বোনকে আদর, মোদিকে আলিঙ্গন! প্রকাশ্যে ভালোবেসেই তবে ভারতকে জুড়বেন রাহুল?
Rahul Gandhi - Priyanka Gandhi: রাহুল গান্ধী বোনকে স্নেহের আদরে জড়িয়ে ধরেচ্ছেন। গালে চুমু খেয়েছেন, আলতো করে ঘেঁটে দিয়েছেন বোনের চুল।
ভারতকে জুড়তে চাইছেন রাহুল। কোন ভারতকে? অসহিষ্ণু, ঘৃণার চাদরে মোড়া, একে অন্যকে আড়চোখে দেখার ভারতকে? নাকি সেই ভারতকে যেখানে 'সনাতন' বলতে শুধু ধর্মকে বোঝানো হয় না। সনাতন বলতে বোঝানো হয় বন্ধনকে, মানুষে মানুষে জড়িয়ে থাকার, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার নিবিড় ছায়ার তলে গড়ে ওঠা একখণ্ড ভূমিকেই কি জুড়তে চাইছেন রাহুল? প্রকাশ্যে খুন-জখম নয় বরং প্রকাশ্যে ভালোবাসার কথাই কি বলতে চাইছেন কংগ্রেসের নেতা? উত্তরপ্রদেশে পৌঁছে গিয়েছে কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা। সেই উত্তরপ্রদেশ যেখানে নিজেদের সমস্ত গড়ই ধসে পড়েছে কংগ্রেসের। সেই উত্তরপ্রদেশ যেখানে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা এবং ধর্ষণের পরের নির্লিপ্ততা দেশকে অবাক হতে অভ্যস্ত করে দিয়েছে। সেই উত্তরপ্রদেশ যেখানে বাবরি-অযোধ্যার পাশা খেলা দেখেছে ভারতবর্ষ, সেই উত্তরপ্রদেশ যেখানে ভালোবাসা নয়, বুলডোজারের বাণীই শোনা যায় কান পাতলে। রাহুল গান্ধী আর তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই যোগীর গড়েই ভালোবাসার বুনোফুল ফুটিয়েছেন। স্নিগ্ধ-নরম, অথচ কী উজ্জ্বল! মঙ্গলবার উত্তরপ্রদেশে প্রবেশের পর ভারত জোড়ো যাত্রার মাঝেই ভাই-বোনের ভালোবাসার কিছু মুহূর্ত দেশকে থমকে দিয়েছে। খুব পরিচিত, অথচ ভুলতে বসা দৃশ্যই দিয়েই তবে দেশকে সেলাই করতে চাইছেন রাহুল-প্রিয়াঙ্কা?
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরা দাদাকে বলেছেন, 'যোদ্ধা'। বলেছেন 'সত্যের ঢাল' পরে রয়েছেন রাহুল এবং কাউকে তাই ভয় পান না তিনি। রাহুল গান্ধী বোনকে স্নেহের আদরে জড়িয়ে ধরেছেন। গালে চুমু খেয়েছেন, আলতো করে ঘেঁটে দিয়েছেন বোনের চুল। প্রিয়াঙ্কাও হেসে খিলখিলিয়ে উঠেছেন। দাদাকে আরও ভরসা জুগিয়েছেন। মোবাইলে, টিভিতে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে চরম উত্তেজিত মানুষও হালকা হেসেছেন, শান্ত হয়েছেন পলক-ক্ষণের জন্য। উত্তরপ্রদেশে ভারত জোড়ো যাত্রার সময় হাতে হাত ধরে হেঁটেছেন প্রিয়াঙ্কা আর রাহুল। ভাইবোনের হাত ধরার উষ্ণতা কি তবে ভরসার ভুলে যাওয়া অর্থই শেখাচ্ছে দেশকে?
