আপনার থেকে অন্তত ৩৭ টাকা কমে পেট্রোল কিনছে ভুটান! ৯ বছরে কত টাকা বাড়তি দিলেন ভেবেছেন?

Petrol-Diesel Price: ভারত সরকার তার নাগরিকদের কাছে তেলবাবদ যে কর নেয়, তা নেয় না ভুটান সরকার। বরং তারা কোষাগার ভরানোর চিন্তা পাশে সরিয়ে রেখে নাগরিকদের পরিষেবা দেওয়ার ব্যপারেই অনেক বেশি বদ্ধপরিকর।

বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ ভুটান। সবুজমাখা এই দেশের বাসিন্দারা নাকি দেদার সুখী। হবে না-ই বা কেন! ভয়ঙ্কর দূষণ নেই, রাস্তায় বিচ্ছিরি ট্রাফিক জ্যাম নেই। অগ্নিমূল্য বাজার নেই। পেট্রোল-ডিজেলের দাম আকাশ ছোঁয় না প্রতিদিন। এ দেশে সুখ থাকবে না তো কি ১৪৩ কোটির ভিড়ে ঠাসা দেশে থাকবে! অথচ মজার ব্যপার জানেন, ভুটানে পেট্রোপণ্যের সমস্তটাই আসে ভারত থেকে। পেট্রোল-ডিজেলের মতো জ্বালানির জন্য সম্পূর্ণভাবে ভারতের উপরে নির্ভরশীল এই পুঁচকে দেশটা। অথচ ভুটানে তেলের দাম ভারতে পেট্রোল-ডিজেলের দামের চেয়ে অর্ধেক। আর এখানে বাজারে হাত দিতে গেলেই নিত্য ছ্যাঁকা খাচ্ছে আমজনতা।

আসলে পেট্রোপণ্যের দামের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে স্থানীয় বাজারের অর্থনীতি। ধরা যাক, এ বছর তরমুজ খুব সস্তা। কারণ ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে চাহিদাও ভালো। কিন্তু ক্ষেত থেকে বাজারে আসার জন্য তো যানবাহনের প্রয়োজন। আর সেখানেই মার খেয়ে যান ব্যবসায়ীরা। তেলের এত দাম যে লাভের গুড় খেয়ে যায় পরিবহণেই। ফলে বাজার যে আগুন, সেই আগুনই থেকে যায়। ইতিমধ্যেই ভারতে পেট্রোলের দাম একশো ছাড়িয়েছে। এক লিটার পেট্রোলের দাম আজকের হিসেবে ১০৬.০৩ টাকা। মাত্র এক লিটার তেলে কতদূর ছুটবে গাড়ি! ফলে বুঝতেই পারছেন, ফলন বেশি হওয়া সত্ত্বেও কেন কমে না ফসলের দাম। কেন কম দামে মেলে না বাজারের কোনও কিছুই। যারা নিয়মিত গাড়ি চালান বা ট্যাক্সিতে করে অফিস-কাছারি যান, তাঁদের কথা তো ছেড়েই দিন।

আরও পড়ুন: বিজেপির বিরুদ্ধে বললেই টুইটার বন্ধের হুমকি দিয়েছিল সরকার! অভিযোগ কতখানি সত্য?

এবার তাকিয়ে দেখুন পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশটির দিকে। ভুটান। সেখানে পেট্রোলের দাম ঘোরাফেরা করছে ৬৯ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? ভারত থেকে রফতানি হচ্ছে যে তেল, সেই তেল ভুটানে বিক্রি হচ্ছে ভারতের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে। কীভাবে সম্ভব এমন ম্যাজিক? না, ঠিক ম্যাজিক নয়। তবে হাতসাফাইয়ের খেলা বলতেই পারেন একে। ভূখণ্ড বদলালেই তেলের দামও বদলে যাবে, এমনটা হওয়া তো আর সম্ভব নয়। আসলে পার্থক্য সরকারের কর-ব্যবস্থায়।

ভারত সরকার তার নাগরিকদের কাছে তেলবাবদ যে কর নেয়, তা নেয় না ভুটান সরকার। বরং তারা কোষাগার ভরানোর চিন্তা পাশে সরিয়ে রেখে নাগরিকদের পরিষেবা দেওয়ার ব্যপারেই অনেক বেশি বদ্ধপরিকর। ভুটানের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় এলাকার অনেক বাসিন্দাই এই কারণে পেট্রোল বা ডিজেল কিনতে চলে যান ভুটানের চেকপোস্টে। দু'দেশের মধ্যে সীমান্ত আছে বটে, তবে পাসপোর্ট-ভিসার কাঁটাতার নেই। ফলে অসম-সহ বহু এলাকার বাসিন্দা, গাড়িচালকেরাই এই কাজটি করে থাকেন নিয়মিত।

ভুটানে পেট্রো-পণ্য সরবরাহ করে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড ও ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড। চুক্তি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মূল্যেই ভুটানকে তেল সরবরাহ করতে হয় ভারতকে। পেট্রোল-ডিজেলের উপরে কোনও আবগারি শুল্ক ভুটানের থেকে নেয় না ভারত। তবে নিজের দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে সেসব ছাড়ের প্রশ্ন নেই। বরং পেট্রোল-ডিজেলের উপর চেপে বসে একগুচ্ছ কর। যা যোগের পর রাস্তাঘাটে গাড়ি নিয়ে বেরোতে কালঘাম ছোটে নিত্যযাত্রীদের।

