কখনও দক্ষিণা, কখনও শ্মশান, কখনও আবার রক্ষাকালী, কেন ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজিতা হন দেবী?

Goddess Kali : কিন্তু একই দেবীর কেন ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়? কেনই বা সেই নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বদলে বদলে যায় আরাধনার নিয়ম? এই সব প্রশ্নের জট পাকিয়ে যায়, তৈরি হয় নতুন কোনও মিথ।

ভক্তি অথবা শক্তি, কালী মাহাত্ম্য নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে চর্চার শেষ নেই। বছরের ওই একটা রাতের পুজো দিয়েই তাই সেই চর্চা শেষ হয়ে যায় না। সারা বছর ধরেই বিভিন্ন রূপে পূজিতা হন দেবী। কলকাতা শহর তো বটেই, এমনকী সারা বাংলা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র কালী মন্দিরের ইতিহাস। কালী বলতেই একটা চিরাচরিত ভাবনার আমাদের মাথায় আসে। কৃষ্ণ বর্ণের শরীর, পায়ের নীচে শায়িত মহাদেব। এবং দেবীর জিভ কাটা। কিন্তু একই দেবীর কেন ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়? কেনই বা সেই নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বদলে বদলে যায় আরাধনার নিয়ম? এই সব প্রশ্নের জট পাকিয়ে যায়, তৈরি হয় নতুন কোনও মিথ।

পণ্ডিতেরা বলেন দেবী কালী মূলত ৮টি ভিন্ন ভিন্ন রূপে এবং ভিন্ন নামে পূজিতা হন। যথা - দক্ষিণাকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। আবার অন্য একটি মতে, ৯ প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা - দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধকালী, চণ্ডিকালিকা। এছাড়াও স্থান বিশেষে আরও বেশ কিছু নামে পূজিতা হন দেবী কালী। আসুন জেনে নেওয়া আদলে কী তফাৎ এই প্রতিটি রূপের মধ্যে।

আরও পড়ুন - সময় পেরলেও মরচে পড়েনি এতটুকুও, ভারতের এই মন্দিরে আজও রয়েছে পরশুরামের কুঠার

দক্ষিণাকালী - কালীর এতো রূপের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হল এই দক্ষিণাকালী রূপটি। দক্ষিণ দিকের অধিপতি যম। তবে সেই যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তাঁরই নাম দক্ষিণাকালী। দেবীর এই রূপের বৈশিষ্ট্য হল, গলায় থাকে মুণ্ডমালার হার, কানে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস, কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। এই কালীও ত্রিনয়নী এবং মহাদেবের বুকে দাঁড়িয়ে থাকার দারুণ জিভ কাটা।

ভদ্রকালী - মৃত্যুর সময় যে কালী মঙ্গলময়ী বার্তা দেন, তিনিই ভদ্রকালী। যদিও এই ভদ্রকালী রূপেরও আবার দুটি ভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায় এই বাংলায়। শাস্ত্র মতে দুর্গা ও সরস্বতী দেবীর অন্য নাম হিসেবেও উল্লেখ পাওয়া যায় ভদ্রকালী নামটির। তবে কালিকাপুরাণ অনুযায়ী, ভদ্রকালীর গায়ের রং অতসীপুষ্পের মতো, মাথায় জটাজুট, কপালে অর্ধচন্দ্র এবং গলায় কণ্ঠহার। কিন্তু এই দুই রূপের বাইরেও ভদ্রকালী রূপের আরও একটি প্রকারভেদ পাওয়া যায় এই বাংলাতেই। তিনি আবার কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, মাথার চুল খোলা। দেবীর এই রূপ যেন সবসময় ক্ষুধিতা, জগৎকে গ্রাস করতে উদ্যত যেন। তন্ত্রমতেই উল্লেখ মেলে এই রূপের।

