সারাবছর পড়ে পরীক্ষায় ফেল! এই প্রথম নয়, বারবার যেভাবে তীরে এসে তরী ডুবেছে ভারতের

T20 World Cup: ঠিক কীভাবে আজ হারল ভারত? বারবার তীরে ডুবেছে তরী।

নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা! সারা বছর দারুণ পড়লাম, কিন্তু পরীক্ষায় গিয়ে ফেল! আজকের ভারত বনাম ইংল্যান্ডের সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখে এমনই বলছেন অনেকেই। কেউ কেউ তো বলছেন, এ আসলে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অভ্যাস, বড় টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে বারবার তৃতীয় স্থানেই শেষ করে ভারত। যেখানে লজ্জা বাড়ায় প্রতিবেশী দেশের হঠাৎ উঠে আসাও। আজকেও তার অন্যথা হয়নি। আগামী রবিবার টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে যখন প্রস্তুতি শুরু করেছে পাকিস্তান, ঠিক তখনই হারল ভারত। এই হার ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক রেকর্ড ভেঙেছে। অস্ট্রেলিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়ায় উত্তাপ সৃষ্টি করেছে ভারতের এই লজ্জাজনক পারফরম্যান্স। যার নিদর্শন রয়েছে আগেও। সম্প্রতি এশিয়া কাপেও পিছু হঠতে হয়েছে রোহিত শর্মার নেতৃত্বাধীন দলকে। সেই আলোচনায় আমরা আসব। তবে তার আগে আসা যাক, ঠিক কীভাবে আজ হারল ভারত?

অ্যাডিলেডের এই ম্যাচে প্রথম ব্যাট করতে নামেন রোহিত, বিরাট কোহলিরা। মাত্র ৫ রান করে ক্রিকস ওয়েকসের বলে আউট হন কে এল রাহুল। এরপর খানিকটা হাল ধরেন রোহিত। ২৮ বলে ২৭ রান করে আউট হন তিনিও। বিরাট কোহলির ৪০ বলে ৫০ রান খানিকটা এগিয়ে দেয় টিম ইন্ডিয়াকে। এরপর দলের হাল ধরেন হার্দিক পান্ড্য। ৩৩ বলে ঝোড়ো ইনিংসে করেন ৬৩ রান। ভারতের ২০ ওভারে, ৬ উইকেট খুইয়ে স্কোর দাঁড়ায় ১৬৮।

এরপর ব্যাট করতে নামেন ব্রিটিশ ক্রিকেটাররা। প্রথম থেকেই চালিয়ে খেলতে শুরু করেন জস বাটলার এবং অ্যালেক্স হল। কিন্তু সময় গড়াতেই দেখা যায় ভারতের অবস্থা নাস্তানাবুদ করছেন এই দুই ওপেনার। ঝড়ের মতো উড়িয়ে দিচ্ছেন একের পর বল। আর পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন মহম্মদ সামি, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, ভুবনেশ্বর কুমাররা। কাজে দিচ্ছে না অর্শদীপ সিং, হার্দিক, অক্ষর প্যাটেলের বলেও বাগে আনা যাচ্ছে না ইংল্যান্ডকে। এদিকে একের পর এক ক্যাচ মিস, মাঠে দুর্দান্ত খারাপ ফিল্ডিংয়ের ছবি দেখে রীতিমত হাসির রোল উঠেছে সোশ্যাল দুনিয়ায়। কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন প্রায় শেষের পথে। হলও তাই, একটিও উইকেট না হারিয়ে, ১৬ ওভারেই ১৭০ রান করে, বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অনায়াসে জিতে গেলেন জস বাটলাররা। এই হারে কেউ কেউ বলছেন, কান্না নয় আজ হাসি পাচ্ছে বেশি। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে ভারতের কাছে ভারতের হার মন্তব্যও। কারণ, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক। আর তাঁর শাসনাধীন দেশের ক্রিকেট দলের সঙ্গে খেলে হেরেছে ভারত, একথাও বলছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন: একেই বলে বিরাট উত্থান! কোণঠাসা বিজ্ঞাপনের ‘মহারাজা’?

