সোনার পদকজয়ী লেখক খুলেছেন 'শিক্ষিত বেকারের ক্যাফে'! কোথায় দাঁড়িয়ে রাজ্যের বেকাররা?
Shikkhito Bekarer Café শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা প্রযুক্তি এবং শিক্ষার ইতিহাসের উপর তিনটি পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন রাজু মণ্ডল
বয়স ২৪, অথবা ২৭, অথবা ৩০। ফাইলে যত্ন করে রেখেছেন ডিগ্রি, শংসাপত্র। রোজ, ঘাম মুছতে মুছতে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন এই দফতর, ওই অফিস। কর্মখালির বিজ্ঞাপনের গোল দাগ। রোজ শুনছেন, বাজার খুব খারাপ। চাকরি নেই। রাজ্য জুড়ে, একটা আস্ত প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের রোজের ঘটনা এটিই। চাকরি খোঁজা, চাকরি না পাওয়া, হতাশ হওয়া। তারপর পেট চালাতে যোগ্যতার চেয়ে অনেক কম কোনও কাজে নামমাত্র বেতনে জুড়ে যাওয়া। শহর কুড়ে গড়ে ওঠা, এমবিএ চায়েওয়ালা, ইংলিশ এমএ চা নামের চমকওয়ালা দোকানগুলি এই গূঢ় সত্যই প্রকাশ করে। এই তালিকাতেই জুড়েছেন রাজু মণ্ডল আর তাঁর শিক্ষিত বেকার ক্যাফে। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে। সেখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অ্যাসবেস্টাসের ছাউনি দেওয়া একখানা দোকান। চাঁদপাড়া স্টেশন রোডের 1, শিয়ালদহ-বনগাঁ লাইনে চাঁদপাড়া স্টেশনের ধারে ছোট্ট গুমটি। কলকাতার ট্রেন ধরতে আসা মানুষদের সকালের জলখাবারের ভরসা তাঁর দোকানটিই। দোকানের নাম শিক্ষিত বেকারের ক্যাফে। এখানে চা, কফি, মোমো, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, চাউমিন, বিরিয়ানি, ডিম রোল এবং একটি রুটি-মাংসের কম্বো পাওয়া যায়। কতটা শিক্ষিত এবং কতটা বেকার এই রাজু মণ্ডল?
টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর দুই ক্ষেত্রেরি স্বর্ণপদক পেয়েছেন রাজু। চারবার নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির ফেলোশিপও পেয়েছেন। রাজ্যের কলেজ সার্ভিস কমিশন পরিচালিত রাজ্য-স্তরের যোগ্যতা পরীক্ষা SET-ও ক্লিয়ার! বাবা পেশায় ছলেন রাজমিস্ত্রি। তাঁর সন্তান রাজু মণ্ডল ২০১৮ সালে ৭৪% নম্বর নিয়ে গাইঘাটা কলেজ থেকে এডুকেশন বিষয়েই অনার্স পাশ করেন এবং তারপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করেন। ২০১৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৭.৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে গাইঘাটা ব্লক থেকে সেরা ছাত্র হন তিনি।
এখানেই শেষ নয়! শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা প্রযুক্তি এবং শিক্ষার ইতিহাসের উপর তিনটি পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন রাজু মণ্ডল যা কল্যাণী, বর্ধমান এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রছাত্রীরা পড়েন। আরও দু'খানি বইও লেখার কাজ শেষ। কোভিডকালে লেখালিখির শুরু তাঁর। তবে তাঁর কাজের লক্ষ্য এটি নয়, অতিরিক্ত উপার্জনের জন্যই এই বই লেখার কাজ করেন তিনি। তাঁর মূল লক্ষ্য গবেষণা এবং শিক্ষকতা। তাহলে সেই পথে না গিয়ে চা-মোমোর দোকান কেন? সেই উত্তরে যাওয়ার আগে দেখা যাক দেশে বেকারত্বের হার কোন দিকে বাঁক নিয়েছে?
আরও পড়ুন- কোটি টাকার ফ্ল্যাট, রাস্তায় ভর্তি বেকার! কলোনির জীবন যেমন
কেন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক শ্রম বাহিনী সমীক্ষার সর্বশেষ প্রতিবেদন (জুলাই ২০২১ - জুন ২০২২) বলছে এই সময়কালে, মাধ্যমিক এবং তারচেয়েও বেশি স্তরের যোগ্যতা রয়েছে এমন সর্বভারতীয় বেকারত্বের হার ৮.৬ শতাংশ। আগের দুই বছরে এই হার ছিল ৯.১ শতাংশ এবং ১০.১ শতাংশে৷ ২০২১-২২ সালে শহরাঞ্চলে ১৫-২৯ বছরের যুবকদের বেকারত্বের হার ১৭.২%। ২০২০-২১ এবং ২০১৯-২০ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ১৮.৫ শতাংশ এবং ১৯.৯ শতাংশ।
এই বেকারদের তালিকাতেই আছেন রাজু মণ্ডল। এবং চিরাচরিত এক জায়গাতে এসেই গোঁত্তা খেয়েছে উত্তর। অর্থ সঙ্কট। পিএইচডি-র ইন্টারভিউ দু'বারের চেষ্টাতেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি রাজু। বাড়িতে টাকার টানাটানি প্রবল। থাকেন ভাড়াবাড়িতে, বাবা পুনেতে পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়িতে বোন আছে, মা আছে। বোনের স্কুলের পড়াশোনার খরচ, রোজের পেট চালানোর খরচ- সব মিলে টাকার দরকার প্রবল। এই সেপ্টেম্বরেই দোকানের গোড়াপত্তন। আশা করছেন মাস গেলে ১৫/২০ হাজার টাকা আসবে। যদিও এতজনের পরিবারা চালাতে সেই টাকা কিছুই না। অথচ এ ছাড়া কোনও গতিও নেই আর।
পড়ানো এবং গবেষণার স্বপ্ন এখনও অটুট। সারাদিনের খাটনি শেষে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর অন্তত দুই ঘণ্টা পড়াশোনা করেন। দুই বছরের জন্য ফেলোশিপ পেয়েছেন, এই দুই বছরের মেয়াদে পিএইচডির ইন্টারভিউয়ে তাঁকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। যতদিন তা না হচ্ছে, তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখবে শিক্ষিত বেকারের ক্যাফে।

Whatsapp
