'ভাবা প্র্যাকটিস' নয়, আজ ঋত্বিককে ভুলতে পারলেই কেন সুবিধা বাঙালির?
Ritwik Ghatak: ঋত্বিক তাঁর সময়ের থেকে এগিয়েছিলেন প্রায় এক দশক। আর তার জন্যই ঋত্বিকের অন্ধকার, অসম্পূর্ণ জায়গাগুলো দুনিয়ার কাছে আজও আলোচনার, রহস্যের।
দেশভাগ। কাঁটাতার- উদ্বাস্তু-যন্ত্রণা! এই তিনের সমান্তরাল ছবি বারবার নিজের ক্যানভাসে এঁকেছেন ঋত্বিক ঘটক। বাস্তবের যন্ত্রণাকে পর্দায় তুলে এনেছেন তিনি, যা দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে গেছে। কোথাও রক্তাক্ত সময়ের বর্ণনা, কোথাও আবার সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ভেবেছেন পরিচালক ঋত্বিক। ঋত্বিক এমন এক চরিত্র, যিনি নিজেই নিজেকে বলতেন ‘ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল’। বারবার কথা বলতে চাইতেন নিজের দেশকে নিয়ে। ঋত্বিকের চিন্তন, ঋত্বিকের চেতন, তাঁর প্রতিটা কাজের গায়ে তাই লেগে আছে সেই দেশের মাটির ঘ্রাণ। কখনও নীলকণ্ঠ, কখনও নীতা- সব চরিত্রের নেপথ্যে নিজের স্বল্প জীবদ্দশার অভিজ্ঞতাকেই আসলে নিংড়ে এনেছেন ঋত্বিক। তবুও, কোথাও গিয়ে কি মেঘের আড়ালে ঋত্বিক নিজেও ঢাকা পড়ে রয়েছেন?
দেশভাগ-নারী-নীতা! ঋত্বিক ঘটক এই তিন বিষয়কে এনে দাঁড় করিয়েছেন একই সারিতে। শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাসকে ভিত করে তিনি দাঁড় করান ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ইমারত। নারী বরাবর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ‘অবলা’, নীতা সেখানে ছাপোষা পরিবারের ঘুণধরা অবস্থার বাস্তব চেহারা। সুধী দর্শকের, চিন্তিত দর্শকের বুকের ভেতরের সমস্ত রক্ত তাই জমাট বেঁধে যায় নীতাকে দেখে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’র এই বছর ৬২ বছর পূর্ণ হল। ১৯৬০ সালে ১৪ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার এই ঘুণধরা সময় এবং সমাজের বুকে মুক্তি পায় সিনেমাটি। এ যেন মধ্যবিত্ত মদির জগতের কাছে নিজেদেরই প্রতিবিম্ব। বাংলার এক গরিব মেয়ে নীতার একা লড়াইয়ের গল্প। এ লড়াই যদিও কেবল নীতার নয়, বাংলার মেয়ের লড়াই। জানালা দিয়ে আলো, জলে প্রতিফলিত হয়েছে নীতার মুখ। এই সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই আবহসঙ্গীত সারাজীবন মনে রাখবে সিনেমাপ্রেমী মানুষ। যে নীতা সংসারের অসময়ে নিজের কাঁধে সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল, শেষপর্যন্ত দেখা যায় টিবি তাঁকেই সংসারের বোঝা বানিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন- অ্যালকোহল, জ্যোতিষ, তন্ত্র: মার্কসবাদী নবারুণ ঘুরেছেন নানা মার্গে
