ভাঙলেন এক দশকের নীরবতা, অতল থেকে এবার উঠছেন সুদীপ্ত-সহযোগী দেবযানী!

বঙ্গের দুর্নীতি-ইতিহাসে দেবযানীই প্রথম মহিলা, যিনি খবরের শিরোনামে এসেছিলেন বিরাট দুর্নীতির ‘মাস্টারমাইন্ড’কে সাহায্য করার অপরাধে। অর্থাৎ অভিযুক্ত হয়েছিলেন দুর্নীতি, মানুষ ঠকানোর কারিগরকে সাহায্যের অভিযোগে।

তেত্রিশ বছর কেটেছে তবুও কেউ কথা রাখেনি! জীবনে কথা না রাখার ভুরি ভুরি উদাহরণ, রাজনৈতিক মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দাবদাহের আবহে খানিকটা ভিন্নভাবে হলেও যেন কথা রেখেছেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়! শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং কোটি কোটি টাকা উদ্ধারে, বন্ধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়েই হয়েছেন জেলবন্দি। বঙ্গ তথা দেশজুড়ে সাজিয়ে দিয়েছেন আলোচনার একথালা মুচমুচে ইস্যু। এই মুখোপাধ্যায়ের আচমকা অস্তিত্বে কি মনে পড়ছে প্রায় একই রকম ঘটনার মুখ সেই মুখোপাধ্যায়কে? যাঁর বৈভব, বিলাসিতা আর দুর্নীতির কালিমা-অভিযোগ একসময় শোরগোল ফেলেছিল দেশজুড়ে। যাঁকে বন্দি করতে উপত্যকা পাড়ি দিতে হয়েছিল রাজ্যের দুঁদে পুলিশকর্তাদের! কার কথা বলছি? আজ থেকে একমাস আগে বললে হয়ত আঁচ করতে পারতেন না। কিন্তু গতকালের ঘটনাপ্রবাহে অতিসহজেই অনুমেয় আমরা দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের কথাই বলছি।

একদা ঢাকুরিয়ার তথাকথিত অপরিচিত মুখোপাধ্যায় পরিবারের এই মেয়েই শোরগোল ফেলছিলেন দেশজুড়ে। ‘সারদা চিট ফান্ড’ দুর্নীতির আবহে জড়িয়ে যায় তাঁর নাম। মূল অভিযুক্ত সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় দেবযানীকে। গত ৯ বছরের একাধিক ঘটনা পরম্পরা সুদীপ্ত সেনকে বারবার সামনে আনলেও দেবযানী থেকেছেন নীরব। আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারে এক কামরার ছোট্ট কুঠুরিতে, পরে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে সাজিয়ে নিয়েছেন বন্দির সংসার। মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন সময়ে সময়ে। স্বাভাবিকভাবেই দেবযানী প্রসঙ্গ আলোচনার অতলে চলে গিয়েছে কালের নিয়মেই। কিন্তু হঠাৎই যেন উল্কাপাতের মতো ফের ফিরেছেন দেবযানী!

