ক্ষমাপ্রার্থনা যথেষ্ট নয়! সুপ্রিম কোর্টে রামদেবদের জন্য অপেক্ষা করছে যে বিপদ

Ramdev at Supreme Court: এর আগেও ক্ষমা চেয়েছিলেন রামদেব। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে দ্বিতীয়বার ফের ক্ষমা চেয়েছেন পতঞ্জলিকর্তা বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণন।

বাবা রামদেবের সমস্যা যেন আর শেষই হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই ভুয়ো এবং বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন মামলায় সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়েছে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের। সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা তথা যোগগুরু রামদেবকে আদালত অবমাননার দায়ে সুপ্রিম কোর্টে তলবও করেছিল বেঞ্চ। শেষপর্যন্ত আদালতে সশরীরে হাজিরা দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান বাবা রামদেব। তবে যোগগুরুর ক্ষমাপ্রার্থনাতেও সন্তুষ্ট নয় সুপ্রিম কোর্ট। বরং রামদেবের নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে হলফনামা শুধু একটা কাগজের টুকরো ছাড়া কিছুই নয়, এবার এমনটাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত।

এর আগেও ক্ষমা চেয়েছিলেন রামদেব। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে দ্বিতীয়বার ফের ক্ষমা চেয়েছেন পতঞ্জলিকর্তা বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণন। তবে সেই ক্ষমাপ্রার্থনা সরাসির নাকচ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বাতিল করা হয়েছে হলফনামাও। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট সতর্ক করে দিয়েছে, আরও বড় দুঃখ নাচছে রামদেব ও বালকৃষ্ণের কপালে। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিমা কোহলি জানান, এখন তাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। তাঁদের এই ক্ষমাপ্রার্থনা গ্রহণ করা হচ্ছে না। হলফনামা বাতিলের পর যা হবে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

আরও পড়ুন: পতঞ্জলি মামলায় সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমাপ্রার্থনা আচার্য বালকৃষ্ণের, রামদেব কোথায়?

বরাবরই বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বাবা রামদেব। পতঞ্জলির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়শই বিজেপির নানা নেতা-মন্ত্রীকে দেখা গিয়েছে। সেই বিজেপি ঘনিষ্ঠ রামদেব ও তার সংস্থা যে সুপ্রিম কোর্টে এমন বিপাকে পড়তে পারে, তা কি কল্পনাও করেছিলেন কেউ!

গত নভেম্বরেই সুপ্রিম রায়ে জরিমানার মুখে পড়েছিল রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-এর একটি আবেদনের শুনানি পর্বে মিথ্যা বিজ্ঞাপনী প্রচার পিছু ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হতে পারে বলে মৌখিক ভাবে জানিয়েছিল বিচারপতি আহসানউদ্দিন আমানুল্লাহ এবং বিচারপতি প্রশান্তকুমার মিশ্রের বেঞ্চ। কোভিড প্রতিরোধী না-হওয়া সত্ত্বেও শুধু 'করোনিল' কিট বিক্রি করেই আড়াইশো কোটি টাকার বেশি মুনাফা করার অভিযোগ উঠেছিল রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলির বিরুদ্ধে।

২০২০ সালের ২৩ জুন প্রথম বার করোনিল কিট বাজারে এনেছিল পতঞ্জলি। করোনিল এবং শ্বাসারি বটি নামে দু’ধরনের ট্যাবলেট এবং অণু তৈল নামের ২০ মিলিলিটারের একটি তেলের শিশি নিয়ে তৈরি ওই কিটের দাম রাখা হয়েছিল ৫৪৫ টাকা। চাইলে আলাদা ভাবে ট্যাবলেট এবং তেল কেনা যাবে বলেও জানানো হয়েছিল। তার পর ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৩ লক্ষ ৫৪ হাজার করোনিল কিট বিক্রি হয়েছে বলে সংস্থার তরফে জানানো হয়। পতঞ্জলির বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে মিথ্যা বিজ্ঞাপনী প্রচারের অভিযোগ এনেছিল আইএমএ।

গত বছর নভেম্বর মাসে সংস্থাটি সুপ্রিম কোর্টকে আশ্বস্ত করেছিল যে এটি চিকিৎসার কার্যকারিতা বা ওষুধ ব্যবস্থার সমালোচনা সম্পর্কে কোনও বিবৃতি বা অপ্রমাণিত অপ্রমাণিত দাবি করবে না। পরবর্তীকালে এমনটা করলে তাকে জরিমানা করা হবে বলেও জানানো হয় শীর্ষ আদালতের তরফে। এ ব্যাপারে পতঞ্জলি ও সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টের বালকৃষ্ণের অবস্থান স্পষ্ট করে আদালতকে জানানোর নির্দেশ জেওয়া হয়েছিল। পতঞ্জলির বিজ্ঞাপনে রামদেবের ছবি থাকার ফলে তাঁকেও মামলার একটি পক্ষ বলে ধরা হয়েছিল। তবে না বন্ধ হয়েছে বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপন ব্যবহার, না ওই মামলায় আদালতকে কোনও জবাব দিয়েছে কোর্ট। এরপরেই গত ফেব্রুয়ারিতে ফের আদালতে ওঠে মামলাটি। সে সময় কেন্দ্র সরকারকেও তীব্র ভর্ৎসনা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সব জেনে বুঝেও কেন্দ্র চোখ বন্ধ করে রেখেছে বলেও অভিযোগ করে শীর্ষ আদালত। বালকৃষ্ণকে এই সংক্রান্ত নোটিসও পাঠিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।

