দেশভাগ থেকে ভারত-পাক বিবাদ! শতাব্দী পেরিয়েও যেভাবে রাজত্ব টিকিয়ে রেখেছে ‘রুহ আফজা’

History of Rooh Afza : একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ঠান্ডা রাখছে শরীর, ইতিহাসের ধাক্কা সামলেও যেভাবে বিশ্বের ৩৭ টি দেশে ছড়িয়ে পড়ল রুহ আফজা?

কাচের বয়াম, তাতে টকটকে লাল রঙের সিরাপ। শরবতের দোকানে অবশ্য এই ছবি নতুন কিছুই নয়। তাছাড়া আজকের আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে যখন নিত্যদিনই নতুন কিছু ফিউশন তৈরি হচ্ছে তখন তো এই ছবিটা আকছার দেখা যায়। গরমের সঙ্গে যেন বিশেষ একটা সম্পর্ক আছে এর। শহরে পারদ যতোই বাড়তে থাকে, লাল রঙা এ বোতলের চাহিদাও ততই বাড়ে। আর এর মধ্যেই আসে টানা একমাসের রমজান। তখন অচিরেই হালিম অথবা বিরিয়ানির সঙ্গে ইফতারি পদের তালিকায় পাকাপাকি জায়গা করে নেয় এই সাবেকি রুহ আফজা।

আজকের দিনে খুবই পরিচিত এই পানীয়। বিশেষত রমজানের সময় এর গুরুত্ব বেড়ে যায় আরও। শহরের ইতিউতি শরবতের পসরা বসে এইসময়। হালফিলের নীল, সবুজ অথবা কমলা রঙের ভিড়ে আজও খোঁজ পড়ে চিরন্তন এই লাল সিরাপের। রুহ আফজার অর্থ হল আত্মার শান্তি। আর এই প্রচণ্ড গরমে একটানা নির্জলা উপবাসের পর এই শরবতে চুমুক দিলেই শান্ত হয় শরীর।

আরও পড়ুন - বিভেদ ভুলেই ইফতারি স্বাদে মজেছে গোটা কলকাতা, হালিম থেকে শরবত, কোথায় মেলে সেরা খাবার?

রুহ আফজাকে আজ এক ডাকে চেনেন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ। অভিনব স্বাদের এ শরবতটি রমজান মাসে ইফতারের এক বিশেষ অনুষঙ্গ। যদিও এই বিশেষ পানীয়ের জন্মের ইতিহাসটাও অনেক পুরনো। সময়টা ১৯০৭ সাল, অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে হাফিজ আব্দুল মজিদ নানে এক হাকিম প্রথম বিক্রি শুরু করেন এটি। এরপর ১৯৪৭ সালের পর হাকিমের এক ছেলে দিল্লিতে থেকে যান এবং অন্য জন পাকিস্তানে চলে যান। তখন দুই দেশেই তৈরি হয় ‘হমদর্দ ইন্ডিয়া’ এবং ‘হমদর্দ পাকিস্তান’ নামে দু’টি সংস্থা। আর দুই সংস্থাই বিক্রি শুরু করে ‘রুহ আফজা’। সেই একশ বছর আগে থেকে শুরু করে দেশভাগ, ভরত পাক বিবাদ অথবা হালফিলের করোনা মহামারী, একের পর এক ইতিহাসের ধাক্কা সামলেছে রুহ আফজা। দেশভাগের পরেও হারিয়ে যায়নি এই পানীয়টি, বরং ছড়িয়ে পড়েছে ভারত, পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও।

শরবতের দোকান থেকে শুরু করে ঔষধের দোকানগুলোতেও সারিবদ্ধভাবে থরে থরে সাজিয়ে রাখা থাকে লালচে-খয়েরি রঙের এই রুহ আফজার বোতল। শুধু তাই নয়, বর্তমানে সময় অনেক এগিয়ে গিয়েছে। তাই তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আজকাল অনলাইনেও মিলছে সাবেকি রুহ আফজা। এই নিয়ে অবশ্য জলঘোলাও কিছু কম হয়নি। বছর দুই আগে, ‘হমদর্দ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’ এবং ‘হমদর্দ ল্যাবরেটরিজ ইন্ডিয়া’ যৌথ উদ্যোগে দিল্লি হাই কোর্টে একটি পিটিশন জমা পড়ে। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন সংস্থা বেআইনি ভাবে অ্যামাজনে রুহ আফজা নাম নিয়ে লাল রঙের ভেজাল পানীয় বিক্রি করছে। দিল্লি হাই কোর্ট এই পিটিশনের জবাবে অ্যামাজনকে সতর্কও করে।

আসুন জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে জন্ম নিয়েছিল এই বিশেষ পানীয় রুহ আফজা...

