জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্যেই এলোপাথাড়ি গুলি, রক্তে ভিজল রাস্তা, যে হাড়হিম ঘটনায় শিউরে উঠছে বিশ্ব
Gun Shooting at Los Angeles Chinese New Year : আলোর মালায় ঝলমলে ওই এলাকা। হঠাৎই সেই আনন্দ বদলে গেল কান্না আর আর্তনাদে।
পার্কের আলোর রোশনাই তখন ফিকে হয়ে গিয়েছে খানিকটা। বাইরেই একটি বিশেষ ভ্যানের দিকে নজর সবার। সেদিকে বিস্ময়ের বদলে ভয়ের দৃষ্টি। যেন সেখান থেকে ভয়ংকর কেউ বেরিয়ে আসবে! ভ্যানটার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে পুলিশের দল। গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হাতে বন্দুক। লক্ষ্য সেই ভ্যানটির দিকেই। একটু একটু করে গোটা ভ্যানটি ঘিরে ফেলা হয়েছে। হঠাৎই একটি গুলির আওয়াজ! তারপর… সব চুপচাপ। ভ্যানের ভেতর কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারপর দরজা খোলার পরই বেরিয়ে এল এক বয়স্ক ব্যক্তির মৃতদেহ। হাতে ধরে রাখা বন্দুক; যেখান থেকে গুলি সোজা দেহ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। খানিক আগেই এই বন্দুক আরও বহু মানুষের রক্ত মেখেছে…
২১ জানুয়ারি, শনিবার ছিল চিনা লুনার নববর্ষ। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা চিনা বাসিন্দারা এই দিনটি উদযাপন করেন। আমেরিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসের মন্টেরে পার্কে প্রতিবারের মতো বসেছিল চিনা নববর্ষের আসর। আলোর মালায় ঝলমলে ওই এলাকা। রাতে সবাই সেখানে আনন্দ করছিলেন। হঠাৎই সেই আনন্দ বদলে গেল চিৎকার, কান্না আর আর্তনাদে।
আরও পড়ুন : তালিবানের বন্দুক, প্রকৃতির রক্তচক্ষু…, আর কত দুঃখ সইবে আফগানরা
মেশিনগান হাতে হঠাৎই এক ব্যক্তি বেরিয়ে এল ভিড় থেকে। তারপর এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করল। কাছেই এক রেস্তোরাঁয় দৌড়ে গিয়ে ঢুকল তিনজন। ভয়ে কাঁপছে তাঁরা। একজন মেশিনগান হাতে গুলি চালাচ্ছে। তার কাছে অজস্র কার্তুজ। রক্ত আর চিৎকারে ভেসে যাচ্ছে এলাকা। নববর্ষের মুহূর্ত বদলে গেল হিংসায়। পুলিশ আসার পর সেই ব্যক্তিটিকে দেখা গেলেও ধরা যায়নি। ততক্ষণে ২০২২-এর মে মাসের পর সবচেয়ে ভয়ংকর বন্দুকবাজের হামলা দেখে ফেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১০ জনের রক্তাক্ত, ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ পড়ে রয়েছে মন্টেরে পার্কে, রাস্তায়। গুরুতর আহত আরও কয়েকজন।
1/ #USA
— David Kime (@CyberRealms1) January 22, 2023
There was a shooting in Monterey Park in California, killing 10 people. At least 9 more were injured.