গুহ্যকালী - গুহ্যকালী বা আকালী হিন্দু দেবী কালীর একটি বিশেষ রূপ। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, তিনি দেবী শতাক্ষীর শরীর থেকে উৎপন্না অন্যতমা মহাশক্তি। এই কালী মূলত সাধকদের আরাধ্য।গায়ের রং গাঢ় মেঘের মতো। তিনি দ্বিভূজা, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র, মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র, কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার। এছাড়াও তাঁর বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ বিরাজমান। তিনি নব রত্ন ভূষিতা। তিনি নিয়মিত শবমাংস খান। তবে গৃহস্থের নিকট এই রূপ "অপ্রকাশ্য"। গুহ্যকালী কালীর এক অতি ভয়ংকরী রূপ।

সিদ্ধকালী - সিদ্ধকালী গৃহস্থ নয়, দেবীর এই রুপের পুজোর অধিকার কেবলমাত্র সাধকদের। তুলনামূলকভাবে অপরিচিত রূপ এটি। কালীতন্ত্রে তাঁকে দ্বিভূজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তার ডান হাতে থাকে খড়্গ, যে খড়্গ দিয়ে তিনি চাঁদে আঘাত হানেন। পরি নামে চাঁদ থেকে যে অমৃত রস ক্ষরিত হয় তা বাম হাতে ধরে থাকা একটি মরার খুলিতে করে পান করেন দেবী। সিদ্ধকালী সালংকারা, মনোহর বসনে শোভিতা। তাঁর ডান পা শিবের বুকে এবং বাম পা শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে স্থাপিত।

চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা - চামুণ্ডা হলেন আদ্যাশক্তি, আবার তিনিই ভগবতী দুর্গা। দেবী দুর্গার ভ্রুকুটি থেকে এই দেবীর সৃষ্টি হয়েছে এই রূপ বলেই জানা যায়। দেবী ভাগবত পুরাণ এবং মারকেন্ডিয় পুরাণ অনুসারে, চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুরকে বধ করে তিনি পরিচিত হন 'চামুণ্ডা' নামে। চামুণ্ডাকে দেবী কালীর অপর রূপ মনে করা হয়। পার্বতী, চণ্ডী, দুর্গা, চামুণ্ডা ও কালী এক ও অভিন্ন। ভাগবত পুরাণ অনুসারে এই দেবী ব্যাঘ্র চর্ম পরে থাকেন এবং দেবী অস্তিচর্মসার।

আরও পড়ুন - মাছ ছাড়া ভাত খান না স্বয়ং কালী, লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গিয়েছে বাংলার এই শক্তিপীঠ

মহাকালী - হিন্দু পুরাণ অনুসারে, তিনি মহাকালের তথা শিবের সঙ্গিনী। তিনি চেতনা দেবী এবং বাস্তবতা ও অস্তিত্বের ভিত্তি। সংস্কৃত ভাষায় মহাকালী হলেন মহাকালের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ। দেবী কালী এবং তার অন্য সব রূপই হলো মহাকালীর বিভিন্ন প্রকাশ। তন্ত্রসার গ্রন্থমতে মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। তবে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীকে আদ্যাশক্তি, দশভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর দশ হাতে রয়েছে খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভূসুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ।

শ্মশান কালী - কলকাতা তথা পার্শ্ববর্তী জেলায় বিভিন্ন শ্মশান নিকটবর্তী অঞ্চলে পুজো হয় এই দেবীর। অর্থাৎ শ্মশানে বাস থেকে এসেছে এই নাম। সিদ্ধকালীর মতো এই কালীর পুজোও গৃহস্থ বাড়িতে হয় না। শোনা যায় প্রাচীনকালে কোনও কোন ডাকাতও নাকি এই কালীর আরাধনা করতো। এখানে দেবীর প্রকাশ বিভৎস। তিনি বসনহীনা। গলায় মুন্ডমালা। চতুর্ভুজা দেবী মহাদেবের বুকের ওপর দন্ডায়মান।

রক্ষাকালী - রক্ষাকালীকে দক্ষিণাকালীরই একটি নাগরিক রুপ হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন কালে নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য এই দেবীর পুজা করা হতো। এই দেবীর পুজা মন্ত্রও ভিন্ন। স্থানভেদে রক্ষাকালীর বাহন সিংহ। দেবী দ্বিভুজা।

More Articles