মলের জৌলুসে ম্লান হয়েও ঐতিহ্যে অটুট নিউ মার্কেট, যে ইতিহাস আজও অনেকের অজানা

ঝাঁ-চকচকে শপিং মলের মাঝে কলকাতার ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকুক নিউ মার্কেট।

ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর আর একমাসও বাকি নেই। সম্প্রতি ইউনেসকো হেরিটেজের তকমা পেয়েছে কলকাতার দুর্গাপুজো। ফলত পুজো নিয়ে মানুষের উন্মাদনা আরও বেশি এ-বছর। আর এই উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের কেনাকাটা। আর কেনাকাটার সঙ্গে সমার্থক হলো কলকাতার 'নিউ মার্কেট'। প্রায় ১৫০ বছর ধরে কলকাতার সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে আছে এই সর্বজনবিদিত জায়গাটি। এশিয়ার তৃতীয় সবচেয়ে বড় ‘ওপেন এয়ার’ মার্কেট হলো এই নিউমার্কেট। কাজেই জায়গাটিকে শুধুমাত্র বাজারের তকমা দিলে কলকাতার ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে উপেক্ষা করা হবে। লিন্ডসে স্ট্রিটের এই স্থানটিতে সাতরকম রং আর পাঁচমিশেলি বিস্ময়ের পসরা বসে প্রতিদিন। এখানে বারো মাস মানুষের জমজমাট ভিড়ে কান পাতলে অতীতের ফিসফাস শোনা যায়। আর পুজোর সময় কেনাকাটার জন্য মানুষের ভিড় উপচে পড়ে নিউ মার্কেটের আনাচ-কানাচে। সরু সরু গলিতে ঢালাও পণ্যের অবাক বহরে, হাজার হাজার দোকানের সমাহারে, এই সুবিন্যস্ত এবং শশব্যস্ত বিপণি কেন্দ্র কলকাতার বুকে এক মজার ভুলভুলাইয়া।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শহরে এত বাজার থাকতে একেই হঠাৎ ‘নিউ মার্কেট’ নাম দিয়ে এমন তোল্লাই দেওয়া হলো কেন? আর কেনই বা এমন জায়গাকে ‘হগ মার্কেট’ বলে অভিহিত করা হয়? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই উনিশ শতকের কলকাতায়। ১৮৫৯ সাল। স্টুয়ার্ট হগ নামক এক ব্রিটিশ ভারতে তথা বাংলায় আসেন বর্ধমানের কালেক্টর হয়ে। সেখানে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সুষ্ঠু ত্রাণের ব্যবস্থা করে তিনি মানুষের মধ্যে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই হগ সাহেবই ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও কমিশনার অফ পুলিশ পদে আসীন হয়ে আসেন। তাঁকেই শহর কলকাতার প্রথম রূপকার বলা যেতে পারে। কলকাতার বুকে পানীয় জলের সুব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ প​য়ঃপ্রণালী ও রাস্তায় শহুরে আলোর রূপায়ণ তাঁর হাত ধরেই হ​য়। তাঁর উদ্যোগেই ১৮৭৪ সালে এই বাজারটি প্রতিষ্ঠিত হয়, এটিই প্রথম কলকাতার মিউনিসিপ্যাল মার্কেট।

১৯০৩ সালে স্যর স্টুয়ার্ট হগের নাম অনুসারে এই বাজারটির নাম রাখা হয় হগ মার্কেট। এখানকার লোকেরা বলে, হগ সাহেবের বাজার। শপিং মলগুলো অবশ্য হালে হয়েছে। এই বাজারে দুই হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে। রসিকতা করে অনেকে বলেন, বাঘের দুধ, জলহস্তীর মাংসও নাকি চাইলে নিউ মার্কেটে মেলে (সত‍্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' ছবির সংলাপ)। নিউ মার্কেটের একটি খুব আকর্ষণীয় ইতিহাস আছে। সেসময় কলকাতার ইংরেজ কোয়ার্টারগুলি ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ছিল। তাই সেখানকার ইংরেজ বাসিন্দারা টেরেটি বাজার এবং লালবাজারে কেনাকাটার জন্য যেতেন। ধীরে ধীরে আরও ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন। কাঁসাইটোলা, ধর্মতলা ও চৌরঙ্গিতে নতুন বসতি গড়ে ওঠে ব্রিটিশদের।

আরও পড়ুন: মনে হবে সময় পিছিয়ে গেছে কয়েক শতাব্দী, কলকাতার মধ্যে আজও লুকিয়ে সেই ‘গ্রে টাউন’

