মনে হবে সময় পিছিয়ে গেছে কয়েক শতাব্দী, কলকাতার মধ্যে আজও লুকিয়ে সেই 'গ্রে টাউন'

বর্তমানে ইহুদি সম্প্রদায়ের হাতে গোনা মানুষ কলকাতায় বসবাস করে। সাধারণ মানুষের কাছে বর্তমান কলকাতায় ইহুদিদের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে পরিচিত প্রতিষ্ঠান একটি দোকান। ধর্মতলার 'নাহুমস' আজও হাসিমুখে কলকাতার মানুষকে বিভিন্ন রকমের কেক...

ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতায় বসবাসকারীদের গায়ের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে কলকাতাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এই ভাগ খাতায়-কলমে খুব বেশি লক্ষণীয় না হলেও সেই সময়ের মানুষের মনে এই বিভাজন পরিষ্কার হরফে ছাপা হয়েছিল। কলকাতায় ব্রিটিশরা যেই অঞ্চলে বসবাস করত, সেই এলাকাকে তারা বলত হোয়াইট টাউন। ভারতীয়দের বসবাসের এলাকাগুলোকে তারা বলত ব্ল্যাক টাউন। এই পরিস্থিতিতে কলকাতায় বহু মানুষ ছিল, যারা ব্রিটিশ এবং ভারতীয় কোনওটাই ছিল না। তারা এই দুই ধরনের মানুষের বসবাসের এলাকার সীমানায় বসবাস করত। ভারতীয় এবং ব্রিটিশ, উভয়ের বেশিরভাগই তাদের সমগোত্রীয় বলে খুব একটা মনে করত না। ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের দেখাদেখি তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের বসবাসের এলাকাকে গ্রে টাউন হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করেছিল। কলকাতার ইতিহাসের বহু অধ্যায়ের সঙ্গে এই মানুষগুলো জড়িত ছিল। বর্তমান কলকাতায় তাদের সঙ্গে জড়িত বহু প্রতিষ্ঠান এবং এলাকা রয়েছে। যদিও তাদের বেশিরভাগ গল্প আমরা জানি না।

ব্রিটিশ শাসনের বহু পূর্বে কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিল আর্মেনিয়ানরা। তারা পশ্চিম এশিয়ার আর্মেনিয়া দেশের অধিবাসী ছিল। তারা মূলত বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে প্রচুর ধনসম্পত্তি এবং প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল। কথিত আছে যে, তাদের বহু ব্যবসার মধ্যে অন্যতম ছিল সুদে টাকা ধার দেওয়া। এই টাকা ধার দেওয়ার সূত্রে সমাজের উঁচু মহলে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা বিভিন্ন জনহিতকর কাজের জন্য অর্থ ব্যয় করেছিল। মানভেল হাজার মালিয়া নামে এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী কলকাতায় নদীর তীরে একটি ঘাট নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই ঘাটের নাম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে হয়ে যায় আর্মেনিয়ান ঘাট। আর্মেনিয়ানদের চার্চ সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে পুরনো চার্চ। কথিত আছে যে, প্রথম চার্চটি অগ্নিকাণ্ডের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেটার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। এই চার্চের চৌহদ্দির ভেতরের একটি কবরখানা রয়েছে। সেই কবরখানার একটি কবর রেজা বিবি সুকিয়ার। কবরের ফলকে মৃত্যুসাল হিসেবে লেখা রয়েছে ১৬৩০। ইংরেজদের পূর্বে যে কলকাতায় আর্মেনিয়ানরা থাকতে শুরু করেছিল, তার প্রমাণ এই কবর। বর্তমানে ভারতে খুব কম সংখ্যক আর্মেনিয়ান বসবাস করেন এবং তারা বেশিরভাগ কলকাতায় থাকেন। নিজেদের রীতি-নীতির সঙ্গে কলকাতাকে তারা নিজের মনে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।

আঠারো শতকের শেষদিকে কলকাতায় ইহুদিদের আগমন শুরু হয়। এই ইহুদিরা কলকাতায় আগমনের পূর্বে প্রধানত বাগদাদ এবং আলেপ্পোতে বসবাস করতেন। ১৭৯৮ সালে কলকাতায় এসেছিলেন সালোম আহেরন ওবেডায়া কোহেন। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর দেখাদেখি বহু ইহুদি ব্যবসায়ী কলকাতায় এসে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁরা কলকাতায় পড়াশুনার জন্য স্কুল, নিজেদের উপাসনালয় এবং কবরখানা তৈরি করেছিলেন। আজও ফুলবাগানের কাছে ইহুদি কবরখানা রয়েছে। ইহুদিরা তাদের পেশা শুধু ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি । ভারতের প্রথম মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার বিজয়ী ছিলেন এক ইহুদি। পেশায় তিনি অভিনেত্রী ছিলেন। মানুষের কাছে তিনি 'প্রমীলা' নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল এসথার ভিক্টোরিয়া আব্রাহাম।

আরও পড়ুন: কলকাতা থেকে দু’পা, এখনও জেগে আছে যে দিনেমার বাংলা

মধ্য কলকাতার এজরা স্ট্রিট নিজের নাম আসলে এক ইহুদির নাম থেকেই পেয়েছিল। ডেভিড জোসেফ এজরা প্রধানত নীল, সুতো এবং অফিমের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। সেই উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের জন্য জমি এবং বাড়ি কিনেই ক্ষান্ত হননি। স্কুল, হাসপাতাল, ইহুদি এবং পার্সিদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন।

বর্তমানে ইহুদি সম্প্রদায়ের হাতে গোনা মানুষ কলকাতায় বসবাস করে। সাধারণ মানুষের কাছে বর্তমান কলকাতায় ইহুদিদের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে পরিচিত প্রতিষ্ঠান একটি দোকান। ধর্মতলার 'নাহুমস' আজও হাসিমুখে কলকাতার মানুষকে বিভিন্ন রকমের কেক পরিবেশন করে চলেছে।

৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেই পার্সিরা ভারতে এসেছিল। বহু শতক পরে তারা সুরাটে আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। সেই ব্যবসার সূত্রেই সম্ভবত কলকাতায় তাদের আগমন ঘটেছিল। কলকাতায় এসে শুধু আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে তাদের ব্যবসা সীমাবদ্ধ না রেখে তারা অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে তারা। ক্রমে ক্রমে ব্যবসা, জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্যেও ছিল তারা, তারা পার্সিদের জন্য উপাসনালয় এবং অন্তিম যাত্রার জন্য টাওয়ার অফ সাইলেন্স নির্মাণ করেছিল। ১৯০৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ক্যালকাটা পার্সি ক্লাব। ১৯০৯ সালে মানেকজি রুস্তমজি ধর্মশালার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বো ব্যারাকের কাছে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল, পার্সি যাত্রীদের বিশ্রামস্থল প্রদান এবং সাধারণ মানুষের কাছে পার্সি খাবারের স্বাদ পৌঁছে দেওয়া। বর্তমানে কলকাতায় পার্সিদের জনসংখ্যা খুবই কমে গিয়েছে। তাদের তৈরি টাওয়ার অফ সাইলেন্স, উপাসনালয় এবং রেস্তোরাঁ আজও কলকাতার বুকে রয়ে গিয়েছে।

More Articles