ডার্ক লিপস্টিক, ছোট স্কার্ট! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে মানেই যৌন উন্মাদনা?

History of Anglo Indians in Kolkata: অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারীদের বরাবরই দেখা হয়েছে যৌন উন্মাদনার চিহ্ন হিসাবে।

নরেন মিত্তির গল্প লিখতেন কলকাতা নগর-শহর তৈরির শুরুর দিককার। তাঁর অবতরণিকা (১৯৪৯) গল্পটিকে মাথায় রেখে সত্যজিৎ রায় ছবি বানালেন ‘মহানগর’। ১৯৬৩-তে সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তি পেল ‘মহানগর’। বিশাল জনপ্রিয় হয়, বাঙালি অভিনেত্রী মাধবী মুখপাধ্যায়কে সহকর্মী এডিথ সিমন্সের লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দেওয়ার সিন-টি। “হোয়াই নট? হোয়াট’স রং উইথ ওয়ারিং আ লিটিল লিপস্টিক?” কপালে-মাথায় যখন লাল পরোই, তাহলে ঠোঁটে লাগাতে অসুবিধা কীসের? পিতৃ-পুরুষের জমি-জিরেত, বসত-ভিটে ছেড়ে উঠে এসে শহর কলকাতায় গুছিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে তখন অনেকেই। শুধুই ঘরের পুরুষের রোজগারে আর চলছে না এবার। তাই অফিসের ভাত টাইমে রেঁধে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়েছেন মিসেস মজুমদার। রোজগারের নেশায়। তাঁর অফিসবেলার সঙ্গী ব্লান্ট-কাট ছোটচুলের এডিথ সিমন্স। বেতনের দিনে এডিথকে খামে দেওয়া নোংরা টাকাগুলো খানিকটা নিজের কড়কড়ে নোটের সঙ্গে বদলে নিয়েছিলেন আরতি মজুমদার। তাই তাঁর উপহার- একটি লিপস্টিক। যদিও, অ্যাংলো-মহিলার সঙ্গে বন্ধুত্ব মোটেই ভালো চোখে দেখেনি তাঁর পরিবার। একই ছবি উঠে এসেছে অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-এও। নবীন বাঙালি জুটি তাঁদের লাভ-মেকিংয়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এক অ্যাংলো প্রৌঢ়ার নিরিবিলি বাড়ি। কিছুদিন পর তাঁকেই নিজেদের সামাজিক জীবন থেকে অনায়াসে ছুড়ে ফেলে দেয় সেই নব্যবিবাহিত দম্পতি। বুদ্ধদেব গুহর লেখাতেও বারবার আমরা দেখেছি, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের জঙ্গলে সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াতেন ছোটখাটো চেহারার হাসিখুশি মিসেস কার্নি।

কী কারণ হাসিখুশি-জীবনমুখী চেতনার?

- “বিকজ উই হ্যাভ নাথিং লেফট বিহাইন্ড ফর আস”। কেন কাজ করব না বলোতো? কিছুই তো ছিল না আমাদের। আমাদের মেয়েরা ‘ব্রেড-আর্নার’ হয়েছে তাই অনেক আগে থেকেই। সবাই যে খুব ‘গ্লোরিফায়েড’ কাজ করেছে, তা নয়। স্টেনোগ্রাফার, টাইপিস্ট, সেক্রেটারি, ক্যাব্রে ডান্সার, ঘরোয়া রেস্তোরাঁ চালানো - সবই করেছি আমরা, – বলছিলেন গ্রেস।

‘মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন’ প্রণয়নের পর থেকেই সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল দেশিয়দের। এরপর ব্রিটিশরা একে একে দেশ ছেড়ে যেতে শুরু করল। অফিসপাড়াতেও তাই শুরু হল বাঙালি সংস্কৃতির অনর্থক মোড়লি। কোণঠাসা হয়ে এলেন অ্যাংলো পুরুষরা। মূলত তারা কাজ করতেন ডক, রেলওয়ে স্টেশন আর সরকারি দপ্তরে। তখনই বাইরে বেরিয়ে এলেন অ্যাংলো-মহিলারা।

ফিরে আসি গ্রেসের কথায়।

-শুনেছি, আপনি একা-একা অসম, নাগাল্যান্ড, খড়গপুর এইসব ঘুরে বেরিয়েছেন?