At the time, the neighbourhood was celebrating Chinese New Year. According to police, the attacker is still at large, his motives are unknown. pic.twitter.com/tyCQxBT9Mn
একটা সময় পর পুলিস এসে ওই ব্যক্তিকে ঘিরে ফেলে। ততক্ষণে একটি ভ্যানের ভেতর ঢুকে পড়েছে সে। হাতে তখনও রক্তমাখা মেশিনগান। শেষমেশ পুলিশের হাতে ধরার পড়া এড়াতে নিজের ওপরই গুলি চালায় সেই ব্যক্তি। ভ্যান থেকে তার মৃতদেহ বের করা হয়। পুলিশ জানতে পারে, এই একজনই হামলা চালিয়েছে। বয়সও আন্দাজ ৭২ বছর। কিন্তু কেন এই হামলা? এতগুলো লোকের প্রাণ কেন নিল সে? অনেক আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল? এখনও অন্ধকারে পুলিশ। তদন্ত জারি রয়েছে। অন্যদিকে শনিবারের পাশাপাশি রবিবার, অর্থাৎ ২২ জানুয়ারিও ওই পার্কে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই ঘটনার জন্য সেটি স্থগিত হয়েছে। আমেরিকার পতাকাও অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
আরও পড়ুন : বন্দুকশিল্প এখন বাংলার ‘কুটির শিল্প’? পরপর শুটআউটে উঠছে প্রশ্ন
কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসের এই ঘটনা আবারও একই প্রশ্ন সামনে তুলে আনল। ২০২২-র মে মাসেই টেক্সাসের একটি স্কুলে বন্দুকবাজের হামলায় ২১ জন মারা যায়। আমেরিকার বুকে এগুলো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। সেখানকার হিসেব বলছে, ২০২২ সালে গোটা আমেরিকায় অন্তত ৬৪৭ বার জনসমক্ষে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। স্রেফ গুলি চালানোর ঘটনায় গত বছর আমেরিকায় ৪৪,০০০-এরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। সেটা খুন এবং আত্মহত্যা – উভয়ই। প্রতিদিন ১১০ জন আমেরিকান বন্দুক হামলায় মারা যাচ্ছেন। অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আমেরিকায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ১২ গুণ বেশি। আর বন্দুকবাজের হামলায় মৃত্যুর ঘটনা ২৬ গুণ বেশি! প্রতি বছর অসংখ্য কেস সামনে আসে। যত দিন যাচ্ছে, এই গ্রাফ আরও বাড়ছে। কিন্তু কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পিছনে মানুষের মানসিকতাকে কেবল দায়ী করলে হবে না। দায়ী আমেরিকার অদ্ভুত একটি নিয়ম। আমাদের ভারতে যে কোনও কারোর বাড়িতে চট করে বন্দুক রাখা যায় না। তার জন্য অনেক নিয়মকানুন আছে। কিন্তু আমেরিকায় প্রচুর সাধারণ মানুষ নিজেদের ‘দরকারে’ বন্দুক কেনেন। বন্দুক ও গুলি বাড়িতে রাখেন। কোনও কঠোর নিয়মও নেই সেখানে। সিএনএনের একটি রিপোর্ট বলছে, আমেরিকায় ঠিক কতজনের বাড়িতে বন্দুক আছে, কে কখন কিনছে সেটা বের করা খুব মুশকিল। কারণ, বন্দুক বিক্রির কোনও সুনির্দিষ্ট ডেটাবেস নেই। ২০১৮-র একটি সমীক্ষা বলছে, আমেরিকায় প্রতি ১০০ জন বাসিন্দার মধ্যে বন্দুকের সংখ্যা প্রায় ১২০! যেখানে ইয়েমেনে এই সংখ্যাটি প্রায় ৫৩, আইসল্যান্ডে ৩১।
২০১৭-তে পেউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা বলছে, আমেরিকার প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে অন্তত তিনজন বন্দুক রাখে। এই সংখ্যাটি নিশ্চয়ই এখন বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘বন্দুক সংস্কৃতি’ কি এখনও জারি থাকবে? 'গোলিঁও কা রাসলীলা'র এই মঞ্চে আরও রক্ত ঝরার অপেক্ষা? আর তার ফল ভোগ করবে নিরীহ মানুষেরা? প্রশাসনের দায়িত্ব, নিয়ন্ত্রণও কি একেবারে থেমে গিয়েছে?