'কখনও সঠিক দাম পাব, কখনও পাব না', গুলজারকে বলেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ...

Naseeruddin Shah wrote letter to Gulzar: সোজা তাঁর কাছে গিয়ে 'মির্জা গালিব' ছবির প্রস্তাবটি রাখলেন তিনি। অভিনেতা মন দিয়ে শুনলেন সবটুকু। তার পর গুলজারকে জিজ্ঞেস করলেন...

কবি বলেছেন, 'যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।' শাহরুখ খান শোনালেন, 'পুরে কায়ানাত'-এর 'কওশিস'-এর গল্প। আম-আদমি যায় কোথায়! চাওয়া-পাওয়ার 'দুরন্ত ঘূর্ণি'তে রাতদিন সে দোলে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে ওই যে এ সমস্ত গল্প আম আদমির। 'আসবেন, দেখবেন এবং জয় করবেন' বলেই যাঁদের জন্ম, তেমন ক্ষণজন্মাদের গল্পটা আলাদা। তার পরেও তো গালিব লেখেন, "কোয়ি উমিদ বর নহি আতি, কোয়ি সুরত নজর নহি আতি।" উর্দু কবিতার জগতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। জীবনযন্ত্রণার রসে হৃদয়কে ভিজিয়ে তা নিংড়ে সাহিত্য করার কাজ সহজ নয়। সমগ্র পৃথিবী সমস্ত সরঞ্জাম, সুবিধা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল না তাঁর জন্য। অভাব-অনটন, খিদের জ্বালা, একাকিত্ব, বারবার বাসা বদলে যাওয়া, কী ছিল না তাঁর জীবনে। তবু সে সমস্ত কষ্টে নিজেকে প্রতিদিন জারন করেছেন গালিব, জ্বালিয়েছেন, পুড়িয়েছেন, তাঁর সাহিত্য হয়ে উঠেছে সোনা।

আরও পড়ুন: গালিবকে শূন্য হাতেই ফিরিয়েছিল পুরোনো কলকাতা, কেমন ছিল সেই শহর

নদীর জল বরাবর এক খাতে বয় না। যেমন বয়নি গালিবের জীবন। বনেদি পরিবারে জন্ম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খানের। ছোট করে নৌসা। আর আমাদের মির্জা গালিব। প্রপিতামহ ছিলেন সমরকন্দের সৈনিক। দাদুও পথভ্রষ্ট হননি। লাহৌরের নবাবের সেনা হয়ে মোঘল বাদশা শাহ আলমের ফৌজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেই পথে হাঁটলেন বাবা-কাকা। লখনউয়ের নবাবের রাজদরবার হয়ে হায়দরাবাদের নিজামের ফৌজ ঘুরে শেষপর্যন্ত ভাগ্য নিয়ে গেল আলোয়ারের রাজার সেনাবাহিনীতে। গালিবের বনেদি জীবন ওই পর্যন্তই। আলোয়ারে মাথা চাড়া দেওয়া বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে প্রাণ হারান বাবা। মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে নৌসা এলেন কাকা নসরুল্লাহ বেগের পরিবারে, আগ্রাতে। আলোয়ারের দেওয়ান অহমদ বক্সের বোনকে বিয়ে করে তিনি তখন সম্ভ্রান্ত মানুষ। সময় তখন দ্রুত বদলাচ্ছে। নসরুল্লাহ বুঝেছিলেন, নবাবের সূর্য অস্তাচলের পথে। প্রখর তেজে পৃথিবীকে জ্বালিয়ে ছাড়খার করে দিতে আসছে ব্রিটিশ শক্তি। নিজের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করার কম চেষ্টা করেননি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নসরুল্লাহ। তবে শেষরক্ষা হল। দুম করে মারা গেলেন তিনি। নৌসার তখন বয়স মাত্র ৯।

