৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাথা! বাহুবলী ব্রিজভূষণের ক্ষমতার আসল উৎস ফাঁস

Brij Bhushan Sharan Singh: মাথায় বিজেপির হাত, জ্বালাময় হিন্দুত্ববাদী নেতার লেবেল, কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান হওয়ার ক্ষমতার চেয়েও ব্রিজকে আরও ক্ষমতাশালী করে তুলেছে তাঁর প্রভাবশালী ব্যানার, লোকবল।

গত কয়েক মাস ধরে খবরের শিরোনামে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং। অভিযোগ, দিনের পর দিন পদাধিকারবলে মহিলা কুস্তিগীরদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করে গিয়েছেন ব্রিজভূষণ। করেছেন যৌনহেনস্থা। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে একের পর এক অভিযোগ দায়ের করেছে নির্যাতিতারা। প্রশাসন চুপ। সরকার নির্বিকার। বাধ্য হয়ে পথে নামতে হয় সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগটের মতো একাধিক পদকজয়ী কুস্তিগীরদের। ক্রমে আন্দোলনের রূপ পায় সেই প্রতিবাদ। নতুন সংসদভবন পর্যন্ত পৌঁছয় বিক্ষোভমিছিল। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, নিজেদের পদক গঙ্গায় বিসর্জন দিতে যান কুস্তিগীরেরা। তবে এত কিছুর পরেও ব্রিজভূষণের টিকিটিও ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেনি পুলিশ-প্রশাসন। কারণ ওই একটাই, ব্রিজভূষণের ক্ষমতা। সর্বোপরী রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং জনসমর্থন।

বিজেপির বাহুবলী 'হিন্দুত্বছাপ' নেতা, ছ'বারের সাংসদ, বাররি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম মুখ; এ হেন হেভিওয়েট ব্যক্তির পক্ষেই যে থাকবে আইন-প্রশাসন, তাতে আর আশ্চর্য কী! অযোধ্যার সাধুরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকী ব্রিজের হয়ে আন্দোলন করতেও এক পায়ে প্রস্তুত তাঁরা। সাক্ষীদের আন্দোলন যত জোরালো হয়, কপালে ভাঁজ পড়ে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের। পরিস্থিতি সমালাতে ময়দানে নামেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার একটা বৈঠক সেই আন্দোলনের ঢেউয়ে ভাঁটা আনে। মুখে যতই বলুন সাক্ষীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, তবে সেই জোশ যে কিছুটা হলেও কমেছে, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। ব্রিজভূষণ বহাল তবিয়তে। হবে না-ই বা কেন! রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রশাসনের আশীর্বাদি হাত সবই রয়েছে তাঁর মাথায়। না, শুধু এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক কিছু রয়েছে ব্রিজভূষণের। যা আসলে দিনে দিনে তাঁকে আরও ক্ষমতাশালী করে তুলেছে।

আরও পড়ুন:নতুন সংসদ ভবন হোক বা কুস্তিগীরদের অবজ্ঞা— বিজেপির চাল তবে সফল?

উত্তরপ্রদেশের গোন্দা জেলার বাসিন্দা ব্রিজভূষণ। ছোট থেকে কুস্তি করার অভ্যেস, পরবর্তীকালে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ, এবং অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে জুড়ে বসা হিন্দুত্বের লেবেল, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বাহুবলী ইমেজে হাওয়া দিয়েছে আরও। উত্তরপ্রদেশে ব্রিজভূষণের যে প্রভাব ও জনপ্রিয়তা, তা আদতে কল্পনার বাইরে। তবে ওই যে বললাম, মাথায় বিজেপির হাত, জ্বালাময় হিন্দুত্ববাদী নেতার লেবেল, কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান হওয়ার ক্ষমতার চেয়েও ব্রিজকে আরও ক্ষমতাশালী করে তুলেছে তাঁর প্রভাবশালী ব্যানার, লোকবল। কার্যত গোন্দা জেলায় রাজ চালান ব্রিজভূষণ। ওই এলাকার শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, সব কিছু নিজের পকেটে নিয়ে ঘোরেন তিনি। আর সেই ক্ষমতার জোরই তাঁকে ক্রমাগত করে চলেছে আরও অপ্রতিরোধ্য।

