একটুর জন্য ফসকাল বিশ্বকাপ! তীরে এসে তরী ডোবার সে দুঃখ আজও ভোলেনি বাঙালি
Cricket World Cup 2003: ফাইনালের মঞ্চে দুরন্ত ফর্মে থাকা জাহির খান এবং জাভাগল শ্রীনাথ দু’জনেই চূড়ান্ত ব্যর্থ হলেন। অস্ট্রেলিয়ার দুই মারকুটে ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও ম্যাথিউ হেডেন ঝোড়ো শুরুটা করেই দিয়ে গিয়েছিলেন।
ইংল্যান্ডের কাছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনালে লজ্জাজনকভাবে হেরেছে ভারত। কোনও উইকেট না হারিয়েই মাত্র ১৬ ওভারে ভারতের দেওয়া টার্গেট তুলে নেয় ইংল্যান্ড। স্বাভাবিকভাবেই সর্বত্র সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন রোহিতরা। বারবার প্রশ্ন উঠছে রোহিত শর্মার অধিনায়কত্বের ওপর। অনেকে আবার একই সঙ্গে দাবি করেছেন, রাহুল দ্রাবিড়কে কোচের পদ থেকে সরিয়ে দিতে। আসন্ন নিউজিল্যান্ড শহরে রোহিতের বদলে অধিনায়ক করা হয়েছে হার্দিক পাণ্ড্যকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ভারতের সম্পূর্ণ কোচিং স্টাফকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে বিসিসিআই। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে এই হারের ফলে টিম ইন্ডিয়ার অন্দরমহলের অবস্থা বেশ থমথমে। ২০১৪ থেকে কোনও আইসিসি ট্রফি জেতেনি ভারত। অনেকেই তাঁদের নতুন চোকার্স হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছে। তবে এই হারের বহু আগে এরকম আরও একটি পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল মেন ইন ব্লু-কে। সেবার বিশ্বকাপের আরও কাছে, ফাইনালে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল ভারতকে। ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল এখনও সমর্থকদের মনে দগদগে ঘা হয়ে রয়েছে। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতোই ২০০৩ আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপে দুরন্ত পারফর্ম করেছিল ভারত। সেবার ফাইনালের আগে পর্যন্ত কার্যত অশ্বমেধের ঘোড়া ছিল সৌরভ গাঙ্গুলি অ্যান্ড কোম্পানি।
১৯৮৩ সালে বিশ্বজয়ের পর ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হতে ভারতের সময় লেগেছিল সুদীর্ঘ ২৮ বছর। ২০১১ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারত দেশকে উপহার দিয়েছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হওয়ার স্বাদ। কিন্তু ঠোঁটে ট্রফির ছোঁয়ার মতো মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল তার বছর আটেক আগেই। ২০০৩ বিশ্বকাপ। সেবার কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছিল বিশ্বকাপ। ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব করছিলেন প্রাক্তন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি। ১৪ দলের সেই টুর্নামেন্টে আইসিসির পূর্ণ সদস্য ছাড়াও অ্যাসোসিয়েট দল হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিল কেনিয়া, কানাডা, নামিবিয়া ও নেদারল্যান্ডস। ২ টি গ্রুপে ভাগ করে রাউন্ড রবিন ফরম্যাটে খেলা হয় বিশ্বকাপটি। এ গ্রুপে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জিম্বাবয়ে, নেদারল্যান্ডস ও নামিবিয়া। বি গ্রুপে ছিল শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কানাডা ও কেনিয়া। সেখান থেকে পয়েন্টের ভিত্তিতে দু’টি গ্রুপের শীর্ষে থাকা তিনটি করে মোট ছয়টি দল সুপার সিক্সে জায়গা করে নেয়। সেখানে আবার সবাই সবার সঙ্গে খেলে। পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষে থাকা চারটি দল খেলে সেমিফাইনাল।
আরও পড়ুন- টি-টোয়েন্টি মানেই চমক! ফিরে দেখা কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের সেরা অঘটনগুলি
২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে সৌরভের ভারত অনেক বেশি ধারাবাহিক ছিল। শুরুটা ভালো না হলেও, পরপর টানা সাতটি ম্যাচ জিতে ফাইনালে পৌঁছেছিলেন সচিনরা। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জয় পেলেও, ২০৩ রানেই শেষ হয়ে যায় ভারতের ইনিংস। বোলারদের দুরন্ত পারফরমেন্সে জয় তুলে নেন সৌরভরা। দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে একপেশেভাবে হেরে যায় ভারত। ব্যাট করতে নেমে ব্রেট লি এবং গিলিস্পির দাপটে মাত্র ১২৫ রানে গুটিয়ে যায় ভারত। জবাবে ব্যাট করতে নেমে এক উইকেট খুইয়ে ম্যাচ পকেটে পুরে নেয় অস্ট্রেলিয়া। তবে এরপর দুরন্ত কামব্যাক করে ভারত। টানা সাতটি ম্যাচ জিতে ফাইনালে পৌঁছে যায় তারা। গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সচিন তেন্ডুলকারের ৯৭ রানের ইনিংস আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে রয়েছে। সেই বিশ্বকাপে ৬৭৩ রান করেছিলেন সচিন তেন্ডুলকার। এই বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছিলেন ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি (৪৬৫)। কোনও নকআউট ম্যাচে তিনিই প্রথম অধিনায়ক হিসেবে সেঞ্চুরি করেন (সেমিফাইনালে কেনিয়ার বিরুদ্ধে)। বল হাতে বিপক্ষকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল জাহির খান, জাভাগল শ্রীনাথ এবং আশিস নেহরার ত্রিফলা আক্রমণ।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠার পথে একটা মাত্র ম্যাচে হেরেছিল ভারত। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। তাই ফাইনালেও যখন প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, তখন টস জিতে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠিয়ে তিনি স্পষ্ট বার্তা দিলেন, তাঁরা অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথিউ হেডেন, রিকি পন্টিং সম্বলিত ব্যাটিং লাইনআপকে মোটেই ভয় পান না। তবে ফাইনালের মঞ্চে দুরন্ত ফর্মে থাকা জাহির খান এবং জাভাগল শ্রীনাথ দু’জনেই চূড়ান্ত ব্যর্থ হলেন। অস্ট্রেলিয়ার দুই মারকুটে ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও ম্যাথিউ হেডেন ঝোড়ো শুরুটা করেই দিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরের মঞ্চটা জুড়ে শুধু পন্টিং ম্যাজিক। ১২১ বলে ৪টি চার ও ৮টি ছক্কার সাহায্যে অপরাজিত ১৪০ রানের ক্লাসিক ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন রিকি পন্টিং। ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৩৫৯ রানের বিশাল স্কোর। যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমীই জানেন, ফাইনালের মঞ্চে এরকম বিশাল স্কোর দাঁড় করিয়ে দিলে বিপক্ষ দলের কী মানসিক অবস্থা হয়!
