বিষাদ নয়, 'বৃদ্ধাশ্রম'-এর পুজো জমজমাট বয়স্কদের জীবনের উদযাপনে

Durgapuja 2022: নিউটাউনের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা লজ্জায় ফেলবেন তরুণদের। কেমন হলো 'স্নেহদিয়া'-র পুজো?

ওঁরা আড্ডায় সুর করে এবারের পুজোর থিম গান ধরেছেন: 'কে বলে গো প্রবীণ মোরা, নবীন কম কীসে/ এমনি করে ছন্দে-গানে থাকি মিলেমিশে।' সঙ্গে নাচ।

নতুন এবং স্মার্ট শহর নিউটাউনে একটি রাস্তার এপারে 'স্নেহদিয়া', আর ঠিক ওপারে 'স্বপ্নভোর'। হিডকো-র  অন্যান্যগুলির মতোই দু'টি অতীব যত্নে লালিত প্রকল্প। একটি ক্লাব, অন্যটি তাঁদের বসবাসের। আমরা বলি, বয়স্ক মানুষের সুখের ঠিকানা। প্রতিটি মুহূর্তে একরাশ খুশি নিয়ে চনমনে থাকার ঠিকানা। কিন্তু ওঁরা যে নিজেদের এক মুহূর্তও বয়স্ক ভাবেন না, ভাবেন না বয়স হয়েছে বা বয়স বেড়ে চলেছে। আর সেটাই ওদের জীবনীশক্তি ধরে রাখার মূলধন‌। সারাটা বছর ধরে  কীভাবে ছন্দে-সুরে-গানে মিলেমিশে থাকেন, একবার এসে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।

এই নিয়ে চার-চারবার তাঁরা দুর্গাপুজোর মতো এক দক্ষযজ্ঞকে হাসিমুখে নির্বিঘ্নে, নিখুঁতভাবে সেরে ফেললেন। সঙ্গে অবশ্যই ছিল হিডকো-র সর্বাত্মক সহায়তা। শুধু ওই চারদিন নয়, কয়েক মাস ধরে চলল তার প্রস্তূতিপর্ব। অনেকের নাওয়া-খাওয়ার সময়ই চলে গিয়েছিল। কুমোরটুলিতে গিয়ে প্রতিমার বায়না দিয়ে যে কর্মযজ্ঞর শুরু, তা শেষ হলো দশমীতে নিউটাউনেরই স্নিগ্ধ বিসর্জন ঘাটে গিয়ে গিয়ে ধুনুচি নাচে বিসর্জনে। হ‍্যাঁ, তালে তাল মিলিয়ে শরীর রীতিমতো দুলিয়ে হাতে হাত ধরে তাঁরা যখন বিসর্জন ঘাটে নৃত্যরত, পাশের অতি তরুণ-তরুণীরা বিস্মিত হচ্ছিলেন ওদের মতো বনস্পতিদের দিকে তাকিয়ে। যেন 'আয় সবে বেঁধে বেঁধে থাকি'।

Durgapuja in Newtown

'স্নেহদিয়া'-র সকলে, সঙ্গে লেখক (বাঁদিকে)

এবারের পুজোতে কী করেননি ওঁরা ? কাজের ফাঁকে  ফাঁকে আড্ডায় ভরিয়ে দিয়েছেন মণ্ডপ। সঞ্জয় ঢাকি এসেছিল সুদূর মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে, তার পালক দোলানো ঢাক নিয়ে আর মাথায় ঝাঁকড়া লম্বা ঢেউখেলানো চুল নিয়ে। চুল নাচিয়ে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিত্য নাচলেন ওঁরা আরতির সময়। সন্ধিপুজোর দীর্ঘ ফর্দ আর নিত্যদিনের ফলমূল, ফুল-মিষ্টি সাজিয়ে নৈবেদ্য সাজানো থেকে সকলকে  প্রসাদ বা মহাপ্রসাদ বিতরণ করলেনও নিজেরাই। পুষ্পাঞ্জলিতে ছিল মন আর ভক্তিভরে প্রণাম। পূজারী এসেছিলেন শেওড়াফুলি থেকে। যেমন‌ তাঁর পবিত্র সংস্কৃতে মন্ত্র উচ্চারণ, তেমনই তার মাধ্যমে  প্রত্যেকের মধ্যে ভক্তি সঞ্চারিত করা- সবাই যেন তাতে উজ্জীবিত হয়ে উঠছিলেন প্রতিদিন অঞ্জলি দানে।

