অলক্ষ্যেই ম্যাজিক করছেন রাহুল! হিংসার বিরুদ্ধে মানুষকে জুড়বে ভারত জোড়ো যাত্রাই?

Bharat Jodo Yatra: হিংসা-দ্বেষের বদলে যদি ভালবাসা দিয়ে এই দেশকে অখণ্ড রাখা যায়, যদি মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে দূর করে 'বিবিধের মাঝে মিলনকে' দেখা যায়, তাহলে ক্ষতি কী!

ধরুন, অফিসের বস আপনাকে কোনও কাজ দিয়েছেন। আপনার করে দেওয়ার পরেও কাজটিতে তিনি সন্তুষ্ট নন এবং তিনি মনে করতে শুরু করেছেন, আপনার দ্বারা কাজটি ঠিক হবে না। অথবা আপনি কাজটি জানেনই না। এর মাঝে কেউ আপনার সম্বন্ধে তাঁর কান ভরে দিয়ে এসেছে। ব্যাস। এবার আপনি যতই ভাল কাজ করুন, তিনি আপনাকে আর পছন্দই করছেন না। এরকম আমাদের সঙ্গে হয়েই থাকে। বস না হয়ে অন্য কেউ হতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতা কম বেশি একই গোত্রের। ভাবছেন, রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসে এই গৌরচন্দ্রিকার মানে কী?

আসলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর এখন সেই দশা। সেই ২০১৪-তে সর্বভারতীয় ইংরেজি চ্যানেলে দেওয়া অতীব খারাপ সাক্ষাৎকারটির পর থেকে নির্বাচন হেরে যাওয়া ও কংগ্রেস দলের সবচেয়ে খারাপ ফলাফলের পরে তিনি 'পাপ্পু'-ই হয়ে গেছেন অনেকের চোখে। কেউই প্রায় তাঁকে গুরুত্ব দিতে চান না। এটি খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে নেতা দলের সভাপতির পদে থাকতে চান না, কিন্তু দলের সর্বোচ্চ কমান্ডারের ভূমিকায় থাকতে চান, আবার কখনও মনে হয় তিনি সাধারণ কংগ্রেস কর্মীর মতো থাকতেই খুশি, যে নেতা মাঝে মাঝেই রাজনীতি থেকে ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান, যে নেতা মাঝে মাঝে জেগে ওঠেন এবং ভারতীয় রাজনীতির নিরিখে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই নির্বাচনে নিজের দলকে জেতাতে পারেন না, তাঁকে কে গুরুত্ব দেবে? যদি না অন্ধ ভক্ত হন কেউ!

এর উপরে দেশের শাসক দল এমন একজন বিরোধী নেতাকে পেয়ে যার পর নাই খুশি। সোশ্যাল মিডিয়া ও এক ধরনের হুইংপারিং ক্যাম্পেনের মতো করে সারা দেশে তারা রাহুল গান্ধীকে পাপ্পু বানিয়ে দিতে সফল হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি কোনও কাজেরই নন। বাচ্চা ছেলে।

তা এ হেন 'বাচ্চা ছেলেটি' গত সেপ্টেম্বর থেকে একটি কাজে নেমেছেন। তিনি হাঁটছেন — কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর। ১৫০ দিন ধরে তিনি প্রায় ৩৫০০ কিলোমিটার হেঁটে ১২টি রাজ্য পার করে জম্মু-কাশ্মীরে পৌঁছবেন। এর মধ্যে ১০৮ দিনের যাত্রা শেষ করেছেন। নয়টি রাজ্য পেরিয়ে এসেছেন। আর মাত্র ৪৫০ কিলোমিটার পথ বাকি।

আরও পড়ুন- ফের লকডাউনের আতঙ্ক! রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা বন্ধ করতেই কোভিড ত্রাস সৃষ্টি?