ফের অনাথ হয়ে নৌসা পৌঁছলেন মামাবাড়িতে। সেখানে কি আর পাঁচটি শিশুর মতোই ভালো ছিলেন গালিব? কোনও গঞ্জনা, কোনও গলগ্রহের পাঁক এসে ছোঁয়নি তাঁকে? তবে কীভাবে গড়ে উঠল তাঁর নিজস্ব একটি মনঃস্তাত্বিক পৃথিবী? কেন তাঁকে কুরে কুরে খেত পরগাছার মতো এক না-থিতু হওয়া জীবন? এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আছে তাঁর কবিতার, তাঁর শের ও শায়রিতে। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন না কেন 'কবিরে পাবে না তাঁর জীবনচরিতে', গালিবের জীবনের ট্রাজেডি-যন্ত্রণা, তাঁকে দুহাত ভরে শব্দভিক্ষা দিয়ে গিয়েছে প্রতিনিয়ত। ফলে তাঁর জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা, কষ্টের ছাপ স্পষ্ট থেকে গিয়েছে তাঁর কবিতায়, দর্শনে। ছোটবেলার দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করেছে আজীবন। আগ্রা ছেড়ে দিল্লি, দিল্লি থেকে কলকাতা, ফের দিল্লির জীবন, নানা গলি নানা মোড়ে ঘুরে মরেছেন মির্জা। কখনও খাবার জুটেছে, কখনও জোটেনি। জীবনযন্ত্রণার তীব্র হতাশায় ডুবে গিয়েছেন, তবে আত্মসম্মান হারাননি কখনও গালিব। নির্দ্বিধায় ছেড়ে এসেছেন ফরাসি অধ্যাপকের পদ। ঝুটি তারিফের সেতু না বেধে বিপদ বাড়িয়েছেন নিজের। তবু মাথা নোয়াননি। তাই যন্ত্রণা, হতাশারা তাঁর সাহিত্যে ফুল হয়ে ফুটেছে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একবার লুঠতরাজদের হাতে পড়ে গেল তাঁর কবিতার খাতাখানি। তার শিষ্য শাহাজাদা মির্জা যত্ন করে তাঁর কবিতার প্রতিলিপি করে বাঁধিয়ে মলাটে সোনা দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন গালিবের নাম। সোনাটুকুর লোভে তাঁর কবিতার খনি ছিঁড়েখুড়ে নষ্ট করল লুঠেরারা। যে আখর, যে সম্পদ তিনি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চেয়েছিলেন, তা ছাড়খার হয়ে গেল এক নিমেষে। বেশ কিছুদিন পর দিল্লির এক শীতের দুপুরে ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন গালিব একটু রোদের আশায়। এক ফকির খোলা গলায় গাইছেন একটি গজল। কান পেতে শুনলেন গালিব, ভারী চেনা চেনা ঠেকল তাঁর শব্দগুলি। গান শেষ হলে ফকিরকে ডাকেন মির্জা। জানতে চান, কোথায় পেলেন তিনি  ওই গজল? ফকির তাঁর ঝুলি থেকে বের করে দেন এক টুকরো কাগজ। চিনতে ভুল হয়নি গালিবের। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন মির্জা  শিশুর মতোন।

গালিব আসলে এমনটাই। তাঁর জীবনটাই যেন শায়েরি। অবহেলায়, যন্ত্রণায় ক্ষয়ে গিয়েছেন কবি। শেষপর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে অযত্নে। কিন্তু সময় তাঁর সাহিত্যকে তুলে রেখেছে যত্নে। আর সেই সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে রয়ে গিয়েছে গালিবের জীবন। এমন জীবনের কদর একজন শায়ের, একজন কবি ছাড়া আর কে-ই বা দিতে পারত বলুন তো! গালিবকে নিজের ছবির ভাষায় বেঁধে ফেলার ইচ্ছা ছিল তাঁর বহুদিনের। তিনি গুলজার। ছবির পরিচালক, সঙ্গীতকার, তার চেয়েও বড় কথা তিনি হিন্দি ভাষার একজন উৎকৃষ্টতম কবি। সেটা আশির দশকের কথা। সময় তখন দ্রুত বদলাচ্ছে। প্রযুক্তির ছোঁয়া মানুষের জীবনকে বদলে দিচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। ততদিনে পৃথিবীটা ছোট হয়ে ঢুকে পড়েছে বোকাবাক্সে। মানুষের হাতে চলে এসেছে দূরদর্শন। টিভির বোতামে হাত রেখে মানুষ পৌঁছে যাচ্ছে অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।। সেই রূপালি দুনিয়ায় গালিবের জীবনকে বেঁধে ফেলতে চাইলেন গুলজার। মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইলেন দুঃখিত মানুষটিকে, তাঁর দর্শন, তাঁর জীবনবোধকে। সব ঠিকঠাকও হয়ে গেল মোটামুটি।