তাতে কোষাগার ভরে। সাধারণ মানুষের করের টাকায় তৈরি হয় সুসজ্জিত সংসদ ভবন। তৈরি হয় সুবিশাল একতার স্ট্যাচু। সারা বছর ধরে পালন করা হয় আজাদির অমৃত মহোৎসব। আর সীমান্তে বসবাসকারী লোকেরা নিজের দেশ ছেড়ে ছোটেন সুখী দেশের পেট্রোলপাম্পে। হিসেব বলছে, অসম সংলগ্ন ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের আশপাশে থাকা পেট্রোলপাম্পগুলি থেকে বড়সড় অঙ্কের শুল্ক ক্ষতি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারে। আরও এক-দু'কিলোমিটার অতিরিক্ত পেট্রোল পুড়িয়ে ভারতীয়েরা চলে যাচ্ছেন প্রতিবেশী দেশে। একটু সস্তায় পেট্রোল বা ডিজেল কিনবেন বলে! এ দিকে সেই পুঁচকে দেশের গোটা পেট্রোপণ্য সরববাহের ভারই কিনা তাঁর নিজের দেশের উপরে। সেই দেশ, সেই সরকার, যা রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটে জিতিয়ে এনেছেন মানুষ। সুনাগরিকের দায়িত্ব মেনে প্রতিবছর যে সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছেন রোজগারের এতগুলো টাকা, নিয়ম করে মেটাচ্ছেন কর! অথচ সেই সরকারই অন্যায় ভাবে করের নামে কোষাগার ভরিয়ে চলেছেন দিনের পর দিন। প্রতিকার নেই। নালিশ ঠোকার দরবার নেই। কারণ, 'চোপ! সরকার চলছে।'

কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, বছর দশেক আগেও কি এতটা আগুন ছিল পেট্রোল-ডিজেল? নাকি ভুটানের মতো দামে এ দেশেও মিলত পেট্রোপণ্য। ইতিহাস বলছে, ২০১২ সালের জুন মাসে দিল্লিতে পেট্রোলের দাম ছিল লিটার প্রতি ৬৫.৬৪ টাকা। বছর দশেকে সেই দাম ছাড়িয়েছে একশোর কোঠা। এর মাঝখানে অবশ্য গঙ্গায় বয়ে গিয়েছে অনেক জল। সরকার বদলেছে। জমানা বদলছে। ২০১৪ সালে ভোটে জিতে প্রথমবার ক্ষমতায় আসে এনডিএ সরকার। প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদী, গুজরাট দাঙ্গার অন্যতম মুখ বলে একদিন পরিচয় ছিল যাঁর। অবশ্য ততদিনে সেইসব দাগ ধুয়েমুছে সাফ। কাগজকলমে তো বটেই, মানুষের মন থেকেও। মহানন্দে শুরু হয়ে গেল হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার কাজ। বাজারে জিনিসের দাম বাড়তে লাগল। পেট্রোল-ডিজেলের দাম ছুঁয়ে ফেলল আকাশ। আর ভরতে লাগল কোষাগার।

তবে এই যে নানা করের চক্করে এই ন'বছরে ফুলেফেঁপে উঠল কেন্দ্রের অর্থাগার, তার কতটা অংশ এই পেট্রোল-ডিজেল থেকে এসেছে ভেবেছেন কখনও? ধরা যাক, এক জন ভারতবাসীর মাসে ১০ লিটার মতো তেল লাগে। ২০১২ সালেও তিনি তেল কিনেছেন লিটার প্রতি ৬৫.৬৪ টাকা করে। অর্থাৎ মাসে তাঁর খরচ হত মোটামুটি ৬৫৭ টাকার কাছাকাছি। আর ২০২৩ সালে তিনি তেল কেনেন লিটার প্রতি ১০৬.০৩ টাকায়। অর্থাৎ গোটা মাসের তেলের জন্য তাঁকে খরচ করতে হয় ১০৬০ টাকার কাছে। অর্থাৎ আজকের দিনে তাঁকে অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে ৪০০ টাকারও কিছু বেশি। হিসেবটা চমকে ওঠার মতো তো বটেই।

আরও পড়ুন: ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাথা! বাহুবলী ব্রিজভূষণের ক্ষমতার আসল উৎস ফাঁস

এবার আসা যাক, আরও একটি হিসেবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভুটানে পেট্রোলের দাম ঘোরাফেরা করছে ৭০ টাকার আশপাশে। আর শহর কলকাতায় পেট্রোলের দাম ঘুরছে ১০৭ টাকার আশপাশে। অর্থাৎ এ দেশের নাগরিকদের প্রতি লিটার পেট্রোলের দামে অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে প্রায় ৩৭ টাকা। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই টাকাটি জমা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের কোষাগারে।

যা দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা বলা শক্ত নয় যে আগামী দিনে উত্তরোত্তর আরও বাড়বে এই ব্যবধান। কোষাগার ভরে উঠবে আরও। সেই টাকায় চলবে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার কাজ। তাতে দেশ সুখীতম হবে কিনা বলা কঠিন। কারণ সুখী দেশ কেবল সবুজ প্রকৃতি বা নীল আকাশের মায়া দিয়ে তৈরি হয় না। সুখী দেশ গড়ে দেয় আদতে সেই দেশের সরকারের নীতি। আসলে দেশকে সুখে রাখার দায়ভার তার রাজার। ঝাঁ চকচকে নয়া সংসদ ভবন কিংবা হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি, এমন কোনও কিছুই  সুখের চুড়ায় নিয়ে যেতে পারে না আসলে দেশকে।

More Articles