মিড ডে মিল প্রকল্পের নেপথ্যে এক বাঙালি, ভারত চিরতরে ভুলেছে এই বিজ্ঞানীকে...

Mid Day Meal Scheme: ১৯৪৩ সালে, দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে থাকা শিশুদের জন্য সহজ এবং পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প হিসাবে প্রথম সয়া দুধের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন শশাঙ্ক।

মিড ডে মিল, খাবার দিয়ে স্কুলে টানা। অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থান হলো মৌলিক চাহিদা। তাহলে শিক্ষা? স্বাস্থ্য? রোটি-কাপড়া আর মকান জোটাতে যেতে হবে শিক্ষার কাছেই। অথচ সেই শিক্ষা দেশের মৌলিক চাহিদাই নয়? তাহলে খাদ্য দিয়েই শিশুদের স্কুলমুখী করতে হবে। একবেলা একজনের খাবারের খরচ যদি পরিবারে কমানো যায় তাহলে শিশু স্কুলে আসবে, স্কুলেই খাবে। সেখানে সে পড়বেও। মিড-ডে-মিলের নেপথ্যের চিন্তন ছিল এটিই। আর চিন্তক? চিন্তককে মনে রাখেনি দেশ, এমনকী মনে রাখেনি তাঁর নিজস্ব রাজ্যও। পশ্চিমবঙ্গের মিড-ডে মিল ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমান শাসক দলের নানা দুর্নীতি হামেশাই শিরোনামে এলেও, এই ব্যবস্থার নেপথ্যে থাকা মানুষটির কথা অজ্ঞাত কারণেই আলোচনা হয় না। শশাঙ্ক শেখর দে, গুগলও চেনে না এই মানুষটিকে।

১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সদ্য শেষ হয়েছে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার জোটাতে গিয়ে ব্রিটেনের অমানবিক নীতির কারণে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। লক্ষ লক্ষ ভারতীয় পেট, কোটি কোটি খিদে! ১৯৪৪ সাল, যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছর আগে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (IISc) ব্যাঙ্গালোর ফুড টেকনোলজিতে লেকচারার পদের জন্য আবেদনের আমন্ত্রণ জানায়। কলকাতার বিজ্ঞানী শশাঙ্ক শেখর দে আবেদন করলেন। ১৯৩৯-৪৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্সে সাপের বিষ থেকে প্রাপ্ত উৎসেচক নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। ফুড টেকনোলজির ওই পদের জন্য নির্বাচিত হলেন তিনি।

আরও পড়ুন- অপুষ্টিতে ভুগে মরছে লাখো লাখো শিশু, এই ভারত চেয়েছিলেন নেতাজি?

১৯৪৩ সালে, দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে থাকা শিশুদের জন্য সহজ এবং পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প হিসাবে প্রথম সয়া দুধের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন শশাঙ্ক। ফলিত রসায়ন বিভাগে তার সিনিয়র সহকর্মী বীরেশচন্দ্র গুহর সঙ্গে সয়া দুধ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণাও করেছিলেন তিনি। বেঙ্গালুরুতে IISc-তে তিনি পেলেন তৎকালীন বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রধান ভি. সুব্রহ্মণ্যনের পরামর্শ।

সুব্রহ্মমণ্যনের সঙ্গে মিলে শশাঙ্ক একটি বিশেষ প্রকল্পে কাজ শুরু করলেন। সয়া দুধ শিশুদের পুষ্টির পরিপূরক হতে পারে কিনা এই নিয়ে গবেষণা তো চললই, পাশাপাশি প্রায় চার বছর ধরে কর্ণাটকের হাজার হাজার শিশুকে নিয়মিত সয়া দুধ সরবরাহের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়লেন শশাঙ্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভারত যতটা দুধের প্রয়োজন ততটা উৎপাদন হচ্ছে না। অপুষ্টি শুধু বাংলার নয়, সারা দেশেরই সমস্যা। সেই থেকেই, আর অন্য কী কী থেকে দুধ তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে সয়াবিন এবং চিনাবাদামের মতো তৈলবীজের অবশিষ্টাংশগুলিকে মিশিয়ে বিকল্প দুধ তৈরি করা যেতে পারে কিনা তা নিয়ে চলল ব্যাপক গবেষণা।

