বিধানসভায় বোমা ছোড়া থেকে সিনেমার গল্প লেখা! বটুকেশ্বর দত্তকে ভুলে গেছে বাঙালি

Batukeshwar Dutta: স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কাহিনিকার হওয়া সত্ত্বেও বটুকেশ্বর দত্ত যেন সিংহভাগ বাঙালির কাছে বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপ করা বিপ্লবী হিসেবেই শুধুমাত্র পরিচিতি পেয়ে চলেছেন।

১৯৬৫ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল মনোজ কুমার, প্রেম চোপড়া অভিনীত 'শহিদ' ছবিটি। ছবিটির পটভূমি স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদ ভগৎ সিংয়ের জীবন এবং সংগ্রামকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছিল। এই ছবি কাহিনির জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। কাহিনির দিক থেকে এই ছবিটিকেই বাস্তবের সবচেয়ে কাছাকাছি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, কারণ ছবির কাহিনিকারদের মধ্যে একজনের নাম ছিল বটুকেশ্বর দত্ত। এই চলচ্চিত্রের কারণেই বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত সিনেমার জগতে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কাহিনিকার হওয়া সত্ত্বেও বটুকেশ্বর দত্ত যেন সিংহভাগ বাঙালির কাছে বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপ করা বিপ্লবী হিসেবেই শুধুমাত্র পরিচিতি পেয়ে চলেছেন।

বর্ধমানের গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও বটুকেশ্বর দত্তর ছাত্র এবং শুরুর দিকের বিপ্লবী জীবন কানপুরে কেটেছিল। কানপুরে থাকাকালীন তিনি দেখেছিলেন যে, কানপুরের মল রোডে একজন ব্রিটিশ একটি বাচ্চাকে বেধড়ক মারধর করছিল। ভারতীয়দের যেই রাস্তায় যাওয়া নিষেধ ছিল, বাচ্চাটি ভুল করে সেই রাস্তায় চলে গিয়েছিল। তার এই ছোট ভুল ইংরেজ প্রভুর কাছে পাপের সমান মনে হয়েছিল। তার ফলস্বরূপ বাচ্চাটির কপালে বেদম প্রহার জুটেছিল। নিজের দেশে কোনও রাস্তায় হাঁটার কারণে এই ধরনের প্রহার দেখে হয়তো অনেকেই কিছু করেননি। বটুকেশ্বর দত্ত তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন না। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করেছিলেন সেদিনই। তাই তিনি সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যর মাধ্যমে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। পরবর্তীকালে পরামর্শ করে তিনি হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করেছিলেন। সেই একই সময়ে ভগৎ সিং এই সংগঠনে যোগদান করেছিলেন। তাঁদের দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে বেশি দেরি হয়নি। বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের নাম আসলেই বিপ্লবী সুখদেব এবং রাজগুরুর নাম মানুষের মনে পড়ে। বটুকেশ্বর দত্তর সঙ্গেও ভগৎ সিংয়ের যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল, তা ভগৎ সিংয়ের মায়ের দেওয়া বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়।

Movie Poster

'শহিদ' ছবির পোস্টার

আরও পড়ুন: জাতীয় সংগীত হওয়ার যোগ‍্য নয়! কেন এই দাবি উঠেছিল ‘জনগণমন’ নিয়ে

১৯২৪ সালে কানপুরে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। সেই সময়ে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য তরুণ সংঘ নামে একটি দল তৈরি করা হয়েছিল। ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত সেই দলের সদস্য ছিলেন। দিনের বেলায় দুর্গতদের সাহায্য ছাড়াও তাঁরা রাতেও কাজ করতেন। রাতের বেলা তাঁরা লন্ঠন হাতে নিয়ে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যদি কোনও মানুষ নদীতে ডুবে যায় অথবা বন্যার জলে ভেসে যেতে থাকে, তাঁকে বাঁচানোর জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। বটুকেশ্বর দত্তর থেকেই ভগৎ সিং কিছুটা বাংলা শিখিয়েছিলেন। তিনি নিজে নজরুলগীতি পছন্দ করতেন এবং ভগৎ সিংকে নজরুলগীতি শুনিয়েছিলেন এবং কিছুটা শেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন।

১৯২৫ সালে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার ফলে হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন কিছুটা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিল। বটুকেশ্বর দত্ত এই সময়ে বাংলা, বিহারের বিভিন্ন জায়গায় পরিচয় বদলে থাকতেন। ১৯২৭ সালে সংগঠন নতুন নাম এবং রূপ নিয়ে ফিরে এসেছিল। বটুকেশ্বর দত্ত তখন পুনরায় কানপুরে ফিরে গিয়েছিলেন।

এই ঘটনার বছর দুইয়ের মধ্যে ইংরেজ সরকার পাবলিক সেফটি বিল এবং ট্রেড ডিসপিউট বিল পাস করানোর চেষ্টা করছিল। এই বিল পাস হলে যেকোনো বনধ অথবা ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করে সেই ধর্মঘট ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের নতুন নাম) ঠিক করে যে, তারা এই বিলের বিরোধিতায় ভরা বিধানসভায় বোমা ফেলবেন, কিন্তু কাউকে হত্যা করবেন না। সংগঠনের তরফে তখন ঠিক করা হয়েছিল যে তাঁদের চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো দরকার। তাই তাঁরা এই বিলের বিরোধিতায় সভায় গিয়ে বোমা নিক্ষেপ করেছিল।

বোমা নিক্ষেপ করার ফলে তাঁরা দু'জনে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বটুকেশ্বর দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডর আদেশ দিয়ে প্রথমে আন্দামানের সেলুলার জেলে এবং পরে হাজারিবাগের জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দি অবস্থায় করা অমানুষিক অত্যাচারের কারণে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিল। তাই তাঁকে কোনও রাজনৈতিক দলে এবং দলের কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ার শর্ত শুনিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। যদিও বটুকেশ্বর দত্ত এই শর্ত মানেননি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন।

বর্তমানে বটুকেশ্বর দত্তর নাম শুনলে ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে একটি বোমার মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার কথাই বেশি করে উঠে আসে, কিন্তু বহু মানুষ এটাও জানেন না যে, দিল্লিতে জোড়বাগের কাছেই বিকে দত্ত কলোনি আসলে বটুকেশ্বর দত্তর নাম থেকেই নিজের নাম পেয়েছে। মানুষের চোখের প্রায় আড়ালে থেকে নিজের এবং দেশের লড়াই লড়েছেন তিনি আজীবন।

তথ্য ঋণ: দ‍্য ওয়্যার, ইন্ডিয়া টাইমস, দ‍্য লজিক্যাল ইন্ডিয়ান

More Articles