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২। ২৬ এপ্রিল, ২০১৩-র ইতিহাস উসকে দিয়ে প্রকাশিত হল এক বিস্ফোরক চিঠি। ঢাকুরিয়ার বাড়িতে বসে দেবযানীর মা শর্বরী মুখোপাধ্যায় দাবি করলেন, কয়েকদিন আগে ২৩/২৪ অগাস্ট নাগাদ দমদমের জেলে গিয়েছিলেন সিআইডি আধিকারিকরা। সেখানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী ৬ কোটি টাকা নিয়েছেন সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে, এ কথা বলার জন্য মেয়েকে চাপ দিচ্ছে সিআইডি। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সাল থেকে দমদম কেন্দ্রীয় জেলে রয়েছেন দেবযানী। এরপরেই রাজনৈতিক ঝড় ওঠে রাজ্য জুড়ে। সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের কিছুদিন আগে লেখা চিঠির সূত্র ধরে, তৃণমূলের বিরোধী দলের নেতাদের ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগে ফের সরব হন বিরোধীরা। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ট্যুইট করে লেখেন, “পিসি-ভাইপোর দারোয়ানে পরিণত হয়েছে এক সময়ের মর্যাদাসম্পন্ন সিআইডি আধিকারিকরা। ওঁদের স্বার্থরক্ষায় অপরাধকে ইন্ধন দিচ্ছে সিআইডি।” সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “একই রকমের চেষ্টা করা হয়েছিল ২০২১-এর নির্বাচনের আগে। সুদীপ্ত সেনকে দিয়ে অভিযোগ করানো হয়েছিল এঁরা, ওঁরা টাকা নিয়েছেন। সেখানে বিমান বসু এবং আমার নামও বলা হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সিআইডিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।” দেবযানীর মায়ের এই বিস্ফোরক অভিযোগের পর সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করা হয়েছে সিআইডির তরফে। যদিও বিতর্ক থামেনি। ফের দেবযানী-অস্ত্রে অস্বস্তিতে পড়েছে রাজ্যের সরকার। বিরোধীদের তরফে আবার চক্রান্ত-অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে তৃণমূল। যদিও সারদাকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ, বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক এই ঘটনায় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রই দেখছেন।

এরপরেই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি বিরোধী নেতাদের ফাঁসিয়ে বর্তমানে দুর্নীতি ইস্যুতে অস্বস্তিতে থাকা শাসকদল খানিকটা বাঁচতে চাওয়ার চেষ্টা করছে? সেখানেই কাজে লাগানো হচ্ছে সিআইডিকে! আর ঘুঁটি করা হচ্ছে দেবযানীকে! দীর্ঘ ৯ বছর পর স্বমহিমায় ফিরে আসা দেবযানী বিতর্ক মাথাচাড়া দেওয়ায় যেমন একাধিক প্রশ্ন এবং জল্পনার সৃষ্টি হয়েছে, এর পাশাপাশি কেউ কেউ খতিয়ে দেখছেন দেবযানী ইতিহাসও। কে এই দেবযানী? কী কারণে আজও জেলবন্দি তিনি? অর্পিতা আবহে কেন আবারও শিরোনামে আর এক মুখোপাধ্যায়? প্রসঙ্গত, বঙ্গের দুর্নীতি-ইতিহাসে দেবযানীই প্রথম মহিলা, যিনি খবরের শিরোনামে এসেছিলেন বিরাট দুর্নীতির ‘মাস্টারমাইন্ড’কে সাহায্য করার অপরাধে। অর্থাৎ অভিযুক্ত হয়েছিলেন দুর্নীতি, মানুষ ঠকানোর কারিগরকে সাহায্যের অভিযোগে।

আরও পড়ুন- কোনও পুরুষই সামলাতে পারেননি কোহিনূর! কোন মন্ত্রে ‘অভিশপ্ত’ হিরের নতুন মালিক হচ্ছেন ক্যামিলা!

ব্যাক টু ২০০৭। ঢাকুরিয়ার পোস্ট অফিস এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দেবযানী সারদা গ্রুপ অব কোম্পানির শেক্সপিয়র সরণির অফিসে যোগ দিলেন একজন সাধারণ রিসেপশনিস্ট হিসেবে। বরাবর সাধারণ থাকা দেবযানী মুখোপাধ্যায় কয়েক বছরের মধ্যেই গেলেন আমূল বদলে। দামি শাড়ি, দামি দামি গয়নার ভারে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া বন্ধ করলেন। রকমারি গাড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙতে লাগল তাঁর প্রতিবেশীদের। বাড়ির কাছের একটি দুর্গাপুজার বাজেট দেবযানী-স্পর্শে ছাড়াল ৫ লক্ষ। সাধারণ দেবযানী হলেন অসাধারণ। সারদা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান, মালিক সুদীপ্ত সেন ঘনিষ্ঠ হলেন মুহূর্তেই। অফিসের রিসেপশনিস্ট থেকে ততদিনে তিনি হয়ে গিয়েছেন কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর! কানাঘুষো শোনা যায়, সারদা কর্তা সুদীপ্ত আর ডিরেক্টর দেবযানী প্রায় দিনই ব্যক্তিগত বিলাসবহুল চেম্বারে গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করতেন। কর্মীদের জন্য ‘স্যার’ সুদীপ্তর অবর্তমানে শেষ কথা বলতেন ‘ম্যাডাম’ দেবযানী। দেবযানী নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না সুদীপ্তর পরিবারের সদস্যরাও। কিন্তু এই সব রহস্যই প্রকাশ্যে আসে মমতা-রাজত্বের ‘আনলাকি থার্টিন’ অর্থাৎ ২০১৩ সালে।

একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলের কর্মীদের ক্যামেরার সামনে কান্না এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকে ২০১১ থেকে বিশাল পরিচিতি পাওয়া বিজনেস টাইকুন, সারদা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান পলাতক। ওই বছরের এপ্রিল মাসে হাজার হাজার মানুষকে এপ্রিল ফুল করে পালান সুদীপ্ত সেন। মুহূর্তেই বন্ধ হয় সারদা। তখনও কুণাল ঘোষের নাম প্রকাশ্যে আসেনি। হাল ধরেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের পাশে দাঁড়াতে ৫০০ কোটির তহবিল গড়েন। টাকা ফেরাতে প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশন গঠন করেন তিনি। দেশের কোন দিকে সুদীপ্ত রয়েছেন তাও বলে দেন মমতা। বিশেষ তদন্তকারী দল গঠিত হয়। অবশেষে গ্রেফতার হন মূল অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন। সঙ্গে দেবযানী মুখোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু, মন্ত্রী মদন মিত্র। তবে এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস। বাম আমলের শেষ পর্ব থেকেই ‘সঞ্চয়িতা চিট ফান্ড কাণ্ডে’র স্মৃতি উসকে দিচ্ছিল সারদা। কম সময়ে বেশি টাকা পাওয়ার টোপে ঘরে ঘরে জাঁকিয়ে বসে এই সংস্থা। সিনেমা প্রযোজনা থেকে খবরের চ্যানেল, সংবাদপত্র, রিয়াল এস্টেট; ব্যবসার প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাড়া জাগায় এই কোম্পানি। মমতার ক্ষমতালাভের শুরুর দিকে এই প্রভাব আরও বাড়ে। ২০০৯ সালে বাম আমলে এই সমস্ত সংস্থা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন তৃণমূল নেতা সাধন পাণ্ডে। ঠিক এর কয়েক বছর পরে, ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর, তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর দুবভিরি সুব্বারাও জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ নেওয়া উচিত এই সমস্ত একাধিক অর্থনৈতিক বেআইনি লেনদেন করে এমন কোম্পানির বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত, সেই সময়েই সারদার প্রভাব পুরোদস্তর। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ক্রমে ক্রমে ভাঙতে থাকে সারদা। ক্রমশ লস করতে করতে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ে এই কোম্পানি। এই আবহেই সারদার মঞ্চে থাকা শাসক নেতা, মন্ত্রীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় সুদীপ্তর।

৬ এপ্রিল, ২০১৩। ১৮ পৃষ্ঠার একটি বিস্ফোরক চিঠি লেখেন সুদীপ্ত সেন। সিবিআইকে লেখা ওই চিঠিতে সারদা কর্তা জানান, তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ ক্ষতির মুখোমুখি হলেও অলাভজনক মিডিয়া ব্যবসায় নামিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়া সহ একাধিক তথ্য ওই চিঠিতে প্রকাশ করেন তিনি।  এপ্রিলের ১০ তারিখ প্রকাশ্যে আসে ওই বিস্ফোরক চিঠি। ভাঙে সারদা। পলাতক সুদীপ্ত আবহেই হাহাকার পড়ে রাজ্য জুড়ে। সম্বল হারিয়ে বিক্ষোভ, আত্মহত্যার ছবি উঠে আসতে থাকে। সব হারান বহু মানুষ। ১৬ এপ্রিল, ২০১৩। কলকাতার সারদা অফিসের সামনে বিক্ষোভে সামিল হন শয়ে শয়ে এজেন্ট। যাঁরা টাকা তুলতেন গ্রামে গ্রামে। ১৮ এপ্রিল, ২০১৩। সুদীপ্ত সেন সহ একাধিক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে সরকার। ২৩ এপ্রিল, ২০১৩। জম্মু ও কাশ্মীরের সন্মার্গ থেকে গ্রেফতার করা হয় সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ সিং চৌহানকে। এর সঙ্গে মমতার তহবিল ঘোষণা, কমিশন গঠনের কথা আমরা আগেই বলেছি।