IISc জানিয়েছিল, ভারতে সয়াবিনের ব্যবহারকে জনপ্রিয় করতে বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চালালেও এর ব্যবহার পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে খুব বেশি এগনো যায়নি। শুধুমাত্র সেদ্ধ করে সয়াবিন ব্যবহার করলে তা হজম করা সমস্যাজনক হয়ে যায় এবং এর প্রোটিনের জৈবিক মানও কমে যায়। তবে দুধ করে নিলে পুষ্টির মান অনেক বেড়ে যায়। তাই সয়াবিন থেকে দুধ তৈরির দিকেই মন দেন শশাঙ্ক এবং সুব্রহ্মণ্যন।

পরবর্তী গবেষণায় শশাঙ্ক এবং সুব্রহ্মণ্যন দেখতে পান, সয়াবিন ডালের জৈবিক মান (শরীর দ্বারা শোষিত প্রোটিনের পরিমাণ) ছিল মাত্র ৫৫, দুধে সেই পরিমাণ ছিল ৮০। সয়া দুধের হজম ক্ষমতা ৯২ শতাংশ, যেখানে গরুর দুধের হজম ক্ষমতা ছিল ৮৮ শতাংশ। এছাড়াও, সয়া দুধে পর্যাপ্ত বি কমপ্লেক্স ভিটামিন রয়েছে এবং এটি ভাতেরও পরিপূরক হতে পারে। কয়েক মাস থেকে ছয় বছর বয়সী ১২৯ শিশুকে হয় গরুর দুধ বা সয়া দুধ খাওয়ানো হয়েছিল। চার মাস বয়সী শিশুরা সয়া দুধে বেশি সাড়া দেয়। বড় বাচ্চারা দুই ধরনের দুধেই সাড়া দেয়।

আরও পড়ুন- ফসল ফলিয়েও অপুষ্টিতে ভুগছে কৃষকদের সন্তানরাই! যেভাবে লড়ছে অসমের জনজাতিরা

ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফান্ড (বর্তমানে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ), খাদ্য বিভাগ (বর্তমানে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রক) এবং বেঙ্গালুরুর তৎকালীন মিলিটারি ও সিভিল স্টেশন IISc-র সয়া দুধ তৈরি ও মিড ডে মিলের প্রকল্পে টাকা ঢালে। সয়া দুধের স্বাদ নিয়ে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখেন তা সমাধানযোগ্য। এই সুস্বাদু দুধ ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে মিড ডে মিল কর্মসূচির আওতায় শিশুদের খাওয়ানো হয়। ১৯৪৫-৪৬ সালে IISc দিনে প্রায় ২৫০ লিটার সয়া দুধ উৎপাদন করত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৬০০ পড়ুয়াকে তা খাওয়ানো হতো।

শুধু শিশুদের জন্যই নয়, সয়া দুধ চা, কফি, দই এবং বাটারমিল্ক তৈরিতেও ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। ১৯৫০ সালে IISc সেনাবাহিনীতেও এই দুধের 'ফিডিং ট্রায়াল' করে। খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে আইআইএসসিতে সয়া এবং অন্যান্য উদ্ভিজ্জ দুধের উপর গবেষণা এখনও অব্যাহত। শশাঙ্ক যে 'ব্যাঙ্গালোর স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম' শুরু করেছিলেন তাই ছিল এখনকার মিড-ডে মিল কর্মসূচির ব্লু প্রিন্ট। প্রকল্পটি জনপ্রিয় হলেও, আড়ালেই রয়ে গেছেন শশাঙ্ক।

More Articles