রানের এভারেস্টের সামনে ভারতীয় ব্যাটারদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে প্রথম ইনিংস শেষেই বিশ্বকাপ কার্যত পাকা করে ফেলেছিল অজিরা। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন সচিন তেন্ডুলকার। এই রান কীভাবে তাড়া করা যায় তা সম্পর্কে একটি ফর্মুলা বার করেছিলেন সচিন। পরবর্তীকালে এই সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “লক্ষ্য এরকম বড় থাকলে তাকে ছোট ছোট ভাগ করে অর্জন করতে হয়। আমাদের টার্গেট ছিল ৩৬০ রান। ৫০ ওভারের খেলা প্রতি ওভারে আমরা যদি একটা করে বাউন্ডারি মারি তাহলে ওঠে ২০০ রান। অর্থাৎ ৩০০ বলের মধ্যে ৫০ বলে ২০০ রান উঠে গেল। বাকি ২৫০ বলে আমরা ১৬০ রান ঠিকই করতে পারব, এমন বিশ্বাস নিয়েই ব্যাটিং করতে নেমেছিলাম। কিন্তু তারপর যা হল তা আর বলার মতো নয়।”
আরও পড়ুন- সারাবছর পড়ে পরীক্ষায় ফেল! এই প্রথম নয়, বারবার যেভাবে তীরে এসে তরী ডুবেছে ভারতের
যতই অংক কষে নামা হোক না কেন এত বিশাল রানের একটা পাহাড়প্রমাণ চাপ ভারতীয় ক্রিকেট দলের ব্যাটসম্যানরা আর নিতে পারেননি। ব্যাট করতে নেমে প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে একটি চার মারেন সচিন। পরের বলে আরেকটি ৬ মারতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে বল উঠে যায় এবং গিলক্রিস্ট তালুবন্দি করেন ক্যাচটি। ম্যাচের শুরুতেই ভারতীয় দলের সবচেয়ে বড় ব্যাটসম্যানকে তুলে নেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। এরপর একদিকে বীরেন্দ্র সেহবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলি এবং রাহুল দ্রাবিড় কিছুটা জুটি বেঁধে খেললেও ১৭তম ওভারে বৃষ্টি এসে ম্যাচ থামিয়ে দেয়। বৃষ্টি থামলে রিকি পন্টিং নিয়ে আসেন ড্যারেন লিম্যান এবং ব্যাড হগকে। একদিকে স্পিনার খেলিয়ে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ভুল করার রাস্তা তৈরি করে দেওয়া আরেকদিকে ব্রেট লি, ম্যাকগ্রার বিষাক্ত বোলিং। ক্রমে বাড়তে থাকে রিকোয়ার্ড রেট, এত চাপের মাঝে পড়ে কার্যত পিষে যায় ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত এবং রিকি পন্টিংয়ের হাতে ওঠে বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের এত কাছে এসেও তা অধরাই থেকে যায় ভারতের, রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বলাই বাহুল্য, সেবার যদি ভারত বিশ্বকাপ জিততে পারত, তাহলে তা ’৮৩-র পরে সবচেয়ে বড় সাফল্য হতে পারত ভারতীয় দলের জন্য। সৌরভ গাঙ্গুলির অধিনায়কত্ব একটি বেঞ্চমার্ক তৈরি করেছিল সেই সময় বিশ্বক্রিকেটে, বিশ্বকাপ জিততে পারলে তা আরও পাকাপোক্ত হত। সেবারও কটাক্ষের তির ধেয়ে এসেছিল ভারতীয় দলের এবং দলের অধিনায়কের দিকে। অনেকেই বলেছিলেন, আগের থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি অস্ট্রেলিয়াকে দিয়ে রান তাড়া করানো যেত তাহলে পরিণাম আলাদা হতে পারত। তবে এত কটাক্ষ, এত সমালোচনা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হবে পরবর্তীকালে বীরেন্দ্র সেহবাগ, জাহির খান, যুবরাজ সিং, হরভজনদের মতো বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার উঠে এসেছেন সেই ব্যর্থ দলটি থেকেই।