৭৭ বছর ধরে নতুন-পুরনো কলমের অসুখ সারাচ্ছে ধর্মতলার এই পেন হাসপাতাল

Pen Hospital: এই দোকানের জন্ম দেশ স্বাধীনেরও আগে। ১৯৪৫ সালে ইমতিয়াজের দাদুর হাত ধরে তৈরি হয়ে এই পেন হাসপাতাল।

কথায় আছে “কালি কলম মন, লেখে তিনজন”। এই তিন মূর্তির ত্রিবেণী একত্রে ফুটে ওঠে লেখায়। লেখক নিজের প্রবল কল্পনাশক্তি, আবেগ, দুঃখ, যন্ত্রণা, ভালবাসাকে বাস্তব-পরাবাস্তবের ছবি দিয়ে সাজান নিজের লেখাকে৷ এই ত্রিবেণী সঙ্গমে তিনজনের ভূমিকাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি তিনজনের মধ্যে কোনও একজনের তাল কেটে যায়, অথবা অকেজো হয়ে যায় তাহলেই গল্প শেষ! পুরোটাই ঝাপসা, পুরো খাটনি বিফলে৷ একজন লেখকের কাছে তাঁর পেন বা কলম নামক বস্তুটি বড় আবেগের। আবার ক্ষেত্রবিশেষে কলমই তাঁদের প্রধান অস্ত্র৷ আমরা সকলেই সাধারণত আমাদের পেন বা কলম খারাপ হয়ে গেলে, বার তার কালি শেষ হয়ে গেলে পেন ফেলে দিই৷ কিন্তু, আমরা হয়তো কখনও ভেবে দেখিনি, আসলে নষ্ট বা বিকল কথাটি বড়ই আপেক্ষিক৷ তাই নষ্ট পেন বা কলমেও পুনরায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সেই কাজের মধ্যেও একটা বাড়তি আনন্দ, উদ্দীপনা উপভোগ করতে পারে কলম প্রেমীরা৷ প্রাণের শহর কলকাতাতেই এমন একটি দোকান এবং কারিগর রয়েছেন যাঁর হাত ধরে বহু দুষ্প্রাপ্য কলম নিজেদের যৌবন ফিরে পেয়েছে।

এই ঠিকানায় যাওয়ার রাস্তাও বেশ সোজা। ধর্মতলা মেট্রো স্টেশনের চার নম্বর গেট, সেখান থেকে বেরিয়ে ঠিক বাঁদিকে একটি গলি। সেই গলির মধ্যে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে পেন হাসপাতাল৷ শুনতে খানিক অবাক লাগলেও বাস্তবে পেনের হাসপাতালই বটে! সেখানেই বসেন ইমতিয়াজ। মধ্যবয়স্ক এই মানুষটির অগোছালো দোকানঘরেই লুকিয়ে রয়েছে পেন বা কলমের জিয়ন কাঠি৷ জানা যায়, এই দোকানের জন্ম দেশ স্বাধীনেরও আগে। ১৯৪৫ সালে ইমতিয়াজের দাদুর হাত ধরে তৈরি হয়ে এই পেন হাসপাতাল। সেই থেকে আজ অবধি শহরের বুকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেনদের এই ডাক্তারখানা৷

আজ থেকে কয়েক দশক আগের কথা, সেই সময় বিদেশ থেকে আসত ওয়াটারম্যান, শেফার্ড, পিয়ার কারদা, উইলসনের মতো পেন, তাদের নামের বিভিন্নতার পাশাপশি প্রতিটি পেনের গঠনও বিভিন্ন৷ ফলে বলাইবাহুল্য পেনের প্রতি লেখকের আবেগ অনুভূতি ছিল ভিন্ন প্রকারের৷ তাই কলমপ্রেমীদের দুঃখ আরও লাঘব করাতে তৈরি হলো কলমের এই হাসপাতাল৷

আরও পড়ুন- আজীবন ঝর্না কলমের চরম বিরোধী মহাত্মা গান্ধী, যে কথা মনে রাখেনি কেউ

সাতাত্তর বছরের পুরনো এই দোকানের গায়ে ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে৷ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নামজাদা অধ্যাপক, লেখকের আনাগোনা এই দোকানে। সকলেই তাঁদের পেনের অসুখ সারাতে বারবার ছুটে আসেন এই পেন হাসপাতালে৷ বর্তমান সময়ে ডট পেনে লেখাই দস্তুর কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ফাউনটেন পেন নিয়ে আবেগের স্রোত চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত৷