কিন্তু কে করবেন গালিবের রোল? গুলজারের ওই চরিত্রে প্রথম পছন্দ ছিল হরিভাই জরিওয়ালা ওরফে সঞ্জীব কুমার। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় তখন তিনি জ্বলজ্বল করছেন। গুলজার দুরদর্শনের জন্য ছবি বানাবেন, তা-ও আবার এমন একটি চরিত্র নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই সে খবর ছড়াতে দেরি হল না। সেসময় নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুল থেকে একটি চিঠি এল গুলজারের সহকারীর কাছে। সে চিঠি তিনি খুলে পড়লেন বটে, তবে তা আর গুলজারের হাত অবধি পৌঁছল না। কী ছিল সেই চিঠিতে?

চিঠিতে ছিল একটি আবেদন। তবে সেই আবেদনের স্বর ছিল ঋজু। চিঠিটি লিখেছে ওই স্কুলেরই এক পড়ুয়া। রীতিমতো অনুযোগের সুরেই গুলজারকে সে জানায়, গালিব চরিত্রে পরিচালকের মনোনয়ন মোটেই ঠিক নয়। ওই চরিত্রটিতে মোটেও সুবিচার করে উঠতে পারবেন না সঞ্জীব কুমার। কেন পারবেন না, তার ব্যাখ্যাও ছিল স্পষ্ট। পড়ুয়ার দাবি, সঞ্জীবকুমার কিছুতেই গালিবের ফরাসি মিশ্রিত উর্দু উচ্চারণ করে উঠতে পারবেন না। তাছাড়া কবিতা কি শের-শায়রি, এসবের সঙ্গে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই সঞ্জীব কুমারের। ফলে তাঁকে নেওয়ার চিন্তা অবিলম্বে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন গুলজার সাহেব। না, এখানেই শেষ নয়। সঞ্জীব কুমারের বদলে কে হতে পারেন ওই চরিত্রে যথাযথ, সেই পরামর্শও চিঠিতে সবিস্তার লিখেছিল ওই পড়ুয়া। জানিয়েছিল, আর কেউ নয়, গালিবের চরিত্রের সঙ্গে সুবিচার করতে পারে একমাত্র সে নিজেই। তাই পড়াশোনা শেষ করে যতদিন না পাকাপাকি ভাবে অভিনয়ে চলে আসছে সেই কিশোর, ততদিন পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করেন গুলজার। ততদিন মুলতুবি থাকুক গালিবকে নিয়ে ছবির কাজ।

সেই চিঠি পৌঁছলো না গুলজারের কাছে। তবে যেন 'কী থেকে কী হইয়া গেল।' বন্ধ হয়ে গেল গালিবের উপরে ছবি তৈরির কাজ। মাঝখানে চলে গেল বেশ কিছুটা সময়। ততদিনে দূরদর্শন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোণায় কোণায়। ফের গালিবের ভূত নড়েচড়ে উঠল গুলজারের মাথায়। ছবিটা এবার তাঁকে বানাতেই হবে। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। হঠাৎ করেই মারা গেলেন সঞ্জীব কুমার।  তাঁর ছবিতে কে অভিনয় করবেন এবার গালিবের ভূমিকায়। গুলজারের মাথায় ঘুরতে লাগল অন্য একটি নাম।