আরও পড়ুন- অলক্ষ্যেই ম্যাজিক করছেন রাহুল! হিংসার বিরুদ্ধে মানুষকে জুড়বে ভারত জোড়ো যাত্রাই?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশই বলছেন, চোখের সামনে নিয়মিত যা ঘটে- মানুষ একসময় তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদি চুরি, মারামারি, ঘৃণার বাক্যবাণ- সে সামনে হোক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে- রোজের ঘটনা হয়ে যায়, উঠতে বসতে যদি এই জিনিসই চোখের সামনে আসে একটা সময় তা চোখ সওয়া হয়ে যায় স্বাভাবিক ছন্দেই। তখন বিপরীত দৃশ্য দেখলে একটু নজর কাড়ে। ভারত জোড়ো যাত্রার এই ভালোবাসার দৃশ্যপট আসলে খুব চেনা- কিন্তু কবে শেষ ভারত এমন দৃশ্য দেখেছে মনে করতে হলে কপালে ভাঁজ পড়বে। আর এটাই কংগ্রেসের অস্ত্র। ভারত জুড়তে হলে ভারতের মানুষকে জুড়তে হবে। মানুষের মধ্যে যে সন্দেহ-ঘৃণার দেওয়াল গড়ে উঠেছে বেশ কিছুকাল ধরে, তার ঠিক উলটোপিঠে খাড়া করতে হবে মানবিক অনুভবের স্তম্ভ।
বেশ কয়েক বছর আগে প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক সঈদ নকভি বলেছিলেন, জনসমক্ষে কথা বলা রাহুলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ব্যক্তিগত পরিসরে রাহুল একেবারে অন্য মানুষ। বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, অন্যের কথা শুনতে ভালোবাসেন। কিন্তু জনসাধারণের সামনে কথা বলার সময় তাঁর ওই ম্যাজিক কাজ করে না। “তিনি একজন খুব ভদ্র এবং স্নেহশীল ব্যক্তি। মাঝে মাঝে আমি তাঁকে বলিও যে তিনি একটু বেশিই স্নেহশীল। রাজনীতিতে আপনাকে স্নেহশীল হতে হবেই তবে অতিরিক্ত নয়,” আজ জাজিরাকে বলেছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা কমল নাথ, যিনি রাহুলকে শৈশব থেকেই চেনেন।
আরও পড়ুন- মোদি নন, বাজপেয়ীই প্রকৃত বিজেপি! অটল বিহারীর স্মৃতিসৌধে গিয়ে কোন বার্তা দিলেন রাহুল?
রাহুল এই স্নেহশীলতাকে দুর্বলতা নয়, অস্ত্র করে ফেললেন। সাম্প্রতিককালে রাহুল যতবার জনসাধারণের মাঝে গিয়েছেন, তাঁর নিজস্বতা বজায় রেখেই তিনি সহজ হতে পেরেছেন, অন্যের কথা শুনেছেন, নিজের কথাও শুনিয়েছেন। সর্বোপরি, রাহুলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অন্যতম দিক হয়ে উঠেছে তাঁর এই স্নেহশীলতা। শুধু বোনের প্রতি নয়, মায়ের গায়ে চাদর জড়িয়ে দেওয়া হোক বা আলতো করে গাল টিপে দেওয়া- রাহুল ভারতীয় 'সন্তান' হয়ে উঠেছেন তাঁর 'বিদেশি' আভিজাত্য ছেড়ে। ২০১৯ সালে বিরোধী দলের সবচেয়ে তুখোড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নরেন্দ্র মোদিকেও ভালোবাসতে চেয়েছিলেন রাহুল। সংসদের মধ্যে রাহুল গান্ধী জড়িয়ে ধরেছিলেন নরেন্দ্র মোদিকে। বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি খুব রেগেছিলেন, তাই তাঁকে একটু নরম করে ভালোবাসার স্বাদ দিতে চেয়েছিলেন রাহুল।
রাহুল বলেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদি রাগে এতই অন্ধ হয়ে আছেন যে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখতেও পাচ্ছেন না অন্য চোখে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাহুল গান্ধী যেভাবে ভারতকে দেখেন সেভাবে যদি একজন রাজনৈতিক নেতা দেখেন তাহলে তা ভোটবাক্সের আদৌ কোনও সুবিধা করে না। রাহুল গান্ধী মূলগত জায়গা থেকে ভারতকে দেখছেন। গাছের পাতায় জল ঢালার বদলে শিকড়ে গিয়ে রোগের গোড়া খুঁজতে চাইছেন। আজকের ভারত কি এভাবে চলে আর? এই গভীরতাকে ছোঁয়ার মতো জায়গায় কি নাগরিকরাও আর আছেন? রাহুলের প্রকাশ্যে ভালোবাসার প্রদর্শন ভারতের মাটি খুঁড়ে সেই ভালোবাসার বাঁধনের সন্ধানেই যাত্রা। একজন 'ভারতীয় সন্তান' হয়ে ওঠা, একজন 'ভারতীয় ভাই' হয়ে ওঠার শাশ্বত ধারাকে বয়ে নিয়ে যেতে চলার, সহজ হওয়ার যে রাস্তা তা কি আদৌ ভারতকে বাঁচানোর পথ? অথবা এটাই ভারতকে বাঁচানোর একমাত্র পথ! উত্তর একদিন ভালোবাসাই দেবে, বেঁচে থাকলে।