এই দোকানের তেমনই এক খদ্দের হলেন অমৃতা ঘোষ। তিনি জানান, ফাউনটেন পেন নিয়ে আবেগ ধরে রাখা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ নতুনদের কাছে৷ তাঁর সংগ্রহে অনেকগুলো দেশি-বিদেশি পেন রয়েছে৷ তবে এখন তিনি ডট পেনেই লেখেন৷ তবে এই পেনের সঙ্গে নিব পেনের কোনও তুলনা নেই, নিব পেনে লেখার আনন্দই আলাদা৷ তাই পেন খারাপ হলেই ছুটে আসতেন এই পেন হাসপাতালে। অমৃতার বাবা পেশায় একজন অধ্যাপক৷ তিনি আবার ফাউনটেন পেন ছাড়া লিখতে পারেন না৷ তাঁর বাড়িতে দেশি-বিদেশি কলমের তাবড় তাবড় সংগ্রহ রয়েছে৷ পারিবারিক সূত্রে তাঁর নিজের কাছেই রয়েছে এই অমূল্য সম্পদ৷ এই পেনগুলির প্রতি তাঁর ভালবাসা যে একেবারেই অন্য মাত্রার তা স্বীকার করেন তিনি৷

নিজের সংগ্রহ থেকে গোটা তিনেক পেন সারাতে নিয়ে এসেছিলেন এই হাসপাতালে৷ দেড় হাজার টাকা মজুরি দিয়ে পেন সারিয়ে নিয়ে গেলেন লেখক৷ নষ্ট হয়ে যাওয়া পেন কার্যত প্রাণ ফিরে পায় ইমতিয়াজের হাতের জাদুতে। কারিগর ইমতিয়াজের কথায়, “আমি রিপন স্ট্রিটে থাকি৷ বাপ-ঠাকুরদার আমলের দোকান৷ ওয়াটারম্যান, পিয়ার কারদা, মঁ ব্ল, উইলসন আগে এই দেশে নিয়মিত আসত৷ এই দেশের ঝর্না কলম যথেষ্ট ভাল ছিল৷ এখন যেসব পেন আসে এখানে তার যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন ৷ আবার কিছু ক্ষেত্রে কালি ভরার পদ্ধতি বা টেকনিক বদল করে দিচ্ছি ৷ পেনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে সবাই৷ আমি চেষ্টা করি মাত্র।”

আরও পড়ুন- বোতামে আলতো চাপ, এক মিনিটে যন্ত্রণাহীন আত্মহত্যা, সাহায্য করবে এই স্টাইলিশ যন্ত্র

তবে এখনকার দিনে নিব পেন ব্যবহার করা বড়ই অসুবিধা, কালি সেভাবে সহজে পাওয়া যায় না তেমন৷ পেন হাসপাতালে চারটি পেনের কালি ভরতে এসেছিলেন রাতুল দাস। নিব পেন ছাড়া তিনি লিখতেই পারেন না। তিনি জানান, কালি পাওয়া শক্ত হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়৷ তিনি নিজেই কালির জন্য সুলেখার কারখানাতে পর্যন্ত যেতে পিছ পা হননি৷

বিদেশি পেন মানেই অনেকের কাছে মহার্ঘ৷ বিষয়টি অস্বীকার করছেন না ইমতিয়াজও৷ “দশ বারো হাজার টাকা দামের পেন এখনও আসে৷ পেনের নিব থেকে কালি ভরার ব্যবস্থা প্রতিটি পেনের আলাদা৷ সবসময় যে সবকিছু সহজে মেলে তা নয়৷ আবার পুরোনো ধরনের পেনের ক্ষেত্রে টেকনোলজি বদলে দিই৷ পেনগুলো জীবন পায়, লেখকের মুখে হাসি ফোটে,” বলেন কলমের ডাক্তার ইমতিয়াজ। তাই এই শহরে কলমাস্ত্রকে আর আবেগকে বাঁচিয়ে তোলার একমাত্র ঠিকানা ধর্মতলার পেন হাসপাতাল৷

More Articles