কিন্তু একাধিক ভালো খেলা, জীবন বাজি রেখে দেশের সম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত হওয়া ভারতীয় দলের কপাল সঙ্গ দেয়নি মাঝে মাঝেই। একাধিকবার, ভারতকে টুর্নামেন্ট ছাড়তে হয়েছে শেষ মুহূর্তে। বাজে পারফরম্যান্স, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়া, কৌশলের ঘাটতি, অতিরিক্ত মনোবলের জন্য এরকম হার হয়েছে ভারতের। আবার প্রবল লড়াই দিয়েও হেরেছে ভারত। তবে আজকের এই হারকে লজ্জাজনক বললেও কম বলা হবে, এমনও বলছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ। আর এখানেই উঠে আসছে ইতিহাস। উঠছে স্মৃতিও।

২০০০
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৪৫ রানে হারল ভারত। যদিও সেটি ছিল একদিনের ম্যাচ। সনথ জয়সূর্যদের দাপটে, প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে, মাত্র ৫ উইকেট হারিয়ে সেদিন ২৯৯ রান করে শ্রীলঙ্কা। এর জবাবে শারজায় তপ্ত আবহাওয়ায় উত্তাপ দেখাতে ব্যর্থ হয় ভারত। মাত্র ৫৪ রানে ১০ উইকেট হারায় ভারত। রেকর্ড রানে হারে এই দল। কোকাকোলা চ্যাম্পিয়ন ট্রফির ফাইনালে অনায়াসে যেতে শ্রীলঙ্কা। ট্রফি যায় তাদের হাতেই। এর হারের পর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। সেই ম্যাচে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় করেন মাত্র ১ রান। আর সচিনের ব্যাটে ভর করে আসে ১০।

২০০৩
ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল। পুরো টুর্নামেন্ট ভালো খেলল ভারত। ফের কপিল দেবের ১৯৮৩ এর ইতিহাসের সামনে দাঁড়ালেন সৌরভ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ব্যর্থ হল ভারত। একের পর এক বিখ্যাত ব্যাটসম্যানেরা রান পেলেন না সেদিন। অস্ট্রেলিয়ার করা ৫ উইকেট হারিয়ে ৩৫৯ রানের বিরুদ্ধে ভারত শেষ হল মাত্র ২৩৪ রানে। রিকি পন্টিংয়ের সামনে হারতে হল বাংলার মহারাজকে।

২০০০
২৫ নভেম্বর। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে (Eden Gardens) দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ফের লজ্জার হার হল ভারতের। ১০ উইকেটে সেদিন জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সব উইকেটে হারিয়ে সেদিন ভারতের রান ছিল ১৮৮। আর এর জবাবে একটি উইকেট না খুইয়ে অনায়াসে জয় পায় প্রতিপক্ষ। গ্র্যামি স্মিথ আর অ্যান্ড্রু হলের দাপটে হারে ভারত।

২০০৭
এই বছরের ১৭ মার্চ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচ। সেদিন ভারতের ১৩০ কোটি জনতা কেঁদেছিল লজ্জার হারে। ভারত হেরছিল প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের কাছে! আর সেই হারের ফলে 'বন্ধু' বাংলাদেশীদের একাংশের উদ্যম উল্লাস বেদনার্ত করেছিল এই দেশকেও।

সেদিন পোর্ট অব স্পেনে প্রথম ব্যাট করে ভারত। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় করেন ৬৬ রান। যুবরাজ সিংয়ের ৪৭ রানে ভর করে সেদিন ৪৯ ওভার তিন বলে, সমস্ত উইকেট হারিয়ে ভারতের স্কোর দাঁড়ায় মাত্র ১৯১। এর জবাবে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। বোলারদের দাপটের মতোই ব্যাটিংয়েও ভালো করেন বাংলাদেশের তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহমানরা। মাত্র ৫ উইকেট হারিয়ে দু'ওভার বাকি থাকতেই যেতে ভারত।

যে হারের সঙ্গে সঙ্গেই সেবার বিশ্বকাপের স্বপ্ন শেষ হয়েছিল দেশের। সেই লজ্জার স্মৃতি নিয়েই ঘরে ফিরেছিলেন, বিসিসিআই-এর বিরাট বেতনের ভারতীয় ক্রিকেটাররা।