১৯০৭ সাল, পুরনো দিল্লীর লাল কুয়ান বাজারের একটি ভবনে বসবাস করতেন হাকিম আবদুল মাজীদ। এটাই ছিল তাঁর দাওয়াখানা, অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে ওষুধের দোকান। দিল্লীর গরম অবশ্য সেকালেও নাজেহাল করতো জনজীবনকে। আর ঠিক এর বিপরীতে দাঁড়িয়েই হাকিম ঠিক করেন চমৎকার এমন কিছু তৈরি করবেন যা রোগীদের মন এবং শরীর একসঙ্গে চাঙ্গা করে দিতে পারবে। এভাবেই হাকিম সাহেবের হাতে জন্ম নিল রুহ আফজা। 'হামদর্দ দাওয়াখানা'র রোগীদের আরাম দেওয়ার পাশাপাশি ক্রমেই এ পানীয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল লাল কুয়ান বাজার সহ দিল্লির অন্যত্র। অতঃপর গোটা দেশে।

আরও পড়ুন - জল, খাবার কিচ্ছু নয়! টানা একমাস কঠোর নিয়ম, রমজান মাসের তাৎপর্য জানুন

মোট ২১টি বিভিন্ন রকমের গাছগাছড়া, ফুলফলের উপাদান মিশিয়ে এই বিশেষ পানীয় তৈরি করেন হাকিম মাজীদ। তার সঙ্গে জুড়ে যায় গোলাপের সুবাস। এগুলোকে নিংড়ে সেখান থেকে ঘনীভূত যে পদার্থ পাওয়া যায়, তাকেই জল অথবা অন্য কোনও তরলের সাথে মিশিয়ে রুহ আফজা পান করা হতো। কিন্তু হাকিম মাজীদ হয়তো নিজেও জানতেন না দিল্লীর ওই পুরনো দিল্লীর এক অন্ধকার গলি থেকে গোলাপের সুবাসের হাত ধরে রুহ আফজা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের ৩৭টি দেশে! এমনকী দেশভাগের ঝঞ্ঝাটেও দিব্যি টিকে থাকবে, তারপর শতবর্ষী হয়ে আজও পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে!

তবে রুহ আফজার আজকের যে রমরমা তার পিছনে কিন্তু একা হাকিমের অবদান সব নয়। গোটা একটা পরিবার প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন ব্যবসায়। ১৯২২ সালে মারা যান হাকিম মাজীদ। এরপর তাঁর স্ত্রী রাবিয়া বেগম একার কাঁধে তুলে নেন দাওয়াখানার ভার। তিনিই প্রথম হামদর্দকে একটি ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করেন। এবং ক্রমেই এটি একটি ইসলামিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। এর কয়েক বছর পর হাকিম মাজীদ এবং রাবিয়া বেগমের বড় ছেলে আবদুল হামীদ হামর্দ দায়ভার গ্রহণ করেন ব্যবসার। ছোট ছেলে মোহাম্মদ সাইদও মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করে যোগ দে ব্যবসায়। দেশভাগের পর বড় ভাই ভারতে এবং ছোট ভাই পাকিস্তানে দুটি পৃথক কোম্পানি চালাতে থাকেন। প্রথমে পাকিস্তানের করাচির আরামবাগ এলাকায় একাই রুহ আফজা তৈরি করা শুরু করেন সাইদ। কয়েক বছর পরে পাকিস্তানে এটির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একটা আস্ত কারখানা নির্মাণ করা হয়। ক্রমেই পাকিস্তানে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে রুহ আফজা।

আজও বহাল সেই জনপ্রিয়তা। তাই রমজানের শরবতে রুহ আফজার রং একটুও ফিকে হয়নি।পাশাপাশি ২০১৯ সালে বর্তমান প্রজন্মের রুচির কথা মাথায় রেখে রুহ আফজা গো নামক একটি কার্বোনেটেড বেভারেজ বাজারে আনে হামদর্দ। এছাড়াও এই সাবেকি পানীয়ের বিজ্ঞাপনের দিকেই যথেষ্ট নজর দিচ্ছে সংস্থা। জুহি চাওলার মতো জনপ্রিয় তারকাকেও দেখা গেছে রুহ আফজার বিজ্ঞাপনে। আর এভাবেই সবেকিয়ানাকে সঙ্গে নিয়েই ক্রমশ ট্রেন্ডি হয়ে উঠছে টকটকে লাল রঙের রুহ আফজার শরবত।

More Articles