সেই মামলার জল গিয়েছিল অনেকদূর। শেষপর্যন্ত রামদেব ও বালকৃষ্ণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করে তাদের আদালতে তলব করে সুপ্রিম কোর্ট। আদালতে সশরীরে এসে ক্ষমাও চান বাবা রামদেব। মঙ্গলবার ড্রাগ লাইসেন্স সংক্রান্ত একটি ঘটনায় উত্তরাখণ্ড সরকারকে তীব্প ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। উত্তরাখণ্ড প্রশাসন কেন এবং কীভাবে রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি দ্বারা প্রচারিত বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনগুলির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি, তা নিয়ে গর্জে উঠেছে কোর্ট। শীর্ষ আদালতের সাফ জবাব, এই ক্ষমাপ্রার্থনা দিয়ে কী হবে। যারা বিশ্বাস করে পতঞ্জলির এই ভুয়ো ওষুধপত্রগুলি খেয়েছে, তাদের কীভাবে সুবিচার দেবে সুপ্রিম কোর্ট।

 

রামদেবদের ক্ষমাপ্রার্থনার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, ‘‘আমরা অন্ধ নই’’। পুরো বিষয়টি নিয়ে আদালত ‘‘উদার হতে চায় না’’ বলেও মন্তব্য করল সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কেন্দ্রের উত্তরেও যে সন্তুষ্ট নয় শীর্ষ আদালত, এদিন ফের সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছে বেঞ্চ। বুধবার মামলার শুনানি চলাকালীন, বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন আমান্নুলার ডিভিশন বেঞ্চ বলে, ‘‘ক্ষমাপত্র কাগজে-কলমে রয়েছে। ওঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। আমরা এই ক্ষমাপত্র মেনে নিচ্ছি না। আমরা মনে করি ইচ্ছাকৃত ভাবে অঙ্গীকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।’’

এখানেই শেষ নয়। রামদেবের ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্যেও প্রচারের উদ্দেশ্য জড়িয়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বেঞ্চের দাবি, আদালতে পাঠানোর আগে ক্ষমাপত্র সংবাদপত্রে পাঠান রামদেব। সে ব্যাপারটি মোটেও ভালোভাবে নেয়নি শীর্ষ আদালত। এ ব্যাপারটি নিয়ে যোগগুরু এবং তাঁর সহযোগীর সমালোচনা করেছে শীর্ষ আদালত। সেই প্রসঙ্গে বিচারপতি কোহলি বলেন, "বিষয়টি আদালতে পৌঁছানোর আগে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এটি আমাদের জন্য আপলোড করা হয়নি। স্পষ্টতই ওঁরা প্রচারে বিশ্বাসী। তাই এমনটা করা হয়েছে।"

আরও পড়ুন: সদগুরু থেকে রামদেব: ভেকধারী ‘বাবা’দের যেভাবে কাজে লাগায় বিজেপি

রামদেবদের দেওয়া হলফনামা পড়ার সময় বিচারপতি আমান্নুলা রামদেবের আইনজীবী মুকুল রোহতগীকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘আপনারা হলফনামাতেও ফাঁকি দিচ্ছেন। এটা কে তৈরি করেছে, আমি অবাক।’’ তার উত্তরে মুকুল আদালতকে জানান, তাঁর মক্কেল আইনের বিষয়ে পেশাদার নন। তাই ভুল হয়েছে। এর পর রামদেবের ক্ষমাপ্রার্থনা আদৌ আন্তরিক কি না সেই প্রশ্ন তুলে বিচারপতি আমান্নুলা বলেন, ‘‘আমাদের নির্দেশের পরেও ভুল হয় কী করে? আমরা এই ক্ষেত্রে এতটা উদার হতে চাই না।’’ পুরো বিষয়টিতে সমাজে সঠিক বার্তা দিতে হবে বলেই উল্লেখ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

সব মিলিয়ে বেশ বিপাকেই রয়েছেন রামদেব ও তাঁর সংস্থা পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ। সংস্থার ব্যাপারে আরও বড় কোনও পদক্ষেপ নিতে চলেছে শীর্ষ আদালত, এমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। মধ্যিখানে পতঞ্জলি সংস্থায় নাম জড়ানো থেকে রেহাই পেতে দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিলেন বাবা রামদেব। তবে সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। আদালতে ক্ষমাপ্রার্থনার পর মামলা সেখানেই ফুরোবে বলেও মনে করেছিল কেউ কেউ। তবে মামলা যে এখানে শেষ হওয়ার নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এর পরে কী অপেক্ষা করছে রামদেবদের জন্য, সেটাই এখন দেখার।

More Articles