শ্রমিক বড় সস্তা! কেন ইজরায়েলে ৬ হাজার নির্মাণকর্মী পাঠাচ্ছে ভারত?

Gaza War: সম্প্রতি ইজরায়েল সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে ৬ হাজারেরও বেশি ভারতীয় শ্রমিক আসতে চলেছে ইজরায়েলে। যারা দেশের বিভিন্ন নির্মাণ-কাজে সহায়তা করবে।

প্রায় ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধ চলছে। গতবছর অক্টোবর ইজরায়েলে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস। সেই হামলার পরে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেয় ইজরায়েল। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা করেছে ইজরায়েলের। ভারত অবশ্য এ নিয়ে তেমন কোনও জোরালো অবস্থান নেয়নি কোনওদিনই। বরং ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অক্ষুন্ন রেখেই চলেছে নয়াদিল্লি। আর তা এতটাই জোরদার যে এবার অন্তত ৬০০০ ভারতীয় নির্মাণকর্মীকে ইজরায়েলে পাঠাচ্ছে ভারত।

সম্প্রতি ইজরায়েল সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে ৬ হাজারেরও বেশি ভারতীয় শ্রমিক আসতে চলেছে ইজরায়েলে। যারা দেশের বিভিন্ন নির্মাণ-কাজে সহায়তা করবে। কেন ভারত থেকে শ্রমিক আনাতে হচ্ছে ইজরায়েলকে। কারণ হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধের জেরে ইজরায়েলে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা গিয়েছে। আর ভারতের মতো ভারী জনসংখ্যার দেশে সেই শ্রমিকের তো কমতি নেই কোনওদিনই। তাই যুদ্ধের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতের ৬ হাজারেরও বেশি মানুষকে।

গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে ঢুকে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিল হামাস বাহিনী। নৃশংস ভাবে গুলি থেকে শুরু করে ধর্ষণ, তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ইজরায়েলিকে, যাদের বন্দি করে হামাস সেনা। এর পরেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে নেতানিয়াহু সরকার। সেই থেকে গাজার অন্তত ৩৩ হাজার নিরপরাধ প্রাণ কেড়েছে ইজরায়েলি সেনা। জখম প্রায় ৭৬ হাজার। মৃতদের মধ্যে অন্তত সাড়ে ১৪ হাজারই শিশু। গাজাকে মাত্র ৬ মাসের মাথায় শ্মশানে পরিণত করেছে ইজরায়েল। যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার হামাসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তবে কাজের কাজ হয়নি। বরং হু হু করে বেড়েছে গাজায় মৃত্যুসংখ্যা। তার সঙ্গে বিপদ বাড়িয়েছে দুর্ভীক্ষ। ওষুধ নেই, খাবার নেই। ভয়াবহ বিপদের মধ্যে রয়েছেন অসংখ্য গাজাবাসী।

আরও পড়ুন: গাজাকে ৪০ হাজার তাঁবু ‘ইদের উপহার’! রাফাহ ধ্বংসের ভয়ঙ্কর ছক কষছে ইজরায়েল?

এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে নতুন করে সংঘাতে জড়িয়েছে ইজরায়েল। লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠি হেজবুল্লাহ এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে সহায়তা করেছে ইরানের। এককালের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আজ পৌঁছেছে কিনারায়। পরিস্থিতি এমন, যে কোনও মুহূর্তে ইজরায়েলে হামলা করে দিতে পারে ইরান। হামাসেরও ইজরায়েল হামলা করার সম্ভবনা নেহাৎ কম নয়। এদিকে ইজরায়েলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি হত তুর্কি থেকে। সম্প্রতি গাজায় হামলা প্রসঙ্গে ইজরায়েলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে রোখ টেনেছে তুর্কি। সিমেন্ট, লোহা, বিমান চালানোর তেল-সহ একাধিক জরুরি জিনিসপত্র ইজরায়েলে রফতানি করা বন্ধ করেছে তারা। এমনকী হামাসকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থনের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে তাদের তরফে।

গাজায় হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে খুনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতে কোণঠাসা ইজরায়েল। তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে একাধিক দেশ। গাজা নিয়ে বহু দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক খারাপ করে বসে রয়েছে ইজরায়েল। এমনকী যুদ্ধ শুরুর গোড়া থেকে যে আমেরিকা প্রতিমুহূর্তে সমর্থন জানিয়ে এসেছিল নেতানিয়াহু সরকারকে, মুখ ফিরিয়েছে তারাও। ইজরায়েলের এই আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা করেছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সরকার। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ কোণঠাসা আপাতত ইজরায়েল। যুদ্ধের আবহে বহু বন্ধুদেশই চলে গেছে বিরোধিতায়।

Amid Gaza war, over 6,000 Indian workers to depart for Israel by May

তবে ভারত থেকেছে ইজরায়েলের পাশে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেও রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিপ্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ভারত। ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধেও সেই একই ভূমিকায় দেখা গিয়েছে ভারতকে। সম্প্রতি হামাসের কবল থেকে বেঁচে ফেরা মানুষজন ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। এবার সেই যুদ্ধের দেশে ৬০০০ হাজার শ্রমিক পাঠাচ্ছে ভারত। বন্ধুত্বের উপহার নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও রাজনৈতিক সমীকরণ।