হিন্দি ছবির দুনিয়ায় সেই অভিনেতা তখন খ্যাতির শীর্ষে, স্বাভাবিক ভাবেই তার দরও বেশ চড়া। হবে না কেন, ইতিমধ্যেই তার ঝুলিতে এসে গিয়েছে বেশ কিছু নামিদামী পুরস্কার। এদিকে, ছবির প্রযোজক-পরিচালকের কপালে ঘনাল দুশ্চিন্তার মেঘ। এ কাজ তাঁকে ছাড়া সম্ভব নয়, এদিকে তহবিলও তেমন ভরসা দিচ্ছে না। তবু বুক ঠুকে সেই অভিনেতার দরজায় চলেই গেলেন গুলজার। যা কপালে থাকে, তাই হবে। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। সোজা তাঁর কাছে গালিব ছবিটির প্রস্তাব রাখলেন তিনি। অভিনেতা মন দিয়ে শুনলেন সবটুকু। তার পর গুলজারকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক বছর আগে প্রথম যখন এই ছবিতে হাত দিতে গিয়েছিলেন, তখন নৈনিতাল থেকে জনৈক কিশোরের লেখা চিঠি পেয়েছিলেন কিনা! গুলজার তো পড়লেন আকাশ থেকে। কারণ তাঁর সহকারীর হাত ঘুরে সেই চিঠি তো কোনওদিন তাঁর কাছে পৌঁছয়ইনি। অবাক হয়ে গুলজার বললেন, "না তো, কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে?"

এরপর সমস্ত কথা খুলে বললেন অভিনেতা। জানালেন, সেদিনের সেই কিশোর আসলে তিনিই। ভরসা দিলেন গালিবের চরিত্র তিনিই করবেন। বললেন, "রইল বাকি দেনা-পাওনার কথা। সে ব্যাপারে গালিবের যা দশা ছিল, আমারও না হয় তাই হবে। কখনও সঠিক দাম পাব, কখনও পাব না।" ব্যাস, হইহই করে শুরু হয়ে গেল ছবির শুটিং। বাকিটা ইতিহাস। ১৯৮৮ সালে দুরদর্শনে মুক্ত পেল মির্জা গালিব। গালিবের জীবনের জীবন্ত দলিল যেন। গুলজারের পরিচালনা, জগজিৎ সিংয়ের গজল আর গালিবের ভূমিকায় নাসিরুদ্দিন শাহ। দর্শককে এক মুহূর্তে নিয়ে চলে গেল পুরোনো দিল্লির সেই গালিব হাবেলি-তে। শরীরে, ভাষায়, অভিব্যক্তিতে সেদিন একেবারে মির্জা হয়ে উঠেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ।

আরও পড়ুন: একটা ‘না’ থেকে দূরত্বের শুরু, রাখি-গুলজারের প্রেমের গল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না…

গালিব যেন লেখাই ছিল তাঁর কপালে। আর তা যেন তিনি জানতেন প্রথম থেকেই। একে কি ইচ্ছাপূরণ বলবেন না আত্মবিশ্বাস! কী অদ্ভুত ঋজুতার সঙ্গে তিনি পৌঁছেছিলেন স্বপ্নের কাছাকাছি। নাকি স্বপ্নই এসেছিল তাঁর কাছে। তখনও আমাদেরকে শাহরুখ বলে দেননি, 'পুরে কায়ানাত' সত্যিই স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায় কিনা! কিন্তু সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ। দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ইচ্ছেশক্তির জোরে সব সম্ভব। আর বলেছিলেন গালিব।
"হাজারোঁ খোহাইশে অ্যায়সি কি হর খোহাইশ মে দম নিকলে
বহত নিকলে মেরে আরমাঁ লেকিন ফির ভি কম নিকলে..."

যে ঋজুতা নিয়ে আজীবন বেঁচে থেকেছেন গালিব, যে ঋজুতার সঙ্গে নৈনিতাল থেকে চিঠি লিখেছিল কিশোর, সেই ইচ্ছেশক্তির জোরই মিলিয়ে দিয়েছিল দুই যুগের দুই মানুষকে। মাঝখানে শুধু সেতুটুকু বেঁধে দিয়েছিলেন গুলজার। বাকি কথা রাখা থাকল নাহয় ইতিহাসের কাছেই।

More Articles