প্রতি সন্ধ্যায় তাঁরাই যখন আবার সামনের সংস্কৃতি  মঞ্চে আগমনী গান ধরছিলেন বা আবৃত্তি করছিলেন  'মধু-বিধু দুই ভাই', শ্রুতিনাটকে তুলে ধরছিলেন  প্রবীণদের সমস্যা ও সমাধান, গিটারে সুর বাজাচ্ছিলেন 'ওগো তুমি যে আমার...', বা নজরুল ইসলামের লেখা ভক্তিগীতি গাইছিলেন- অবাক হওয়া ছাড়া আর কী হতে পারে। না, একদিনও কোনও নামী অতিথি শিল্পী ধারেকাছেও ছিল না। এ যে প্রবীণদের দ্বারা ,প্রবীণদের জন্য, প্রবীণদের পুজো।

নবমীর মধ্যাহ্নে ছিল একেবারে পাত পেড়ে নিরামিষ-আমিষ উভয় ভোজনের সুব্যবস্থা। এও তো ওঁদেরই পরিকল্পনায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। সাড়ে ছশো সদস্য গল্পে-গুজবে ভরিয়ে তুললেন কমিউনিটি লাঞ্চের বিশাল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর। ঢেকুরও তুললেন এই বলে, 'জয় জয় দুর্গা মায় কি জয়...। আসছে বছর, আবার হবে।'

মাইকে মাঝে মাঝেই ঘোষণা, 'যাঁরা এখনও আসেননি, চলে আসুন তাড়াতাড়ি খেতে' বা 'সুস্মিতা, তুমি যেখানেই থাকো, তবলাবাদককে খবর দাও, আজ  তাড়াতাড়ি  অনুষ্ঠান শুরু হবে', '২৫টা নারকেলের নাড়ু তৈরি হচ্ছে ভিয়েনে, কেউ গিয়ে একটা ছবি তুলে রাখো', 'মায়ের ভোগ রান্না হয়ে গেছে, কিচেন থেকে শাঁখ আর ঢাক বাজিয়ে  মায়ের সামনে নিয়ে এসো।' বড় একটা ছাতা যেন সঙ্গে থাকে, 'যান প্লিজ, সুদীপ্ত, মহান্তিবাবু এব‌ং আরও ক'জন' বা 'স্যুভেনিরে যারা  এখনও লেখা দেননি, অমুক তারিখের মধ্যে উমাদি বা  উজ্জ্বলবাবুর হাতে দিয়ে দিন', 'এবার শীতল ভোগ বিতরণ শুরু হবে, সবাই নিজের জায়গায় বসুন...'- প্রতিদিনের এমন সব অজস্র ঘোষণা আর ঢাক আর কাঁসির বাদ্যি মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে যাচ্ছিল স্নেহদিয়া অ্যাক্টিভিটি সেন্টার, তখন তপন, পাইন বা দেবনাথবাবু, তরুণবাবু, ভাস্করবাবু, সাহাবাবু‌, মজুমদার বা পালিতবাবু, চ্যাটার্জিবাবু, মহেশবাবু বা পূরবীদি, তুলিরেখাদি, তপতীদি, মিঠুদিরা মণ্ডপের সামনে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিয়েছেন আয়েশ করে, কাজের শেষে। বরুণবাবু ঢুকছেন তড়িৎগতিতে, হাতে তাঁর আগামী দিনের ভোগের মিষ্টি।

প্রবীণদের (পড়বেন নবীনদের) শারদোৎসবের  দিনগুলো যেভাবে রঙিন হয়ে উঠল, তাতে তাঁরা কেবলই ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন স্মৃতির লম্বা দড়ি বেয়ে একেবারে শৈশবে। ফিরে পাচ্ছিলেনও তা। তাঁদের দিনগুলো যেন চারপাশের শুভ্র শরতের সাদা মেঘের ভেলায় এলোমেলো হয়ে‌ উড়ে উড়ে যাওয়া। আর  একটি একটি করে রঙিন পাথর কুড়িয়ে নেওয়া টুপটাপ শব্দে।

থিম গানের শেষ কলিদুটো ওই সুরেই যে লেখা। তাদের  সে গান গাওয়া শেষ হয়, তাই:

জীবনজুড়ে স্বপ্নসুখের রঙিন সেসব দিন
মায়ের কাছে প্রার্থনা এই, তাই ফিরিয়ে দিন

More Articles