আসলে ইজরায়েলের এতদিন শ্রমিকের অভাব হয়নি। অন্তত গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার আগে পর্যন্ত। ওয়ার্ক পারমিটের টোপ দিয়েই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মানুষকে নিয়ে আসা হত ইজরায়েলে। এবং তাদের দিয়ে শ্রম করানো হত। এতদিন ধরে এটাই ছিল দস্তুর। উপরি আয়ের আশায় এটাকে সৌভাগ্য হিসেবেই ধরে নিত ফিলিস্তিনিরা। কাজ করতে এসে কখনও তারা পৌঁছে যেত জেলে, কখনও ইজরায়েলি নিয়মকানুনের ফাঁড়ায় তাঁদের আজীবন শ্রমিক হয়ে থেকে যেতে হত সেখানকার। হিসেব বলছে, ইজরায়েলে প্যালেস্টাইন থেকে অন্তত ৮০ হাজার শ্রমিক কাজ করতে আসত। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বাসিন্দা। ১৭-১৮ হাজার গাজার বাসিন্দারা আসতেন কাজের জন্য ইজরায়েলে। তাদের ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে মহান সাজত ইজরায়েল, সীমান্তে চলাচলও ছিব মোটামুটি অবাধই। এবং তলে তলে গুছিয়ে নিত আখের।

Amid Gaza war, over 6,000 Indian workers to depart for Israel by May

তবে যুদ্ধ লাগার পর সেই সিস্টেম ভেঙে পড়ে। প্যালেস্টাইন থেকে শ্রমিক আমদানি ভয়ঙ্কর হয়ে যায় ইজরায়েলে। হামাসের হামলার সময় যে সব ফিলিস্তিনি থেকে গিয়েছিল ইজরায়েলে, তাদের ধরে ধরে জেলে পুরে দেয় নেতানিয়াহু সেনা। বেশ কিছু বন্দিকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধের মধ্যে। গাজার সঙ্গে ইজরায়েলের এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাশুল গুনতে শুরু করেছে নেতানিয়াহু সরকার। এখম নির্মাণ-শ্রমিক পেতেই ঘাম ছুটছে ইজরায়েলের।

এই পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। এ দেশে এমনিতেও শ্রমিকের দাম সস্তা। হাজার হাজার নিকাশিকর্মী এ দেশে রোজ মরে যায় ম্যানহোলের নিচে নেমে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে নেমে। ন্য়ূনতম নিরাপত্তা সামগ্রীটুকুও পায় না তাঁরা। এ দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের শরীর ফালাফালা করে দিয়ে চলে যায় ট্রেন। লকডাউনে মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয় পরিযায়ী শ্রমিকদের। নরেন্দ্র মোদি যতই বলুক না কেন, তাঁর জমানায় গরিবিকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে দেশ থেকে। তবে এরা কারা, যারা ক'টা টাকার বিনিময়ে যুদ্ধের দেশে শ্রমিক হতে যাচ্ছে।

Amid Gaza war, over 6,000 Indian workers to depart for Israel by May

ইজরায়েলের তরফে সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, খুব শিগগিরই বিদেশ থেকে শ্রমিক আনানো হবে কনস্ট্রাকশন সেক্টরে। ইজরায়েলের অর্থমন্ত্রক ও গৃহ ও নির্মাণ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, অন্তত ১ সপ্তাহ আগে ইজরায়েলের সেই দাবি মেনে নিয়েছে নয়াদিল্লি। এপ্রিল থেকে মেয়ে মাসের মধ্যেই এ দেশ থেকে ৬ হাজারেরও বেশি নির্মাণ শ্রমিক পৌঁছবে ইজরায়েলে। তাঁদের জন্য এয়ার শাটল এবং কমদামী চার্টার বিমানেরও ব্যবস্থা করেছে ইজরায়েলি সেনা।

আরও পড়ুন:হামাসের কায়দায় ইজরায়েলে হামলা হিজবুল্লাহের, নতুন যুদ্ধের শঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব

কিছুদিন আগেই সামনে এসেছিল, এ দেশে ভুয়ো চাকরিচক্র চালিয়ে রাশিয়ার জন্য সেনা আমদানি করেছে ভারত। অসংখ্য তরুণ ছেলেপুলেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাশিয়ায়, যাদের না জানিয়ে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইজরায়েলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন আলাদা নয়। শুধু এ ক্ষেত্রে সবটাই হচ্ছে খোলামেলা ভাবে। ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের এই সংক্রান্ত একটি জিটুজি চুক্তি সই হয়েছে বলও খবর। ইতিমধ্যেই ৬৪ জন শ্রমিক ইজরায়েল পৌঁছেছেন। আগামী কয়েক মাসে আরও কয়েক হাজার কর্মী এসে পৌঁছনোর কথা ইজরায়েলে। শুধু ভারত থেকেই নয়, শ্রীলঙ্কা থেকেও ২০ হাজার শ্রমিক আমদানি করেছে ইজরায়েল।

তুলনামূলক ভাবে কম শক্তির দেশগুলি থেকে সস্তায় শ্রমিক নিয়ে নিজেদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। গাজা-সহ প্যালেস্টাইনের একাধিক এলাকাকে কার্যত গণকবরে পরিণত করেছে ইজরায়েলি সেনা। গাজায় যুদ্ধ থামানোর কথা ভাবছে না ইজরায়েল। বরং গাজার রাফাহ শহরটি ওড়ানোর পরিকল্পনায় রয়েছে ইজরায়েল। আর নিজের দেশের নির্মাণ কাজকে বজায় রাখতে ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অজস্র নির্মাণ শ্রমিক। তাদের জীবনের দায় কি ইজরায়েল সরকার বা ভারত সরকার নেবে! সামনেই লোকসভা ভোট। দিল্লির মসনদ যে ফের বিজেপির হাতেই যেতে চলেছে, তা একরকম নিশ্চিতই বলা যায়। মোদির অচ্ছে দিনের আওতায় কি শ্রমিকদের যুদ্ধের দেশে পাঠানোর এই সিদ্ধান্তও পরে, নাকি সেই সব গরিব শ্রমিকদের প্রাণ বা ভোট, কোনওটারই দাম তেমন করে দিতে চায় না এ দেশের সরকার!

More Articles