সারদাকাণ্ডে উদ্যোগী হয়ে বিধানসভার দুই দিনের বিশেষ অধিবেশনে এই সংক্রান্ত বিল পাস হয়, ২০১৩ -এর ৩০ এপ্রিল। পরে জুন মাসেই ত্রুটি-সহ কেন্দ্র থেকে ফেরত আসে ওই বিল। আবার সংশোধনী এনে ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ তারিখে পাস হয় ওই অর্থনৈতিক, বেআইনি লেনদেন সংক্রান্ত বিল। কড়া অবস্থান নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে আসে সরকারি তরফে। কিন্তু খেই হারায় এই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত শুরু করার পরেই। যদিও সুদীপ্ত সেনের চিঠিকে হাতিয়ার করে রাজ্যের পুলিশের উদ্যেগে ২০১৪ সালে গ্রেফতার হন তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ কুণাল ঘোষ।

ততদিনে সারদা দুর্নীতির জাল ছড়িয়েছে অসম, ত্রিপুরা, ওড়িশাতেও। এমনকি বাংলাদেশেও ছড়িয়েছিল সারদা। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির আবহে সারদা পেতেছিল জাল। আর এই জাল পাতার অন্যতম চক্রান্তকারী হিসেবে উঠে আসে দেবযানীর নাম। প্রতারণা, আর্থিক ক্ষতি, বেআইনি সম্পত্তি, আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, চক্রান্তর মতো একাধিক গুরুতর অভিযোগে শতাধিক মামলায় অভিযুক্ত তিনি। তাঁর গ্রেফতারের পর থেকেই ক্রমশ বেড়েছে মামলার বহর। একাধিক মামলায় জামিন পেলেও নতুন কোনও অভিযোগে সিবিআই-কৌশলে আটকে থেকেছেন দেবযানী। যিনি গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। চাকরি করতেন, মাইনে নিতেন এছাড়া আর কিছু জানেন না দেবযানী, এ নিয়ে তেমন কোনও উচ্যবাচ্যও হয়নি আর। সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন এবং শাসকদলের নেতা, মন্ত্রীদের যোগসাজশের তথ্য, ছবি, ভিডিও প্রকাশ্যে এলেও দেবযানী সংক্রান্ত গুরুতর কিছু সামনে আসেনি। সারদা কাণ্ডে অন্যতম চক্রান্তকারী জেলবন্দি দেবযানী মুখোপাধ্যায় থেকেছেন নীরবেই। যদিও প্রথম থেকেই তাঁর পরিবার বলে এসেছে তাঁদের মেয়েকে ফাঁসানো হয়েছে। শুধুই বলির ছাগল করা হয়েছে তাঁকে। বিরাট প্রভাবের অতলে দেবযানী হয়েছেন ঢাল।

আরও পড়ুন- কেষ্টর ‘বীরত্ব’ কেন জাহির করছেন মমতা? কতটা অপরিহার্য বীরভূমের বেতাজ বাদশা