১৮৭১ সালে কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজদের জন্য তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশন একটি 'অল হোয়াইট' মার্কেট নির্মাণের প্রস্তাব পেশ করে। অর্থাৎ, এমন একটি বাজার তৈরি করার প্রস্তাব ছিল, যাতে শুধুমাত্র কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশরা ঢুকতে পারবে। এর জন্য একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়। এরপর তড়িঘড়ি কর্পোরেশন লিন্ডসে স্ট্রিট কিনে নেয়। আগে এখানে ফেনউইক বাজার নামে একটি জরাজীর্ণ পুরনো বাজার ছিল। পুরনো বাজারটি ভেঙে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির একজন স্থপতি রিচার্ড রোস্কেল বেইনকে নতুন বাজারের প্ল্যান করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। মার্কেট কমপ্লেক্স নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ম্যাকিনটোস কোম্পানিকে। ক্রমে পুরনো ফেনউইক বাজার ভেঙে ফেলে গড়ে উঠল ‘নিউ মার্কেট’। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজি, ফল, ফুল, মাংস, ষ্টেশনারি বইপত্র থেকে পোশাক, জুতো, ব্যাগ, উপহারসামগ্রী- সমস্তকিছুই পাওয়া যাবে এক ছাদের নিচে। কোনও কারণেই আর নেটিভ ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে গা ঠেলাঠেলি করে বাজার করতে হবে না কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের। ‘ভিক্টোরিয়ান গথিক মার্কেট কমপ্লেক্স’, নিউ মার্কেটের পোশাকি নাম। ১৮৭৪ সালে মার্কেটটি খুলে দেওয়া হলো ক্রেতাদের জন্য, বিশেষত কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিক আর কলকাতার বন্দরে আসা বিদেশি পর্যটকদের জন্য।

আপনি যদি এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসেন, দেখতে পাবেন চারপাশে সারিবদ্ধ রাস্তার দোকানগুলি। শুধু লাইনগুলি অনুসরণ করুন এবং দেখবেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি ব্যস্ত নিউ মার্কেটের মধ্যে পৌঁছে গেছেন, মিশে গেছেন মানুষের ভিড়ে। শপিং মল থেকে শুরু করে রাস্তার দোকান থেকে ক্লাসি রেস্তোরাঁ থেকে স্ট্রিট ফুড স্টল পর্যন্ত আপনার প্রয়োজনীয় সব ধরনের দোকানই মার্কেটে রয়েছে।

নিউ মার্কেটে সেরা খাওয়ার জায়গা
আপনি যদি নিউ মার্কেটে থাকেন, তাহলে আপনি নাহৌম অ্যান্ড সনস মিস করবেন না। ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দোকানটি শহরের সকলের। এমনকী, এখানে ফুচকা, ঝালমুড়ি, ঘুগনি, ছোলে ভাটুরে, আলু চাট, জুস এবং আরও অনেককিছুরই স্বাদ গ্রহণ করা যেতে পারে। মার্কেটের ভেতরের রেস্তোরাঁগুলিতে কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত রোল 'নিজাম'-এ খেতে পারবেন। শহরের সেরা বিরিয়ানির স্বাদ নিতে, আপনি আমিনিয়া থেকে বিরিয়ানির খেতে পারেন। এখানে আরও অনেক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেমন দ্য স্কুপ, জিমি'স কিচেন কাম বার, বান থাই, আহেলি এবং আরও অনেক কিছু।

কী কী পাওয়া যায় এই বাজারে ?
জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের মতো সব জিনিসই এই বাজারে পেয়ে যাবেন ন্যায্য দামে। জুতো, জামা, শাড়ি, খেলনা, খাবার, ঘর সাজানোর জিনিস, মশলাপাতি, আসল এবং নকল গয়না- সব পাবেন এখানে। গরমকালে শীতের পোশাক এবং শীতকালে গরমের পোশাক, যা চান সব পাবেন এই প্রাচীন বাজারে। বাজারের ভেতরের পসরার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটপাথে জিনিস বিক্রি হয়। মোটামুটি সকাল ৯-১০টা থেকে রাত ৮-৯টা পর্যন্ত বাজার খোলা থাকে।

এছাড়াও আরও অসংখ্য দোকান ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে নিউ মার্কেটে। কী পাওয়া যায় না নিউ মার্কেটে? কিন্তু বর্তমান ঝাঁ চকচকে শপিং মলগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে নিউ মার্কেট, তা স্বীকারও করছেন দোকানের মালিকরা। সেদিনের মতো সেরকম বাজারও এখন আর নেই। গাড়ি পার্কিংয়ের অসুবিধের জন্য অনেকে মুখ ফিরিয়েছেন নিউ মার্কেট থেকে। লাইট হাউজ, এলিট, গ্লোব-এর মতো সিনেমা হলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিউ মার্কেট চত্বরের জৌলুস কিছুটা হলেও কমেছে। 'রিগাল' কোনও মতে টিকে আছে এখনও। তবে হগ সাহেবের মার্কেট বা নিউ মার্কেটে ঢুকলে, যে কারও মনে হতে বাধ্য, ঝাঁ-চকচকে শপিং মলের মাঝে কলকাতার ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকুক নিউ মার্কেট, আর নিউ মার্কেটকে নিয়ে বেঁচে থাকুক বাঙালি।

More Articles