দুটো-চারটে নয়, হাজারটা হাত রয়েছে দেবীর! কেন দক্ষিণ ভারতেও এত জনপ্রিয় বাংলার এই কালী?
Hajar Haath Kali : দেবীর অস্ত্র ও মুকুট, এমনকী মাথার ছাতা সবই রুপোর তৈরি, অবাক করবে হাওড়ার হাজার হাত কালীর রহস্য
কালীকে কলকাত্তায়ালী বললে যে বিশেষ ভুল হয় না তা অবশ্য সকলেই কমবেশি জানেন। কালী প্রসঙ্গে আলোচনা উঠলে বারবার কলকাতা শহরের নাম যেন চলেই আসে। তবে, সারা বাংলা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন বেশ কিছু কালীর রহস্য যা আজও অবাক করে। সেই ইতিহাস শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। দেবীর রুদ্র মূর্তির ব্যাখ্যা মেলে বিভিন্ন প্রকারে। কলকাতার কালী বলতেই প্রথমে মাথায় আসে, কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর অথবা ঠনঠনিয়ার প্রসঙ্গ। কিন্তু ভক্তি এবং ভক্তের জোর ছড়িয়ে গিয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলা শহরেও। প্রচলিত কালী রূপের ধারণা বারবার ভেঙেচুরে যায় সেখানে।
দেবীর রুদ্র রূপ, বিবসনা, চার হাত, হাতে রয়েছে অস্ত্র এবং কাটা মুন্ড। এই রূপেই তিনি স্বয়ং শিবের বুকের ওপর দন্ডায়মান, এবং জিভ কাটা। তবে এই রূপের আধার কোনও ধ্রুবক যে নয়, তা অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় বোঝা যায়। কখনও দেবী ধরা দেন শান্ত মূর্তিতে, কখনও আবার হাতের সংখ্যা কমে দুই অথবা বেড়ে আট হয়ে যায়। তবে আজ যে কালীর প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে তাঁর কিন্তু একটা দুটো নয়, মোট হাজারখানা হাত রয়েছে।
আরও পড়ুন - বিশ্বাসে মিলায় চাকরি? মন্দার বাজারেও নাকি ষোলো আনা মানতেই চাকরি দেয় এই ‘সার্ভিস কালী’!
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, হাজার হাতেই আত্মপ্রকাশ বাংলার এই কালী মূর্তির। কথিত আছে, অসুর নিধনের সময় মা দুর্গা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছিলেন। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর শ্লোকে বর্ণনা রয়েছে সহস্ত্র হাত দেবীমূর্তির। যে মূর্তির বিশালাকার রূপ দেখে স্বয়ং মহিষাসুর চমকে উঠেছিলেন এবং তাঁর হাতে বধ হয়েছিলেন। দেবীর এই রুপটিই হাজার হাত কালী নামে পরিচিত। হাওড়ার শিবপুরের ওলাবিবিতলায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হয়ে আসছে এই হাজার হাতের মা কালীর পুজো।
সময়টা ১৮৭০ সাল। শিবপুরের ওলাবিবিতলার মুখোপাধ্যায় বাড়ির ছেলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মা চন্ডীর স্বপ্নাদেশে কালির ওই রূপটি দেখতে পান।কলকাতার চোরবাগানের তান্ত্রিক মতে কিছু পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। তবে স্বপ্নে যে জায়গায়ই দেখেন তা অবশ্য হাওড়ায়। তবে দেবীর ওই বিশাল রূপ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা ছিল না তাঁর তখন। অবশেষে স্থানীয় হালদার পরিবার পাশে এসে দাঁড়ায়। হালদারদের থেকে মাত্র ১২৫ টাকায় তিন কাঠা জমি তিনি কেনেন তিনি। এরপর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজার হাত কালী মায়ের মূর্তি। মন্দির নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হতে লেগেছিল প্রায় দশ বছর। ১৮৮০ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
আরও পড়ুন - শিব নয়, পায়ের নীচে থাকে অসুর, সিংহ! চমকে দেবে ৩০০ বছরের পুরনো বাংলার এই কালীর রহস্য
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় মন্দিরের আশেপাশের এলাকা জঙ্গলাবৃত্ত থাকায় এই মন্দিরে পুজো দিয়ে যেতেন ডাকাত ও দস্যুরা। তবে সময়ের সঙ্গে সেই ইতিহাস ম্লান হয়ে গিয়েছে। ডাকাতদের উৎপাত কমতেই দেবী সাধারণ মানুষের আরাধ্য হয়ে উঠেছেন। শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে, কৃষ্ণা সুব্রহ্মণ্যম নামে এখানকার এক দক্ষিণ ভারতীয় ভক্ত অন্ধ হয়ে যান, দ্বারস্থ হন দেবীর। ওই যে ভক্তির জোর, আর সেই জোরেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি দক্ষিণ ভারতে বাংলার এই দেবীর প্রচার চালানো শুরু করেছেন। যার জেরে এখন এই মন্দিরের প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় ভক্ত। তাঁরা শ্রাবণ মাসে শুক্লপক্ষের শুক্রবারে দক্ষিণ ভারত থেকে এই মন্দিরে এসে দেবীর পুজো দিয়ে থাকেন অনেকেই।
হাজার হাত কালীর মূল বৈশিষ্ট্য হল, আজ বলে নয় কোনওদিনই এখানে বলির প্রথা ছিল না। এখানকার দেবীর অস্ত্র ও মুকুট তৈরি হয়েছে ১২ কেজি রুপো দিয়ে। এছাড়াও রুপো দিয়ে তৈরি হয়েছে দেবীর মাথার ছাতা। চণ্ডীপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, কুমোরটুলির শিল্পী প্রিয়নাথ পাল তৈরি করে দেন দেবীর এই হাজার হাত। দেবী নীলবর্ণা, মহাদেব নয় সিংহের ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এখানে প্রতিদিন সকাল ৬টা ৩০, দুপুর ২টো এবং রাত ৮টা ৩০-এ পুজো হয়। দেবীর নৈবেদ্যতে থাকে মাছ, ভাত, ফল-মিষ্টি। রাতের আরতির পর হয় প্রসাদ বিতরণ।এখনও হাওড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরাই দেবীর সেবার কাজ করেন।