জনবস্তি নয় আসলে একটি কবরস্থান লুকিয়ে ছিল মাটির গর্ভে। বিশ্বের প্রাচীনতম শহুরে সভ্যতার কবর।

৪০ একর জায়গায় ১৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের নিয়ে তিনটি পর্যায়ে খননকাজ চলে। গবেষকরা মনে করছেন, বিশ্বের প্রাচীনতম নগর সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতার অন্তত ৫০০টি কবর রয়েছে ওই স্থানে। ২০০ টির মতো কবর খোঁড়া হয়েছে এখনও।

হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত এই সভ্যতায় প্রায় ৫,৩০০ বছর আগে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা প্রাচীর ঘেরা পোড়া ইঁটের তৈরি শহরে বাস করত। জায়গাটি এখন উত্তর-পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তান মিলিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কারের পর থেকে গত প্রায় এক শতাব্দীতে গবেষকরা ভারত ও পাকিস্তানে ২,০০০টি স্থান খুঁজে বের করেছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গুজরাতের খাতিয়া গ্রামের কাছে আবিষ্কৃত এই বিশাল কবরস্থানটি সম্ভবত এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় 'প্রাক-শহুরে' কবরস্থান। প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস, ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অবধি প্রায় ৫০০ বছর ধরে ব্যবহার করা হয়েছিল এই কবরস্থান। এখনও পর্যন্ত খননের ফলে একটি অক্ষত পুরুষদেহের কঙ্কাল পাওয়া গেছে, পাশাপাশি খুলির টুকরো, হাড় এবং দাঁত সহ আংশিকভাবে সংরক্ষিত কঙ্কালের অবশেষও পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন- ৪,০০০ বছরের ঐতিহ্যের শবযাত্রা! মহেঞ্জোদারোর বিখ্যাত মূর্তি যেভাবে বদলে গেল…

প্রত্নতাত্ত্বিকরা সমাধিস্থ প্রত্নবস্তুও খুঁজে পেয়েছেন। ১০০টিরও বেশি চুড়ি এবং ২৭টি ঝিনুকের খোল দিয়ে তৈরি গয়না, সিরামিকের পাত্র, বাটি, থালা-বাসন, হাঁড়ি, ছোট কলসি, মাটির পাত্র, জলের কাপ, বোতল ও বয়ামও আবিষ্কৃত হয়েছে। কবরগুলি বেলেপাথরের। কিছু কিছু ডিম্বাকৃতির, কিছু আয়তক্ষেত্রাকার। ছোট কবরও আছে যেখানে শিশুদের কবর দেওয়া হয়েছিল। মৃতদেহগুলি উপর থেকে দেখলে আস্ত মনে হলেও অম্লীয় মাটির কারণে বেশিরভাগ হাড়ই দ্রবীভূত হয়ে গেছে।

মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার অভিজাতদের কবরের থেকে এই কবরগুলি ভিন্ন। মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কোন গয়না এবং অস্ত্র দেওয়া হয়নি। এখানে বেশিরভাগ মৃতদেহই কাপড়ে মোড়ানো এবং আয়তাকার কাঠের কফিনে রাখা। সিন্ধু সভ্যতার পণ্ডিত উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাথন মার্ক কেনয়ারের মতে, কফিনগুলি কবরে নামানোর আগে কবরের গর্তটি প্রায়শই মৃৎপাত্রের নৈবেদ্য দিয়ে ভরা হতো। কিছু কবরে ব্যক্তিগত অলঙ্কার- চুড়ি, পুঁতির মালা, তাবিজ মিলেছে। কিছু মহিলাকে তামার তৈরি আয়না সঙ্গে দিয়ে কবর দেওয়া হয়েছিল। প্রাপ্তবয়স্কদের খাবার পরিবেশন এবং খাবার সংরক্ষণের বিভিন্ন ধরনের পাত্র দিয়ে কবর দেওয়া হয়েছিল। শিশুদের সাধারণত কোনও মৃৎপাত্র বা অলঙ্কার দিয়ে কবর দেওয়া হতো না।

কবরগুলিতে মেলা মৃতদেহের স্বাস্থ্য বলে দিচ্ছে বেশিরভাগই ভালো খাওয়াদাওয়া করা মানুষ ছিলেন, স্বাস্থ্যবানও ছিলেন কেউ কেউ। তবে কারও কারও বাতের ধাত ছিল, শারীরিক চাপেও ভুগতেন অনেকে।

আরও পড়ুন- আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক, শতবর্ষ পেরিয়েও যে রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে ‘মৃতের শহর’

তবে, গুজরাতের এই বিশাল সমাধিক্ষেত্রের রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। ২০১৬ সালে ওই গ্রামের একজন প্রধান কেরলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের পড়ুয়াদের একটি দলকে নিয়ে গিয়ে এই স্থানটি দেখান। ৪০০ লোকের ছোট্ট গ্রাম খাতিয়া থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে ছিল এই কবরস্থান। গ্রামের মানুষদের জীবিকা বলতে চাষ, চাষের জন্য নির্ভর করতে হয় বৃষ্টির উপরেই। এই জমিতে চিনাবাদাম, তুলো এবং ক্যাস্টর জন্মায়। গ্রামবাসীরা বলছেন, বৃষ্টির পর তাঁরা দেখতে পেতেন নানা রকমের পাত্র মাটি থেকে উঠে আসছে। অনেকেই ভাবতেন ব্যাপক পরিমাণে ভূত রয়েছে আশেপাশে। কিন্তু ভূতগুলি কাদের? গুজরাতের এই কবরে শুয়ে থাকা মৃতদেহগুলি কাদের? কী তাঁদের পরিচয়?

এক জায়গায় এত কবর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তোলে। এটা কি তবে ওই গোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্রামের জায়গা ছিল? না কি বৃহত্তর কোনও জন বসতি ছিল আশেপাশে? কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ অভয়ন জিএস বলেছেন, এখনও আশেপাশে কোনও বসতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখনও খনন চলছে। তবে এমন কিছু জনবসতি অবশ্যই আছে যা কবরস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেগুলি সম্ভবত আধুনিককালের বাড়িঘরের নীচে চাপা পড়ে আছে বা এখনও অনাবিষ্কৃত। কবরগুলি পাথরের দেয়াল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তা থেকে বোঝা যায়, সেই সময়ের লোকজন পাথর দিয়ে নির্মাণকার্য জানত।

সিন্ধু সভ্যতার লিপির এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি। এই শীতে, বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য বসতি খোঁজার লক্ষ্যে খাতিয়ার কাছে কবরস্থানের উত্তরে একটি জায়গায় খননের পরিকল্পনা করছেন। এই বসতি মিললে সম্ভবত ধাঁধার একটি অংশ সমাধান করা যাবে।

More Articles