কিন্তু সিবিআইয়ের তদন্ত, একাধিক তথ্যপ্রমাণ বলছে অন্য কথা। জানা যায়, এখনও পর্যন্ত প্রায় ১২৫ টির বেশি মামলা রয়েছে দেবযানীর বিরুদ্ধে। যার মধ্যে অধিকাংশ মামলার অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেনও। এখনও রাজ্যের সিআইডি আরও ৯টি মামলা তাঁর বিরুদ্ধে নিয়ে বসে আছে, সম্প্রতি এই অভিযোগ করেছেন দেবযানীর মা। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, অভিযুক্ত না হয়েও কী ভাবে বছরের পর বছর আদালতেও হেনস্থা হচ্ছেন তিনি? কেন প্রমাণ করতে পারছেন না তিনি নির্দোষ! আসলে টাকা আর ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে একের পর দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন তিনিও, তাই আজও জেলবন্দি দেবযানী। এমন দাবিও করছেন অনেকেই। গ্রেফতারের পর কিছুদিন আলিপুর সংশোধনাগারে মহিলা বন্দিদের বিউটিশিয়ান কোর্স শেখাতেন যে দেবযানী, নিজের মতো করে থাকতেন জেলে, সেই তাঁকেই কি সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে, ৯ বছর কেটে যাওয়ার পরের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, সুদীপ্ত সেনের তরফে লেখা বিরোধী দলের নেতাদের টাকা দেওয়ার দাবিতে ফের নতুন করে ঢাল বানিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে! অনেকেই বলছেন, আর কোনও ভুল করতে চাইছেন না তিনি। দীর্ঘ কয়েক বছরের জেলযাপন আর মামলা-শিক্ষা দেবযানীকে সতর্ক করেছে। আর সেখান থেকেই আগেভাগে নিজেকে সরিয়ে রাখছেন তিনি। নিজের মায়ের মাধ্যমে সেই কাজ করেই ভেসে রইলেন দেবযানী? যা তাঁর ইমেজ বাঁচানোর ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে না দিলেও তিনি নীরব থাকলেও যে আর ফাঁদে পড়ছেন না, এই বার্তাই কি দিয়ে রাখলেন? দেবযানীর চিঠি এবং তাঁর মায়ের দাবি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনায় সিআইডির দোষ প্রমাণিত হলে ঠিক কী হতে পারে, তা বলবে সময়। তবে দেবযানীর প্রকাশ্যে আসা, ফের কি কোনও বার্তা বহন করল?

অতি সূক্ষ্মভাবে হলেও সমগ্র দেবযানী-পর্ব এবং পার্থ, অর্পিতা পর্বের মধ্যে মিল খুঁজে পান কেউ কেউ। কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে লোভের ফাঁদে ফেলে শেষ করেছেন বহু মানুষকে। সর্বশান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন অনেকেই। প্রভাবিত হয়ে প্রভাবশালীর ফাঁদে পড়েছেন এঁরা- এমন অভিযোগে যেমন অভিযুক্ত একপক্ষ। বিপরীতে, শিক্ষিত যুবক-যুবতীকে ঠকিয়ে টাকার বিনিময়ে অন্যকে চাকরি দিয়েছেন। মানুষের কষ্টার্জিত টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দুর্নীতি করে বিলাসিতা করেছেন, এই অভিযোগ আর এক পক্ষের বিরুদ্ধে। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জেলবন্দি অভিযুক্ত অর্পিতা মুখ খুললেও বরাবর চুপ ছিলেন তুলনায় প্রভাবশালী নয়, এমন পরিবারের সন্তান দেবযানী। যিনি সুদীপ্ত আর সারদা-স্পর্শে হঠাৎ হিমালয়সম উচ্চতায় পৌঁছন। সেই চুপ করে থেকে বিতর্ক না বাড়ানোর ভুলটাই কি আর করতে চাইলেন না দেবযানী? দুর্নীতি, চরিত্র, সমাজের সমস্ত খারাপ সত্তার মুখ হয়েছেন বুঝেই এবার প্রায় এক দশক পর ধৈর্য্যশীল দেবযানী ইমেজ বাঁচানোর চেষ্টাই কি করলেন। পরোক্ষে কি সেই প্রভাবশালীদের বলে রাখলেন, “আমি সুদীপ্ত সেন নই, যা বলবেন সেটা আর করছি না, তাতে যা হওয়ার হোক!”

More Articles