-“হ্যাঁ ঘুরেছি তো। আমরা কি তোমাদের মতো নাকি? তবে, আমার অনেক বাঙালি বন্ধু ছিল। তারা ঘুরতে যেত তাদের ‘কর্তা’-দের সঙ্গে । আমার ‘কর্তা’ তো ‘ওদেশে’ । আমি কী করব বলো?”

অ্যাংলো-মহিলারা তাঁদের পেশা, বিবাহ, বাসস্থান নিয়ে বরাবরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে একা। কারণ রোজগারের টাকা ছিল তাদের নিজেদের। এসব বলে হেসে উঠেছিলেন বৃদ্ধা গ্রেস। “উনি চলে গেলেন, আমিও তাই বিফোর ম্যারেজ পদবি রেখেছি”।

আরও পড়ুন- অ্যাংলো বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করা ছিল মানা…

-যে কোনও ধরনের কাজ করতেই স্বচ্ছন্দ তোমরা?

- “না। কর্মপ্রথায় ‘হায়ারার্কি’ বোধহয় আমরা তোমাদের থেকেই শিখে নিয়েছি”। বলেছিল আমার বন্ধু ফেলিশিয়া। “আসলে আমার সব পিসিরা তো মিশনরি স্কুলের শিক্ষিকা। আমার কাছেও প্রত্যাশা ছিল তাই। বিএড-এ ভর্তিও হয়েছিলাম। আমার মমের এইসব ব্যাপার নেই। মমের তো ইচ্ছা ছিল আমি পিএইচডি করি। মমকে পিসিরা তো একদম পছন্দ করে না। আমার বাবারা আসলে বাঙালি-খ্রিস্টান। মম তো ‘পিওর অ্যাংলো’।”

-পিএইচডি?

-“হ্যাঁ জানো, পাড়ার এক কাকু একবার মমকে বলেছিল- “তোমার মেয়ে এত পড়াশুনো শিখে কী মাদারির খেলা দেখাবে? এরপর তো বিয়ে দেওয়ার জন্য খ্রিস্টান পাত্র পাবে না?” কারণ আশেপাশের বাঙালি সমাজের ধারণা, খ্রিস্টান ছেলেরা পড়াশোনা করে না। হয় ‘ড্রপ-আউট’, নইলে হোটেলে কাজ করে। আসলে, ঔপনিবেশবাদের ঔরসজাত সন্তানদের কোনওদিনও এর চেয়ে বেশি জায়গা দিতে চায়নি এই কৌম সমাজ।

কথা হচ্ছিল তাদের পোশাক নিয়ে। গ্রেস বহুবছর কাজ করেছেন ডালহৌসির এক অফিসে।

-“কী করব ভাই? তোমরা তো নিজেদের মতো দেখতে না হলে কাজে নেবে না। আমিও আগে ফ্রক পরতাম। যখন কাজ করা শুরু করলাম, সালোয়ার কামিজ পরা ধরলাম। বাইরে অন্য কোথাও গেলে নিতাম মেখলা-চাদর।”। যতবার তাদের সঙ্গে মিশেছি, কথা বলেছি, বাড়িতে গেছি দেখা করতে, বুঝেছি, পুরনো প্রজন্মের মহিলারা পরতে পছন্দ করেন ইওরোপিয় পোশাক। তাঁরা বেঁচে আছেন ‘লস্ট হোয়াইট গ্লোরিতে’। নতুনরা বরং অনায়াসেই পরে নিচ্ছে ভারতীয় পোশাক। কারণ তারা জানে, তাদের খেতে-পরতে-ঘর বানাতে হবে এখানেই। অনেক অ্যাংলো মেয়েদেরই আজকাল ‘বাঙালি প্রেমিক’। কিন্তু কেন এই পোশাকে অভিযোজন?

ঔপনিবেশিক লেখন পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে, সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয় সংস্কার, দেহরীতি ও আচার। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারীদের বরাবরই দেখা হয়েছে যৌন উন্মাদনার চিহ্ন হিসাবে। লরা বেয়ার তাঁর কাজে উল্লেখ করেছেন ভারতীয় সিনেমার কথা। “দ্য ভ্যাম্প, হু ওয়ার্স আ মিনি স্কার্ট ইজ অলওয়েজ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান”। বেশিরভাগ হিন্দি বা তামিল ছবিতে যৌনকর্মী ছিল, ‘মেরি বা অ্যানি’। ছবিতে তাদের চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হতো শুধুই শরীর এবং যৌনচিন্তা। বেলেল্লাপনা ও মদ্যপানের দৃশ্য। কথা হচ্ছিল সেসময়ের বলিউডি থিয়েটারে কাজ করা এক অ্যাংলো-প্রৌঢ়র সঙ্গে।

