পুডিং-এর স্বাদে মজেছিলেন উত্তম থেকে সত্যজিৎ! কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ‘ক্যাফে’ এটিই

Kolkata's oldest cafe : কলকাতার সবথেকে পুরনো ক্যাফেতে আজও লেগে রয়েছে উত্তম কুমার থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি, জানেন কোথায় এটি?

“এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা, হেঁটে দেখতে শিখুন...”, সেই কবেই কবি শঙ্খ ঘোষ আমাদের কলকাতার অলিতে গলিতে হেঁটে দেখার কথা বলে গিয়েছেন। অবশ্য এ কেবল কবির বাণী নয়, জীবনের সার সত্যি। কলকাতার ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ইতিহাসের গন্ধ। যে গন্ধ কখনও আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে যায় উত্তর কলকাতার এঁদো গলিতে কখনও আবার নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ত যানজটে। আর এই ছোটাছুটির মধ্যেই আমরা মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি তখনও অচিরেই আশ্রয় মিলে যায় সাবেকি কোনও ঠেকে।

কলকাতা মানেই পুরনো পুরনো গন্ধ। পুরনো বই, পুরনো রাস্তা, পুরনো বাড়ি, পুরনো মানুষ আর অজস্র পুরনো খাবার। সেইসব খাবারের কোথাও আজও লেগে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। আজকের সময়ে সঙ্গে অবশ্য তুলনায় বিশেষ তল মেলে না এসবের। কিন্তু ইতিহাস যেখানে বর্তমানে সঙ্গে হাত মেলে সেখানে উদযাপন হয় অবশ্যই।

‘ক্যাফে’ আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে খুবই পরিচিত শব্দ। শুধু শহর কলকাতা বলে নয়, শহরতলীতেও বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র ক্যাফে। চা, কফি, তার সঙ্গে কিছু মুখশুদ্ধি আর জমাটি আড্ডার আসর, ক্যাফে বলতে এককথায় এটুকুই। যদিও আজকাল আড্ডার মাঝে ভারী খাবারও রাখা হয়। চাইনিজ, মোগলাই নানা কিছু জুড়ে যায় মেনুতে। আজকাল কলকাতায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্যাফের ভিড়ে রয়েছে অজস্র পুরনো ক্যাফের অস্তিত্বও। যারা বদলে যাওয়ার সময়ের সঙ্গে অচিরেই মিলিয়ে নিয়েছে নিজেদের ইতিহাসকে ধরে রেখেই হয়ে উঠার চেষ্টা করেছে ট্রেন্ডি। হালফিলের চাকচিক্যের ভিড়েই রয়েছে তারা। জানেন এই কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ক্যাফে কোনটি?

আরও পড়ুন - ‘লুচি’ নামের আসল রহস্য কী? জানেন কীভাবে জন্ম হল এই জনপ্রিয় খাবারের?

দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ত জনপদ, হাজারার মোড়। মেট্রো গেটের একদম গায়ে লাগানো সাবেকি বাড়ি। ইট কাঠ পাথরে মোরা আজকের কংক্রিটের শহরে এখানে যেন আজও পুরনো সময়েরা মুখ লুকিয়ে আছে। ব্যস্ত কলকাতার কোনও ফুটপাথে দুম করে যেন দেখা হয়ে যায় কখনও। হয়তো খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। চমকে ওঠেন। আর নিমেষে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো শহরের স্মৃতিরা। নামটিই এ দোকানের চরিত্র। ‘ক্যাফে’ এটুকুই নাম দোকানটির। আগে এবং পড়ে কোন পদবী নেই। কিছু বিতর্ক থাকলেও, ধরে নেওয়া হয়, এটিই কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ক্যাফে।

সময়টা ১৯৩৮। স্বাধীনতা তখনও বেশ দূরে। লড়াইয়ের মন্ত্রে ফুটছে গোটা বাংলা। কলকাতার রাস্তায় তখনই গজিয়ে উঠছে বেশ কিছু খাবারের দোকান। যার একটি এটি। কিছু বিদেশি রেসিপি আর একরাশ স্বপ্ন সঙ্গী করে উত্তর কলকাতার বাসিন্দা অমরনাথ ব্যানার্জি দোকান খুললেন সুদূর ভবানীপুর এলাকায়। এদেশে তখন ক্যাফে শব্দের চল বিশেষ না থাকলেও বিদেশে ছিল, আর সেই ধারা মেনেই এ দোকানের নাম রাখলেন ‘ক্যাফে’। হাজরা মোড়ের কাছে হওয়ায় লোকের মুখে মুখে ক্যাফের নাম হয়ে উঠল হাজরা ক্যাফে। পুরনো গন্ধ, ধোপদুরস্ত দেয়াল সব মিলিয়ে একেবারেই সাদামাঠা দোকানে যেন এক অকৃত্রিম আলো আঁধারির খেলা। আজকের ক্যাফের সঙ্গে তুলনায় যা খাপ খায় না মোটেই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর নেই, সোফা চেয়ার নেই, ক্যাপুচিনো, ক্যাফেমোকা, এসপ্রেসো কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে কেবল ইতিহাসের গন্ধ আর পুরনো খাবারের স্বাদ। এখানে আজও বাঙালি চা অথবা কফির সঙ্গে সঙ্গত করে চিকেন স্টু, ফিশ ফ্রাই, মটন কিংবা চিকেন কবিরাজিরাই।

আরও পড়ুন - ভুল অর্ডার পরিবেশন করাই রীতি! জানেন কোথায় আছে এমন আজব রেস্তোরাঁ?

প্রজন্মের হাত ঘুরে দোকানের বর্তমান মালিক অমরনাথ বাবুর ছেলে সিদ্ধেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। স্মৃতির পাতা থেকে আজও কত কথকতা উঠে আসে এই দোকানের চালচিত্রে। ফ্ল্যাশ ব্যাকে আজও ওই শেষ টেবিলে বসে থাকেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফেলুদার কোনও গল্পের প্লট নিয়ে আলাপ জমান। সত্যজিৎ রায় ভালোবাসতেন এই দোকানের কাটলেট এবং পুডিং খেতে। শুধু সত্যজিৎ রায় একা নন, খান তিরিশেক চেয়ারের কোনওটাতে এসে এককালে বসতেন উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবি, মান্না দের মতন বড় বড় ব্যাক্তিত্বরাও। হাজরা ক্যাফের পুডিং-এর স্বাদ নিয়ে আজও মোহিত কলকাতাবাসী। পুডিং-এর ওপর আলাদা করে ফোম দেওয়া এখানে। যা একেবারে অভিনব। আগের মতন এখনও ব্রয়লার মুরগি এই দোকানে ঢোকে না। দেশি মুরগি দিয়েই সব পদ হয়। রন্ধন প্রনালীতেও বদল হয়নি এতটুকু। তাই হয়তো আরও সহজে ইতিহাস কথা বলে এখানে। ঐতিহ্য পা চেপে ধরে। আর বর্তমানের সঙ্গে দিব্য সমঝোতা হয়ে যায় চিরাচরিত অতীতের।

More Articles