২০১৭
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (ICC Champions Trophy) । বিপক্ষে পাকিস্তান। ১৮ জুনের সেই ম্যাচ হয়েছিল দ্য ওভালে (Oval)। সেদিন প্রথমে ব্যাট করতে নামে পাকিস্তান। ভারতের বোলারদের বিপুল ব্যর্থতায় পাকিস্তান তোলে ৩৩৮ রান। জবাবে ভারতের রান থামে ১৫৮ -য়! সমস্ত উইকেট হারিয়ে বিদায়লগ্নে তখন ভারতীয় ক্রিকেট সৈনরা। ফকর জামান, হাসান আলিদের দাপটে ধ্বস নামে টিম ইন্ডিয়ায়। শুধুমাত্র রুখে দাঁড়ান হার্দিক। করেন ৭৬ রান। শূন্য রানে আউট হন রোহিত শর্মা। ব্যর্থ হন বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা।

২০২০
ফের ২০০৩-এর স্মৃতি ফিরিয়ে আবার লজ্জাজনক হারের মুখোমুখি হয় ভারত। বিপক্ষে সেই অস্ট্রেলিয়া। যদিও এটি ছিল টেস্ট ম্যাচ। ডিসেম্বরের ১৯ থেকে ১৯ তারিখের সেই ম্যাচ ছিল, শুক্রবারের সেই অ্যাডিলেডেই। ওই খেলায় পর্যুদস্ত হয় ভারত। ম্যাচের ধরণের বদল হলেও হারায় কিন্তু সেবারও অস্বস্তিতে পড়েন ক্রিকেট দলের সদস্যরা।

২০২১
দুবাইয়ের (Dubai) তপ্ত ভূমিতে তখন করোনাকালে বন্ধ থাকা ক্রিকেট ফিরেছে আবার। ফের রীতি ভেঙে পরপর দু'বার অনুষ্ঠিত হয় টি২০ বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট। ২৪ অক্টোবর। দুবাইয়ের মাঠে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে হারে ভারত। বিপক্ষে সেই পাকিস্তান। যেমন তেমন হার নয়, সেই হার ছিল ১০ উইকেটে! প্রথমে ব্যাট করতে নেমে সেদিন ৭ উইকেট হারিয়ে ভারত করে ১৫১ রান। আর মাত্র ১৭ ওভার ৫ বলে, একটিও উইকেট না খুইয়ে মহম্মদ রিজওয়ান, বাবর আজমরা তুলে নেন ১৫২। সেই হার প্রশ্ন তুলেছিল সেদিনও। সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছিলেন সামিরা।

২০২২
এশিয়া কাপে বিপর্যয়। ২০১৬, ২০১৮ এর অসাধারণ জয়ের স্মৃতি নিয়ে এই টুর্নামেন্টে নামে টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু বিপর্যয়ের ফলে বিচ্ছেদ ঘটে পুরো টুর্নামেন্ট থেকেই। গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় পেলেও সেই পাকিস্তানের কাছেই সুপার ৪-এর ম্যাচে ৫ উইকেটে হারতে হয় ভারতকে। প্রায় নিশ্চিত হয় বিদায়। পরে নানান হিসেবনিকেশ করেও আর ফেরেনি ভারত।

এরপরেই উদ্যম আর কোটি কোটি সমর্থকের সমর্থন নিয়ে খেলতে নেমেছিল দেশ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রতিশোধ নেওয়া ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিরাট কোহলির দারুণভাবে ফিরে আসা। সূর্যকুমার যাদবের ভালো খেলা, রাহুল দ্রাবিড়সুলভ প্রশিক্ষণ। সব ছিল ভারতের ক্রিকেট দলের কাছে। কিন্তু আসল মঞ্চ? সেখানেই ফের হারতে হল দেশকে। যে হার লড়াই তো দূর, সামান্য ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার পরেও নয়। সম্পূর্ণ যেন এক বিপক্ষের সুনামির কাছে সঁপে দেওয়া নিজেদের। যেন বলে দেওয়া ইচ্ছা নেই, তোমরাই যাও ফের! ব্রিটিশদের ঠেলে দেওয়া জয়ের দিকে! আর এই প্রশ্নেই উদ্বেল সোশ্যাল দুনিয়া। প্রশ্ন আর জল্পনা, বিতর্কে ময়নাতদন্তের টেবিলে শায়িত রোহিত শর্মাদের পারফরম্যান্স!

More Articles