-“...সেসময়ের থিয়েটার কোম্পানিগুলি বেছে নিত ‘লাইট স্কিনড’ অ্যাংলো মহিলা, পরনে শর্ট ড্রেস, ব্যাকড্রপে থাকত শেডি নাইট ক্লাব। তাদের দিয়েই বেশিরভাগ সময় করানো হত যত ‘ডার্টি ড্যান্স’।” কারণ, আমরা দেখতে ভালোবাসি অভ্যস্ত ছবি। ধরে নিই, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলার শরীর মানেই ক্যাব্রে ডান্সিংয়ের পোস্টার। আমাদের যৌথ-অবচেতনে বারবার একই ছবি দাগ কাটে। সাদা চামড়ার ঔদ্ধত্য যাতে নেই, আছে বাদামি নমনীয়তা। তৈরি হয় ‘টাইপ’। এই ‘টাইপ’ তৈরিকেই কি ভয় পেলেন অ্যাংলো-মহিলারা?

বুড়ি অ্যাংলো ফ্রক পরে ঘুরলে, প্রতিবেশীর খোঁটা জুটেছে অনেকক্ষেত্রেই। “অথচ আমার গ্র্যানি কোনওদিনও লেসের ফ্রক ছাড়া কিছু পরেননি”। অ্যানের এসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। “আসলে তো আমরা ব্রিটিশ”। তাঁর বন্ধু সিন্থিয়া আবার বলছিলেন অন্য কথা। “আমি আগে রিপন স্ট্রিটে থাকতাম। বাইরে বেরোলে আগে মিডি পরতাম। পিকনিক গার্ডেনে আসার পর তো বেশি বাইরে বেরোই না। তবে ওই বাড়ি থেকে চার্চে যাওয়ার সময় একটা রিকশা নিতে হয়, যেখান থেকে রিকশা নিই, সেখানে অনেক লোক থাকে তো, তাই সালোয়ার কামিজই পরি। আর আজকাল তো চার্চে অনেকে মাথায় উড়নিও নেয়, সবাই নিলে আমিও নিই।” মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মার্টন চরিত্র অভিযোজনের ক্ষেত্রে দু'টি দিক দেখেছেন। স্ব-আরোপিত আত্মচিন্তা ও অপর-আরোপিত আত্মচিন্তা। অ্যাংলো মেয়েরা কখনও তাদের ছবি এঁকেছেন তাদের নিজেদের মনের রঙে, আবার কখনও এঁকেছেন বৃহত্তর সমাজের রঙে। তাই জমে উঠেছে খানিকটা আত্মজিজ্ঞাসাও।

আরও পড়ুন- ভেলানকান্নি মাতা ও বড়দিনের প্রসাদি

অ্যান একটুতেই রেগে যান। একদিন কথায়-কথায় বললেন,

“টুডে অল বেঙ্গলি উওম্যান আর ইনটু ড্রিঙ্কিং এন্ড স্মোকিং। বাট দে ডু ইট প্রাইভেটলি। আমরা কোনওদিনই প্রাইভেটলি করিনি। উই ডোন্ট ডু ইট উইথ আদার্স’ মানি, রাইট?” তোমাদের এত কথার জন্যই আমার সুন্দর বোন ভেনেসা আজকাল বেশি নেশা করে থাকে।” আগেই বলেছি, আমার পরিচিত অ্যাংলো মহিলারা সকলেই কমবেশি করেছেন বাইরের কাজ। -মমকে ধমকে দেয় ফেলিশিয়া।

