মৃত ভাষায় কথা বলতে পারে তোতাপাখি! যে ঘটনা চমকে দিয়েছে বিশ্বকে...
Language of Parrot: হামবোল্ট তোতাপাখির প্রায় ৪০টি শব্দ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯ শতকের শুরু। জার্মান ভূগোলবিদ এবং প্রকৃতিবিদ, আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট আমাজন অববাহিকা অন্বেষণে বেরিয়েছেন। এই সুলুকসন্ধনের সময় এক অদ্ভুত ভাষায় এসে হোঁচট খেলেন হামবোল্ট। এই অদ্ভুত ভাষা তিনি যে আগে কখনও শোনেননি তা নয়, তবে শব্দগুলির উৎস দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! অসম্ভব! এমন কীভাবে হতে পারে? এই ভাষার শব্দগুলির উৎস নাকি একটি তোতাপাখি! হামবোল্টের মতে, তোতাই ছিল শেষ জীবিত প্রাণী যে মৃত উপজাতীয় ভাষায় কথা বলতে পারত।
ভাষার মৃত্যু এবং হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ হিসেবে এই গল্পটি সেই তখন থেকেই কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে। অনেকে অবশ্য বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামাননি। ১৭৯৯ সালের জুন মাসে, হামবোল্ট, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা অন্বেষণের উদ্দেশ্যে উত্তর স্পেনের লা করোনা থেকে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় সময় লেগেছিল পাঁচ বছর। এই সময়ে তিনি কিউবা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর এবং তারপরে পেরু আর মেক্সিকোতেও যান। এইসব ঘুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তারপরে ইউরোপে ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন- দুইবোন মাত্র কথা বলতে পারেন আর, কীভাবে খাদের ধারে পৌঁছল বাংলাদেশের এই ভাষা?
এই পুরো সফর জুড়ে, হামবোল্ট উদ্ভিদ এবং প্রাণী এবং স্থানীয় জলবায়ু সম্পর্কিত প্রচুর পরিমাণে পরিবেশগত এবং প্রাণিবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি যে যে মানব সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার উপরও দীর্ঘ দীর্ঘ বিশ্লেষণ, অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছিলেন। স্থানীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঐতিহ্যের বিস্তারিত বিবরণ লিখেছিলেন তিনি। স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলার দুর্দান্ত ক্ষমতা ছিল হামবোল্টের। যে কারণেই স্থানীয় কিছু উপজাতির সঙ্গে কথা বলতে, তাদেরকে বুঝতে তাঁর সুবিধা হতো।
জনপ্রিয় কাহিনি অনুযায়ী, ওরিনোকো নদী অন্বেষণের সময়, এখন যেখানে ভেনেজুয়েলা, সেখানে মায়পুরেস গ্রামের কাছে এক স্থানীয় উপজাতির জায়গায় যান হামবোল্ট। এখানেই তিনি সেই তোতাটিকে দেখেন। তোতাপাখিটি তার আশেপাশের সকলের সঙ্গে আলাদা কিছু ভাষায় কথা বলেছিল। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর হামবোল্ট জানতে পারেন, পাখিটি এক শত্রু উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই উপজাতিকে পরে ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পরে কিছু দূরে একটি ছোট দ্বীপে এই উপজাতির অধিকাংশই মারা যায়। সম্ভবত তোতাপাখিটিই এই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলা শেষ প্রাণী।
হামবোল্ট চমকে যান! তোতাপাখিটিকে তিনি কিনে নেন এবং তাঁর সঙ্গে ইউরোপে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি পাখির কথার ধ্বনিগত শব্দ রেকর্ড করতে থাকেন। এইভাবেই হামবোল্ট একটি বিলুপ্ত ভাষা ও সংস্কৃতির শেষ উচ্চারণটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন- জন্মের পরই অন্ধ হয়ে যায় মানুষ, এমনকী পশুপাখিও! এই গ্রাম ঘিরে এখনও রয়েছে গভীর রহস্য
হামবোল্ট তোতাপাখির প্রায় ৪০টি শব্দ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হামবোল্টের এই চেষ্টা ভাষাবিদদের কাছে এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণা। কীভাবে ভাষারা সহজেই মারা যেতে পারে যদি তাতে কথা বলার জন্য কোনও মানুষ বা কোনও পাখি না থাকে, সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় এই ঘটনাটি থেকে। ১৯৯৭ সালে একজন শিল্পী আধুনিক তোতাপাখিদেরকে এই শব্দগুলি শিখিয়েছিলেন এবং রেকর্ড করেছিলেন যাতে নতুন প্রজন্ম এই হারিয়ে যাওয়া ভাষা শুনতে পারে।
কিন্তু গল্পটা কি আদৌ সত্যি? অনেকেই এই গল্পটিকে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকেই কল্পনাপ্রসূত বলে উড়িয়ে দেন। তবে, হামবোল্ট তাঁর গল্পের সমর্থনে কিছু প্রমাণ দিয়েছেন। ইউরোপে ফেরার পরপরই প্রকাশিত একটি বইয়ে, হামবোল্ট ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে তিনি ওরিনোকো নদীর তীরে একটি জলপ্রপাতের পাশে একটি গ্রামে গুয়াহিবো জনগণের সঙ্গে ছিলেন। তিনি তোতাপাখির মুখোমুখি হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন এবং কীভাবে পাখিটি যুদ্ধপ্রিয় উপজাতি আচারেসের ভাষায় কথা বলত তাও লিখেছিলেন। হামবোল্ট লিখেছিলেন,
"আচারেসের শেষ পরিবারগুলি ১৭৬৭ সাল অবধিও ছিল... আমাদের সমুদ্রযাত্রার সময়, মায়পুরেসে একটি বৃদ্ধ তোতাপাখিকে দেখি, যার সম্পর্কে বাসিন্দারা বলেছিল যে পাখিটা কী বলত তা তারা বুঝতে পারত না কারণ এটি আচারেসের ভাষায় কথা বলে।"