চরম বিপদের দিনের বন্ধু, তুরস্কের ভূমিকম্পের উদ্ধারকাজে যেভাবে ঝাঁপাল 'দোস্ত' ভারত
Turkey Earthquake 'Operation Dost' India : মৃত্যুমিছিলের সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা বিশ্ব। সেখানেই এক টুকরো আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছে ভারত।
বেশ কয়েকদিন হল সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বিশেষ ছবি সবার নজর কেড়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতের এক মহিলা সেনা আধিকারিককে জড়িয়ে ধরে আছেন অন্য এক মহিলা। ছলছল করছে তাঁর চোখ। কোনও কিছু না ভেবে ওই মহিলাটি, সেনা আধিকারিককের মুখে চুম্বন আঁকলেন। এই চুম্বন ভালোবাসার তো বটেই; তবে সামান্য নিক্তিতে একে মাপা যাবে না। মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেও ওই মহিলা ভাবতে পারেননি যে, তিনি বেঁচে থাকবেন। ভয়ংকর ভূমিকম্প এসে সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে ঘরবাড়ি। কিন্তু দিনের শেষে তিনি বেঁচে রয়েছেন। ওই ভারতীয় সেনাদের জন্যই বেঁচে আছেন! সেই বিস্তর লড়াই, ভয়াবহতা, কান্না আর প্রাণ ফিরে পাওয়ার গল্পই লেগে আছে ওই একটি ছবিতে।
এরকম অজস্র ছবি বিগত কয়েকদিন ধরে নেট দুনিয়ায় ঘুরছে। প্রতিটা ছবির পিছনেই জুড়ে আছে একের পর এক গল্প। রয়েছে এক বন্দুত্বের মন্ত্রও। নিজের দেশ থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে, ‘বন্ধু’র বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আরেক ‘দোস্ত’। হাতে হাত লাগিয়ে, দিনরাত এক করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তুরস্কের ভয়ংকর ভূমিকম্প (Turkey Earthquake 2023) ঘিরে অজস্র কান্না, হাহাকার। মৃত্যুমিছিলের সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা বিশ্ব। সেখানেই এক টুকরো আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছে ভারত। সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে উদ্ধারের কাজে। NDRF, সেনা জওয়ান, সবাই হাত লাগাচ্ছে কাজে। শুরু হয়েছে ‘অপারেশন দোস্ত’ (Operation Dost)।
আরও পড়ুন : তিনদিন ধরে ধ্বংসস্তূপে আটকে একরত্তি শিশু! তারপর? যে অলৌকিক কাণ্ড ঘটাল ভারতীয় কুকুর
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর সোয়া চারটে নাগাদ প্রথম ভূমিকম্পটি হয়। ভোররাতে ৭.৮ মাত্রার এই কম্পন হওয়ায় অনেকেই ঘর থেকে বেরনোর সময় পাননি। তারপর আরও বেশ কয়েকবার কেঁপেছে তুরস্ক। গাজিয়ানতেপ ও তার আশেপাশের অনেকগুলি এলাকায় তীব্রতা বেশি থাকে। সিরিয়া, লেবানন, গ্রিস, সাইপ্রাসেও সেই প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার বাড়ি চোখের নিমেষে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে যায়। লোহা-লক্কর, কংক্রিট, গাড়ি ও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন অজস্র মানুষ। ইতিমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ৩৭,০০০-এর গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ রাষ্ট্রপুঞ্জ।
এত মানুষ মৃত, আহত আরও বেশি। যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ কি জীবিত এখনও? এরকম নানা প্রশ্নের ভিড় সামনে আসছে। তবে তুরস্কের এই বিপদে সবার আগে যে এগিয়ে এল, সে ভারত। এই মুহূর্তে তুরস্কের জনজীবন কার্যত বিপর্যস্ত। হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। সেই সময়ই শুরু হল ভারতের ‘অপারেশন দোস্ত’। কথায় বলে, চরম বিপদের দিনে যে এগিয়ে আসে, পাশে দাঁড়ায়, সবরকমভাবে সাহায্য করে, ভরসা দেয়, সে-ই আসল বন্ধু। সেই মন্ত্রটিকে আঁকড়ে ধরেই মাঠে নামল ভারত। টুইটারে ট্রেন্ডিং হয়ে গেল #OperationDost। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ – প্রত্যেকেই টুইট করে অভিবাদন জানিয়েছে ভারতীয় সেনা, NDRF ও মেডিক্যাল টিমকে।
Indian @NDRFHQ teams have now reached Gaziantep and commenced search and rescue operations.
— Dr. S. Jaishankar (@DrSJaishankar) February 8, 2023
Wish them the very best in their efforts.
#OperationDost pic.twitter.com/SG9JCvQWuU
এখনও অবধি মোট সাতটি বিমান তুরস্কে পাঠিয়েছে ভারত। প্রতিটিতেই ছিলেন NDRF কর্মী, সেনা জওয়ান, ৬০ প্যারাস্যুট ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ইউনিটের সদস্যরা। সঙ্গে ছিল কম্বল, জামাকাপড়, শুকনো খাবার সহ অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী। পাশাপাশি ছিল অত্যাধুনিক চিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জাম। সেখানে ছিল ভেন্টিলেটর, অ্যানাস্থেশিয়া যন্ত্র সহ বিভিন্ন ওষুধও। তুরস্কের বুকেই খোলা হয় ভারতীয় সেনার অস্থায়ী শিবির। খোলা হয় সেনার বিশেষ হাসপাতাল। কেবল সেনাই নয়, NDRF-এর ছয় সারমেয়ও উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন : ভূমিকম্পের ১২৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার দু’মাসের শিশু! যে ঘটনায় অবাক উদ্ধারকারীরাও
ফলাফল? চিকিৎসার কাজে গতি তো আসেই, উদ্ধারকাজেও একের পর এক অসাধ্য সাধন করতে থাকে ভারতীয় সেনা। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করে ছয় বছরের ফুটফুটে একটি মেয়েকে। NDRF কর্মী এবং দুটি কুকুরের জন্যই তার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। আট থেকে আশি – অজস্র মানুষের আশা ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে NDRF ও ভারত। তুরস্ক প্রশাসন তো বটেই, সেখানকার বাসিন্দারাও ছলছল চোখে জড়িয়ে ধরছেন ভারতীয় সেনাদের। গোটা বিশ্ব কার্যত মুগ্ধ এমন পরিস্থিতি দেখে।
মৃতের সংখ্যা আরও কত বাড়বে, জানা নেই। তুরস্কের এই বিশেষ জায়গাটি এমনিতেই ভূমিকম্প প্রবণ। তার ওপর এমন ঘটনা আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা বেঁচে ফিরেছেন, কিংবা যাদের ঘরে কম্পনের আঁচ লাগেনি, তাঁরাও এখনও আতঙ্কে ভুগছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তাঁদের কাছে একটাই নাম – ‘অপারেশন দোস্ত’। দেশ থেকে দূরে গিয়ে, হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসা করছেন এই মানুষগুলো। বিপদের দিনের ত্রাতা এই ‘দোস্ত’দের দিকেই তাকিয়ে তুরস্ক।