-“ আমরা আমাদের জীবনধারণ ছোটবেলা থেকেই নিজেরা নির্বাচন করি। এবং তার জন্য জোর মেহনতও করতে হয়েছে আমাদের। হ্যাঁ, আমি ডান্স বার যেতে ভালোবাসি। ইংরেজি বছরের শেষ ক’টা দিন আমরা খুব আনন্দ করে কাটাই। বাঙালিদের মতো বারো মাসে তেরো পার্বণ নেই আমাদের। ক্রিসমাস বছরে একবারই আসে”। তিন প্রজন্ম ধরে কর্মরত তারা। যে-সময় থেকে তারা কাজে অভ্যস্ত, সে-সময়ে সাধারণত বাড়ির বাইরের কাজে বেরোতেন না ‘ভদ্রমহিলারা’। আবার তাদের মতো ‘লেবর-সাম’ কাজ করতেন না ‘মেমসাহেবরা’-ও। যে কোনও অফিসের দাওয়াতে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্তার সাদা চামড়ার স্ত্রী এড়িয়ে চলতেন অ্যাংলোদের। কারণ সাহেবদের সঙ্গে অ্যাংলোদের ছিল বিবাহ বহির্ভূত সহবাস আর তাদের সন্তানরা ছিল ‘অবৈধ’।

আজকের দিনে স্কুলেও অ্যাংলো মেয়েদের বারবার শুনতে হয়- ‘ওভারফ্রেন্ডলি, বাবলি অ্যান্ড মোর ওপেন উইথ বয়েজ’। শান্ত স্বভাবের অ্যাংলো ছাত্রীকে চিহ্নিত হতে হয় ‘আলাদা’ বলে। অকারণে দাগিয়ে দেওয়া হয়- শর্ট ড্রেস আর ডার্ক লিপস্টিক। চিন্তক নীরোদ সি চৌধুরী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েদের বলেছেন, “প্রাণহীন মোমের পুতুল”, কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই যৌনকর্মের সঙ্গে যুক্ত।

একবার কথা উঠেছিল ‘পার্কস্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ড’ নিয়ে। ২০১২-তে সুজেট জর্ডন নামে অ্যাংলো-মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় পার্কস্ট্রিটের ক্লাব থেকে ফেরার পথে। তাঁর অ্যাংলো পরিচয়কে তাঁর ধর্ষণের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন তখন অনেকেই- এ কথা শোনা আমার অ্যাংলো বন্ধুদের কাছে।

-“...কারণ আমাদের তো ‘সানডাউন রুল’ নেই, না? মানে এই যে রাতের আগে বাড়ি ফেরার সামাজিক নিয়ম থাকে তোমাদের বাঙালি বাড়ির মেয়েদের, আমাদের তো সেরকম কিছু নেই”– বলেছিল নেস। বন্ধু ফেলিশিয়াকে বারবার প্রশ্ন শুনতে হয়েছে তাঁর ‘জাত’ নিয়ে। অথচ কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জীবনস্রোতকে ধরে রেখেছে দায়িত্ববান, কর্মঠ অ্যাংলো মহিলারাই। কোনও এক অফিসে শর্টহ্যান্ড নিয়ে নখ ক্ষয়ে গেছিল আমাদের অঞ্জন দত্তের ‘মেরি অ্যান’-এরও। আমার অ্যান অপরিচিতা হলেও এই ‘মেরি অ্যান’-কে তো চেনেন অনেকেই।

ফেলিশিয়ার সঙ্গে একবারই গিয়েছিলাম রিপন স্ট্রিটে তাদের পুরনো বাড়িতে। তার মাসির কাছে। পলেস্তরা খসা দেওয়ালে একখানি ম্লান ‘অলটার প্লেস’, ধুলোপড়া সিল্কের ফ্রকগুলোর মাঝখান থেকে উঁকি মারছেন বৃদ্ধ জিসাস। ভেনেসা অসুস্থ। বন্ধুর থেকে শুনে তাঁর জন্য নিয়েছিলাম ল্যাভেন্ডর ইয়ার্ডলে। অত্যন্ত সুন্দরী ভেনেসা একসময়ের নামকরা নৃত্যশিল্পী। বিবাহ করেছিলেন এক ফ্রেঞ্চম্যানকে। বর ছেড়ে চলে যাওয়া এবং তাঁর পেশার কারণে ভেনেসাকে ভোগ করতে হয়েছে দীর্ঘকালীন এক সামাজিক নির্জনতা। অনেক কথার পর জিজ্ঞাসা করেছিলাম-

-এত নেশা কেন করেন আপনি?

-“আমি ‘ওদেশে’ চলে যাব। ভুলে যাব আমার ‘ব্রাউননেস’-এর কথা। এই ‘ব্রাউননেস’ আমাকে বড় কষ্ট দিয়েছে। ক্রিসমাসে আমি এখনও আমার সবচেয়ে দামি সিল্কের জামাটা পরি। আমাকে কি সত্যিই তোমাদের মতো দেখতে, বলো?”

More Articles