রাহুল এই অভিযানের নাম দিয়েছেন, ভারত জোড়ো যাত্রা। গত কয়েক মাসে মিডিয়াতে খুব বেশি শিরোনামে এই যাত্রা জায়গা করতে পারেনি। যদিও বা করেছে, তা মূলত নেতিবাচক কোনও ইস্যুতে। কখনও সাভারকরকে নিয়ে কোনও মন্তব্যে বিতর্ক হয়েছে। কখনও বা কর্ণাটকে ভারত জোড়ো যাত্রার মাঝে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডি শিবকুমারকে ইডির তলবকে নিয়ে হইচই হয়েছে। আবার কখনও সমাজকর্মী মেধা পাটকর বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের যাত্রায় যোগদান নিয়ে বিতর্ক তুলেছে কংগ্রেসের বিরোধীরা। কখনও রাহুল গান্ধীর দাড়ি রাখা নিয়ে কটাক্ষ করতে গিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা রাহুলকে প্রাক্তন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

রাজস্থান থেকে দিল্লিতে ঢোকার মুখে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে, কোভিড নিয়ে যখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তখন রাহুল গান্ধী কেন যাত্রা বন্ধ করছেন না। কোভিডের আতঙ্কে সাধারণ মানুষের কী কী করা উচিত সেই নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তের আগেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডব্য তো রাহুল গান্ধীকে চিঠি লিখে যাত্রা বন্ধ করতে বললেন। তখনও রাজস্থানে বিজেপির জন আক্রোশ যাত্রা বন্ধের কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এর মাঝে তো প্রশ্ন রয়েইছে যে, কেন রাহুল গান্ধী তাঁর যাত্রা নিয়ে গুজরাতে গেলেন না। নির্বাচনের সময়ে কেন তিনি গুজরাতকে যাত্রাপথের বাইরে রাখলেন?

এর উত্তর আমার দুই ছাত্রী আমাকে দিয়েছে। সাংবাদিকতার পড়ুয়া হিসেবে শিরোনামে থাকা খবরগুলিকে তাঁরা মিমের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে কিনা, সেই কাজটি তাদের দিয়েছিলাম। দুই ছাত্রী একটি ইনস্টাগ্রাম রিল বানিয়েছিল রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা ও গুজরাত নির্বাচনের উপর। তাঁরা দেখিয়েছিল একদিকে ভারত জোড়োর নৃত্য চলছে আর অন্যদিকে ভোট জোড়োর নাচ!

আসলে ভারত জোড়া যাত্রার সঙ্গে রাহুল সত্যিই নির্বাচনকে জুড়তে চাননি। কেউ যদি খুব মনোযোগ দিয়ে এই যাত্রাকে দেখে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে এই যাত্রাকে খানিকটা রাজনৈতিক দর্শনের লড়াইয়ের সঙ্গে জুড়েছেন তিনি।

গত ১০০ দিন ধরে রাহুল গান্ধীর মুখে একটিই কথা — আরএসএস-বিজেপি দেশকে ভাগ করতে চাইছে ধর্মীয় রঙে। আর তিনি দেশকে জুড়তে চাইছেন ভালবাসার আলিঙ্গনে। সঙ্গে বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যুগুলিকেও গুঁজে দিচ্ছেন। ভোট চাইছেন না সরাসরি। ভারত জোড়ো যাত্রায় কংগ্রেসের পতাকার আগে থাকছে জাতীয় পতাকা। বার বার রাহুল গান্ধী বলছেন তিনি মতাদর্শের লড়াই লড়ছেন।

যে লড়াইটি দেশের অন্য কোনও প্রধান রাজনৈতিক দল ময়দানে নেমে লড়ছে না। তৃণমূল হোক বা আম আদমি পার্টি বা যাদের এই লড়াই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়ার কথা ছিল, সেই বামেরাও লড়ছে না। আঞ্চলিক দলগুলি, যারা কোনও না কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে, তারা হয় ইডি-সিবিআইয়ের কোপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত বা উন্নয়নের রাজনীতির বুলি কপচিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে ব্যস্ত।

কেউই ঠিক মাঠে নেমে বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতির মতাদর্শগত বিরোধিতা করছে না। ২০১৪-র পর থেকে সরকারিভাবে কোনও জাতীয় সংহতির উপর চোখে পড়ার মতো বিজ্ঞাপন তৈরি হয়নি। বরং দিনে দিনে কোণঠাসা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে চলেছে। অজুহাত হচ্ছে যে এ দেশ হিন্দুদের দেশ। এতদিন সংখ্যালঘু তোষণ হয়েছে। এবার হিন্দুরা মাথা তুলে দাঁড়াবে।

সেই হিংসা-দ্বেষের বদলে যদি ভালবাসা দিয়ে এই দেশকে অখণ্ড রাখা যায়, যদি মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে দূর করে 'বিবিধের মাঝে মিলনকে' দেখা যায়, তাহলে ক্ষতি কী!

