মনে পড়ে সজল বারুইকে? রং-তুলি ছেড়ে কেন বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল এই কিশোর?

আইনের চোখে সজল অপরাধী অবশ্যই। কিন্তু তাকে অপরাধী বানাল কে? তার জন্য কি দায়ী তার বাবা-মায়ের অকথ্য অত্যাচার, যা তাকে ঠেলে দিয়েছিল অপরাধের অতল গহ্বরে?

১৯৯৩ সালের ২২ নভেম্বর। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে। কর্মক্লান্ত কলকাতা দিনশেষের সূর্যের আলো মেখে হয়ে উঠেছে আরও সুন্দরী। ক্লান্ত, শ্রান্ত কলকাতা সন্ধের নিয়ন আলো গায়ে মেখে চাইছে বিশ্রাম। এমনই এক অবসন্ন দিনের শেষ বেলায় দমদমের বুকে ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। যা শুনে শিউরে উঠল শহর কলকাতা, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শহরের তাবড় অপরাধ-বিজ্ঞানীদের। মাত্র ষোলো-সতেরো বছরের একটি ছেলে নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা কলকাতাকে।

সজল বারুই। তাকে কি মনে রেখেছে কলকাতা? অপরাধ নিয়ে যাঁরা চর্চা করে থাকেন, তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে সজল বারুইয়ের কথা। হয়তো আগের প্রজন্মের কিছু মানুষের স্মৃতিতে এখনও গেঁথে আছে দমদমের সেই রাতের কথা, এখনও হয়তো সেইসব মানুষের ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয় সজল বারুই। ১৯৯৩ সালের ২২ নভেম্বর যে সজল খুন করেছিল তার বাবা, সৎ মা, এবং ভাইকে। সজলের বয়স তখন কত? মাত্র ষোলো বছর এগারো মাস। কিন্তু কেন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড? কোন কারণে সজলের মতো কিশোর তলিয়ে গেল অপরাধজগতের চোরাবালিতে? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েকটা বছর।

সজলের বাবার নাম ছিল সুবল বারুই। মা ছিলেন নিয়তি বারুই। সজলের বয়স তখন মাত্র আট। না, শৈশবকে উপভোগ করার কোনও সুযোগ জোটেনি অভাগা সজলের কপালে। কারণ সেই ছোট্ট বয়সেই বাবা সুবল এবং মা নিয়তির বিবাহবিচ্ছেদের সাক্ষী ছিল সে। সেই ঘটনার পরে সুবল মিনতি নামের এক মহিলাকে আবার বিবাহ করে। সুবল ও মিনতির একটি সন্তানও হয়। আর এর ঠিক পরেই শুরু হয় সজলের ওপর অকথ্য অত্যাচার। সেই অত্যাচার যেমন অকালে কেড়ে নিয়েছিল সজলের শৈশব, তেমনই সজলের মনে বপন করে দিয়েছিল অপরাধের বীজ।

আরও পড়ুন: কোটি টাকার ফ্ল্যাট, রাস্তায় ভর্তি বেকার! কলোনির জীবন যেমন

২২ নভেম্বর ১৯৯৩। সজলের বয়স তখন মাত্র ষোলো বছর এগারো মাস। সৎ মা এবং বাবার অত্যাচার ততদিনে মাত্রা ছাড়িয়েছে। ঠিক এমনই সময়ে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এক মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সজল। ২২ নভেম্বর, ১৯৯৩– সজলের মা মিনতি তখন টিভি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। সেই সময়েই সজল ও তার বন্ধুরা মিলে ঘটিয়ে ফেলল ভয়ংকর এক হত্যাকাণ্ড। থুড়ি একটা নয় তিনটে। মাত্র ষোলো-সতেরো বছরের কয়েকটা ছেলের হাত সেদিন লাল হয়ে উঠেছিল রক্তে। না, অপরিকল্পিত নয় এই খুন, অন্তত তেমনটাই মনে হয়েছিল তদন্তকারী অফিসারদের। যথেষ্ট ঠান্ডা মাথায় ঘটানো হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড। কারণ খুনের মূল কালপ্রিটকে খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটেছিল তৎকালীন দুঁদে গোয়েন্দাদেরও। যদিও শেষ পর্যন্ত পুলিশি জেরায় সজল জানায় সেই অপরাধের মূল মাস্টারমাইন্ড। বাবা এবং সৎ মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে এবং তার বন্ধুরা ঘটিয়ে ফেলেছে এই হত্যাকাণ্ড। তারপর এই ঘটনার অভিমুখ অন্যদিকে ঘোরাতে সজলের বন্ধুরা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রেখে যায় সজলকে। শুধু তাই নয়, মাথায় আঘাত করে সজলকে অজ্ঞান করে দেয় তার বন্ধুরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় সজলের এই প্ল্যান। আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে সজল ও তার বন্ধুদের। অদ্ভুত বিষয়, আদালতে দাঁড়িয়েও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখা যায়নি সজল ও তার বন্ধুদের মধ্যে। তারা রীতিমতো হাততালি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল আদালতের এই রায়কে। যদিও পরবর্তী সময় মৃত্যুদণ্ডের এই রায় পরিবর্তিত হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।

এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত সজল বারুইয়ের গল্প। জেলের অন্ধকার কুঠুরিতেই হয়তো কেটে যেতে পারত সজলের ভবিষ্যৎ জীবনের দিনগুলো। কিন্তু এরপরেও আরও একবার অপরাধ জগতের অন্ধকারে দিক ভুল করে ফেলল সে। আলিপুর জেলে থাকাকালীন শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে সজল ভর্তি হয় ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজে। তারপর সেখান থেকেই পালিয়ে যায় সজল। সালটা ২০০১। সজল চলে আসে মুম্বই। তারপর দমদমের সেই ছোট্ট ছেলেটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সমগ্র মুম্বইয়ের ত্রাস। একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় নাম জড়াতে লাগল সজলের। মুম্বই পুলিশ যখন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সজলকে, ঠিক সেই সময়েয় সজলের মনে শুরু হল বসন্তদিনের আনাগোনা। বানিজ্যনগরীর বুকেই সজলের পরিচয় হয় সিল্কি নামের এক মহিলার সঙ্গে, তাঁকে বিয়েও করে সজল। তখনও সজল মুম্বই পুলিশের হিটলিস্টে। বারংবার নাম পরিবর্তন করতে শুরু করেছে সে- কখনও নাম পালটে সজল হয়ে ওঠে কমল, কখনও বা শেখ রাজু। এরপর আবার কলকাতায় প্রত্যাবর্তন সজলের। সজল তখন পরিণত হয়েছে দুর্ধর্ষ এক গ্যাংস্টারে। যদিও এরপর আর বাংলায় বেশিদিন রাজত্ব চালাতে পারেনি সজল। কিছুদিনের মধ্যেই শেখ রাজু নামে এক চোর গ্রেপ্তার হয়, পুলিশ তাকে সজল বারুই বলে শনাক্ত করে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আমেরিকান সেন্টারের অভিযুক্ত আফতাব আনসারি ও দেবাশিস চক্রবর্তী নামে এক অপরাধীর সঙ্গে যোগসাজশ হয় সজলের, তাকে তখন অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

২০১০ সালে ছাড়া পায় সজল, ২০১১ সালে তাঁকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সজলের মধ্যে প্রতিভার অভাব কিন্তু কোনওদিনই ছিল না, ছোট্ট বয়স থেকেই সজল ছিল দুর্দান্ত আঁকিয়ে। বিড়লা আর্ট গ্যালারি, কলকাতা বইমেলা-সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনীও হয় তার আঁকা ছবির। এখন তার একটি ট্যুইটার প্রোফাইলও আছে। সেখানে নিজেকে 'মিডিয়া মেড ভিলেন' বলে পরিচিতি দেয় সে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও প্রশ্ন একটাই। এমন করে কেন হারিয়ে যেতে হয় সজলের মতো প্রতিভাদের? যে হাত রং-তুলি দিয়ে কাব্যের সিমফনি রচনা করতে পারত সজল সেই হাতকেই কেন হতে হল রক্তরাঙা? আইনের চোখে সজল অপরাধী অবশ্যই। কিন্তু তাকে অপরাধী বানাল কে? তার জন্য কি দায়ী তার বাবা-মায়ের অকথ্য অত্যাচার, যা তাকে ঠেলে দিয়েছিল অপরাধের অতল গহ্বরে? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর অমিল। কিন্তু সজলের মতো ছোট ছোট কুঁড়িদের আগলে রাখার দায়িত্ব আমাদের, অপরাধের আগুন যেন তাদের মতো প্রতিভাদের আত্মহননকারী পতঙ্গের মতো পুড়িয়ে ফেলতে না পারে।

 

 

 

More Articles