নিজের থেকেও নীতা বেশি ভালোবেসেছে সনৎকে, অথচ সেই সনৎ যখন তাঁরই চোখের সামনে নীতার বোনকে বিয়ে করেছে- নীতা চুপ থেকেছে। আসলে সংসারের কথা ভেবে এরকম হাজারও কারণে চুপ করে যেতে হয়, চুপ থাকাটাই পিতৃতান্ত্রিক দস্তুর! নীতা পারেনি প্রতিবাদ করতে, নীতারা কোন কালেই বা পেরেছিল নিজেদের জন্যে প্রতিবাদ করতে? যদিও এই সিনেমার শেষ দৃশ্যে রয়েছে ঋত্বিক বিষণ্ণ এক ম্যাজিক ঘটিয়েছেন! বাঁচার আকাঙ্ক্ষা বড় বালাই, তাই মৃত্যু পথযাত্রী নীতাও চেঁচিয়ে পাহাড়কে সাক্ষী রেখে বলে, “দাদা আমি বাঁচতে চাই, দাদা আমি যে বাঁচতে বড় ভালোবাসি। দাদা আমি বাঁচবো।” আসলে পাহাড়ই বোধহয় একমাত্র চরিত্র যে নিশ্চুপে পেরেছিল নীতার বিষাদের সঙ্গী হতে। নীতার যন্ত্রণাকে ভালোবাসতে। স্থবির পাহাড় এবং ম্রিয়মাণ নীতা তাই মুখোমুখি হয়েছে, শেষ দৃশ্যে। পাহাড়ের মৌনতাই নীতার মনে বেঁচে থাকার সাধকে আরও বাড়িয়েছে। নীতার চরিত্রে সুপ্রিয়া অসামান্য। “আদর্শ বলে একটা বস্তু হয়, যার জন্যে মানুষকে সাফার করতে হয়,” একটা বাক্যে সিনেপ্রেমীদের ঘাড় ধরে ঋত্বিক নামিয়ে এনেছিলেন দগদগে বাস্তবে।
এরপর নদী আর মানুষের জীবন আখ্যানকে রুপোলি পর্যায়ে টেনে আনেন ‘ঘটক - দ্য ম্যাজিশিয়ান’। আসলে তাঁর ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমা মানুষের জীবনের দোলাচলেরই চিত্রপট। যে কারণে মানুষ বাধ্য হয় সাতপুরুষের ভিটে, কালানুক্রমিক জীবিকা, আর পরিচিত দেশ-কাল ছেড়ে যেতে, শুরু করে নতুন করে বাঁচার, টিকে থাকার সংগ্রাম। এ চেষ্টা কোথাও দল বেঁধে, কোথাও দলছুট একাকিত্বে, কোথাও পারিবারিক ঐক্যের মধ্যে, কোথাও বা সেই কালের নিয়মে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে। সূত্রপাত ঘটে বিভিন্ন সামাজিক জটিলতার। নবজীবন কলোনির অন্যতম যোদ্ধার সামনে যখন লোভনীয় চাকরির হাতছানি, তখন থেকেই সমষ্টি ও ব্যক্তির মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত; ব্যালকনি থেকে ক্যামেরার প্রথমে নতদৃষ্টি, পরে ঊর্ধ্বমুখী দৃষ্টিপাতের মধ্যে দিয়ে এই বিচ্ছেদরেখাটি সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকট হয়ে উঠেছে নবজীবন কলোনির ঈশ্বর ও ছাতিমপুরের ম্যানেজার ঈশ্বরের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে ছিন্নমূল সমস্যা। জীবনের সঙ্গে জড়ায় বিষাদময়তা, নানামুখী সংগ্রাম, কামনা ও মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাত! বাস্তব, রূপক, সংকেত- এই সিনেমাকে দিয়েছে অন্যমাত্রা। দেশভাগ নিয়ে ঋত্বিক ট্রিলজির অন্যতম এই ‘সুবর্ণরেখা’।
ঋত্বিক তাঁর সময়ের থেকে এগিয়েছিলেন প্রায় এক দশক। আর তার জন্যই ঋত্বিকের অন্ধকার, অসম্পূর্ণ জায়গাগুলো দুনিয়ার কাছে আজও আলোচনার, রহস্যের। আসলে ঋত্বিক এক অথৈ, যার নাগাল পাওয়া চুনোপুঁটি বাঙালির কর্ম নয়! যদিও বাংলার ঋত্বিকচর্চা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ করার নামে 'নমো নমো' করে হয়তো ঋত্বিক-মর্যাদার দায় সারছে বঙ্গবাসী। অসম্পূর্ণতাতেই সম্পূর্ণ ছিলেন যে মানুষ, কাঁটাতার না-মানা, সীমাহীন এক অনন্ত সময়ের ডাকনাম হয়েছেন যে ঋত্বিক, তাঁর সঙ্গে এই ২০০০ পরবর্তী বাঙালির যোগ কোথায়? বরং ঋত্বিককে ভুলতে পারলেই অনেক প্রশ্নের ডালপালা ছেঁটে এগোতে পারে মানুষ, শিকড়হীন।