আপাতভাবে এই মুহূর্তে ক্ষতি কারও নয়। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ নির্বাচন ও ক্ষমতাকে পাখির চোখের মতো দেখতে থাকেন। তাঁরা যদি নির্বাচনে জেতেন ও ক্ষমতায় থাকেন, তাহলেই আরএসএসের ভাবপ্রচার প্রাতিষ্ঠনিকতার মর্যাদা পাবে। ২০২৫-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের শতবর্ষে সেটিই হবে মোদি-শাহের উপহার। মতাদর্শগত ভাবে বামপন্থী বা উদারপন্থীদের দুরমুশ করে, সংখ্যালঘুদের মাথা তুলতে না দেওয়ার পণ করে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ধ্বজা ওড়ানোই এখন একমাত্র লক্ষ্য দেশের দুই শীর্ষ নেতার। সেখানে রাহুল গান্ধীর মতো একজন অপরিপক্ক নেতা এবং কংগ্রেসের মতো একটি ভঙ্গুর পার্টিকে বিরোধী হিসেবে পাওয়া মানে তো সোনায় সোহাগা।

আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?

কিন্তু আর জনসভা বা দলের সভা বা সাংবাদিকদের সামনে নয়, রাহুল গান্ধী নির্বাচনের বাইরে একটি দার্শনিক প্রশ্ন তুলে মানুষের মাঝে হাঁটছেন। তাঁদের সচেতন করার কাজ করছেন। অনেকেই ভারত জোড়ো যাত্রার সঙ্গে গান্ধীর ডান্ডি অভিযান বা মার্টিন লুথার কিংয়ের নাগরিক অধিকারের যাত্রার সঙ্গে তুলনা করছেন। যদিও রাহুল গান্ধী এসব তুলনাকে আমল দিতে চাননি। মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) 'আমার একটি স্বপ্ন আছে'-র ভাষণ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। রাহুল গান্ধীর স্বপ্ন কি সেই জায়গা পাবে?

এ দেশে নির্বাচনের ফলের উপরেই নির্ভর করে রাজনৈতিক সাফল্য। সামাজিক আন্দোলন বরাবর নির্বাচনী রাজনীতিকেই সাহায্য করে এসেছে। ৭০-এর দশকের জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিযান হোক বা হালের আন্না হাজারের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন সরকার ফেলতে সাহায্য করছে। রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা এখনও সেই পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু শুরু তো হয়েছে। দেশকে সংবিধানের আঁচলে এক সূত্রে আবার করে বাঁধার কাজটি রাহুল নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। দেশের মানুষের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন। এটি দান-খয়রাতির রাজনীতি থেকে দুরের একটি বিষয়।

কিন্তু রাহুল গান্ধীকে আরও অনেক বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। তাঁকে স্পষ্ট করতে হবে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। তিনি কি এখনও নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সরাসরি নির্বাচনী লড়াইতে অংশ নেবেন? মানে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরবেন? তিনি কি সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মীর মতো কাজ করবেন? নাকি তিনি এক রাজনৈতিক-দার্শনিক হিসেবেই নিজেকে মেলে ধরবেন?

সে তিনি যাই করুন, রাহুল গান্ধী কিন্তু একটি মোক্ষম বিষয় দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। এতে দেশের মানুষ কীভাবে কার পাশে দাঁড়াবেন, তা তাঁদের ব্যাপার। কিন্তু চোখে চোখ রেখে দক্ষিণপন্থী ও মধ্যপন্থীদের এই মহারণের সূচনা রাহুল করে দিলেন।

সে আপনার তাঁকে পছন্দ হোক বা না হোক। কোন দিকে আপনি থাকবেন, সে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।

More Articles