উত্তরপ্রদেশের গোন্দা জেলা ও তার সংলগ্ন এলাকায় ঢুকলে কিংবা অযোধ্যা জেলার আশপাশে অথবা সরযু নদীর পার জুড়ে তাকালেই কোথাও না কোথাও একটি মুখ চোখে পড়বেই। হোর্ডিং, ব্যানার কিংবা দেওয়ালের পোস্টারে একটি নাম দেখতে পাবেনই। হ্যাঁ। সেই নামটা ব্রিজভূষণের। যার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক যৌনহেনস্থার অভিযোগ। যার বিরুদ্ধে কুস্তিগিরদের আন্দোলনে উত্তাল জাতীয় রাজনীতি। শুধু গোন্দাই নয়। গোন্দা, বলরামপুর, বাহরাইচ ও শ্রাবস্তী, অযোধ্য়া-গোন্দা হাইওয়ে সংলগ্ন চারটি জেলাই ব্রিজের সাম্রাজ্য বলা যায়। তবে ব্রিজ-সাম্রাজ্যের রাজধানী গোন্দা জেলার নবাবগঞ্জ এলাকা। আর তা টের পাবেন একটু ভালো করে দেখলেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাসপাতাল, হোটেল থেকে সর্বত্র সেখানে ব্রিজভূষণেরই ছায়া।

হিসেব করে দেখলে কায়সারগঞ্জের সাংসদ ব্রিজভূষণের নাম জড়িয়ে রয়েছে কম করে হলেও ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সরাসরি মালিক ব্রিজভূষণ। সব মিলিয়ে অন্তত ৮০ হাজার পড়ুয়া পড়ে সেই সব প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষক রয়েছেন সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি। রয়েছে কলেজ, হাসপাতাল, হোটেল। স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে স্থানীয় চাষীদের গরু-বাছুর পাইয়ে দেওয়া এমন অনেক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর সঙ্গে সারা বছর জড়িয়ে থাকে ব্রিজভূষণ। আরও একটি অন্যরকম অনুষ্ঠান আয়োজন করেন এলাকায় ব্রিজ। ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম। গোন্দার স্কুল-কলেজগুলিতে চলে সেই ইভেন্ট। বিজয়ীরা মোটরসাইকেল, স্কুটি থেকে শুরু মোটা মোটা অঙ্কের পুরস্কারমূল্য পেয়ে থাকেন। সবটাই আসে ব্রিজভূষণের কোষাগার থেকে। খেলাধুলা সংক্রান্ত অনুষ্ঠান তো লেগেই থাকে বছরভর। রয়েছে শ্যুটিং অ্যাকাডেমি থেকে শুরু করে ন্যাশনাল রেসলিং অ্যাকাডেমির মতো বেশ কয়েকটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান। দশ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে নন্দিনী নগর কলেজ। যেখানে খেলার মাঠ, ব্যাডমিন্টন কোর্ট থেকে শুরু করে সুইমিং পুল, কী নেই! ২০১৮ সালে সেই কলেজ উদ্বোধন করেন স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথ। পাঁচতারা কলেজের যদি কোনও ধারণা থেকে থাকত, নন্দিনী নগর কলেজ হত তার পয়লা নম্বর নিদর্শন। না, এখানেই শেষ নয়, নন্দিনী নগর কলেজ ছাড়াও নবাবগঞ্জে রয়েছে আইন কলেজ, পিজি কলেজ, ফার্মেসি কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজ, নারী শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কলেজ, একশো শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও ট্রমা সেন্টার, নার্সিং ও প্যারামেডিকাল কলেজ-সহ আরও নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এ সবেরই মালিক হয় ব্রিজভূষণ, নয় তাঁর পরিবারের অন্য কোনও সদস্য। এই সব প্রতিষ্ঠানগুলির প্রশাসনিক দায়িত্বও নিজেদের হাতেই রেখেছেন সিং পরিবার।

উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাশালীদের ইতিহাস ভাল করে ঘাঁটলে বুঝবেন, মুষ্টিমেয়, প্রভাবশালীরা যুগে যুগে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছেন সেখানে। কখনও গুন্ডারাজ, তো কখনও যোগীরাজ। ক্ষমতাশালীর পদানত হয়ে থাকার দীর্ঘ রেকর্ড রয়েছে গোবলয়ের এই রাজ্যে। ঠিক সেভাবেই গোন্দা জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে গিয়েছেন ব্রিজভূষণ। আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজভূষণের ক্ষমতার ভাষাকে জোরালো করেছে এই বিপুল জনসমর্থন। শুধু মাত্র অযোধ্যার সাধুদের পাশে দাঁড়ানো নয়। আসলে ব্রিজভূষণ জানেন, তার সঙ্গে আরও কিছু রয়েছে। সারা জীবন ধরে গোন্দা জেলায় যে বিনিয়োগ তিনি করে গিয়েছেন, তার ফলাফল রয়েছে তাঁর পাশে। যা তাঁকে করে তুলেছে আরও বেশি রকম অপ্রতিরোধ্য। রাজনীতি তো আদলে দেনা-পাওনার খেলা। আর বিপুল জনসমর্থনের পরিবর্তে গোন্দাবাসী কী পেয়েছেন? কেন? হিন্দুত্বছাপ মার্কা বাহুবলী এক ক্ষমতাশালীর ছায়া। যার তলায় আপাতভাবে নিশ্চিন্তে থাকেন গোন্দার বাসিন্দারা।

কিন্তু খুব নিশ্চিন্তে কি থাকতে পেরেছেন আসলে? যে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে পদাধিকার বলে নিজের কুস্তি ফেডারেশনের মহিলা কুস্তিগীরদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার, সুযোগ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে, তাঁর স্কুলে বাকি পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ কি খুব সুরক্ষিত? তাঁর হাসপাতাল কিংবা হোটেলগুলিতেও কি মেলে সেই স্বস্তি? প্রশ্ন জাগে। শুধু যৌনহেনস্থার মামলাই নয়। এর আগে একবার সন্ত্রাসযোগে জেলে যেতে হয়েছিল ব্রিজভূষণকে। দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। তবে রামরাজ্যে এসব কোনও বড় কথা নয়। হিন্দুত্ববাদের যে লেবেল তার গায়ে চড়েছে, তার স্পর্শে এ সব পাপ কবেই ধুয়েমুছে গিয়েছে।

আরও পড়ুন: কুস্তিগীরদের নাছোড় আন্দোলন থেকে কেন সরে দাঁড়ালেন সাক্ষী?

ঠিক তেমন ভাবেই ধুয়েমুছে যাবে এসব যৌনহেনস্থার অভিযোগও। ৫৪টি স্কুলের পড়ুয়ারাদের রক্তেও বোনা হয়ে যাবে সেই বীজ। আরও অনেক অনেক ব্রীজভূষণের জন্ম হবে। যার ক্ষমতাবলে, পদাধিকার বলে মেয়েদের অসম্মান করবে, সুযোগ পেলে যৌন হেনস্থা করতেও ছাড়বে না। দরকারে সন্ত্রাসে মদতও দেবে। আর ক্ষমতার চোখরাঙানিতে যাদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না প্রশাসন। বরং আইন-শৃঙ্খলাব্যবস্থা গোঁজা থাকবে তাঁদের পকেটে। এমন আদর্শ রাষ্ট্রেরই তো খোঁজ চলছে আদি অনন্তকাল ধরে! 'আচ্ছে দিন' তবে এসেই গেল, কী বলেন!

More Articles