সত্যিই লম্পট, নিষ্ঠুর নন? আসলে কতটা নিরীহ, উদার ছিলেন সিরাজদৌলা?
Siraj ud-Daulah: নবাব সিরাজদৌলাকে লম্পট, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর হিসেবে দেখানোটা কার্যত ইতিহাসের এক দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নবাব সিরাজদৌলাকে লম্পট, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর হিসেবে দেখানোটা কার্যত ইতিহাসের এক দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা অনৈতিহাসিক ধারণাকে ইতিহাসের প্রচলিত ধারণায় পর্যবসিত করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, ঠিক সেই ভূমিকারই অনুরণন দেখা যাচ্ছে ভারতের শাসকদল বিজেপির মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গে তারা লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক বিষয়, রুটি-রুজির বিষয়, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, দেশরক্ষা থেকে দেশের ফেডারেল কাঠামো- সমস্ত কিছুকে আলোচনার বাইরে সুকৌশলে রেখে দিতে চাইছে। তাই কখনও সিরাজদৌলা উঠে আসছে আলোচনায়, কখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ক্লাইভকে সাহায্যকারী কৃষ্ণনগরের বড় জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের ইতিবাচক চরিত্র নির্মাণ হচ্ছে। আরএসএসের পরিভাষার 'বিপন্নপ্রায় হিন্দুধর্ম'-কে (যে হিন্দুধর্মকে আরএসএস পরিবেশন করে, তার সঙ্গে প্রচলিত অর্থে বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদী সমন্বয়বাদী হিন্দুধর্মের আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই- এমন এককেন্দ্রিক হিন্দুধর্মের নবনির্মাণকারী হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্রকে তুলে ধরা) পুনরুদ্ধারই হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রধান রাজনৈতিক কাজ।
সিরাজকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্রের জাল ব্রিটিশরা বিস্তার করেছিল, সমসাময়িক কিছু বিদেশি পর্যটকদের বিবরণের মধ্যে দিয়ে সেটি এখন আরএসএস-বিজেপির প্রচারের প্রধান উৎস। তার পাশাপাশি বলতে হয়, সিরাজের সঙ্গে বেইমানি করে মীরজাফর, জগৎশেঠ (যার আসল নাম ফতেহ চাঁদ) উমিচাঁদ প্রমুখরা ব্রিটিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল এ দেশের স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য, তাদের বেতনভুক্ত কিছু ফারসি ভাষার তথাকথিত ইতিহাসবিদরাও ঠিক সেভাবেই সিরাজকে চরিত্রহীন করতে সব রকমের প্রয়াস নিয়েছিল। তাদের কথাগুলোকেই এখন আবার নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো করে পরিবেশন করছে আরএসএস-বিজেপি।
বাংলার নবাবদের চরিত্রহীন এবং নিষ্ঠুর হিসেবে দেখানো সাম্রাজ্যবাদী শাসন দ্বারা লালিত ইতিহাসের দিকপালেরা একটা সময় ব্রিটিশদের বিভাজন নীতির অন্যতম সহায়ক বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু বাংলার রাজা হিসেবে যে সমস্ত হিন্দুরা কোনও না কোনও সময় ক্ষমতায় ছিলেন, তাদের ব্যক্তিজীবন বা নিষ্ঠুরতা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। বাংলার নবাবদের নিষ্ঠুর, চরিত্রহীন দেখানোর পরম্পরা ভারতীয় ইতিহাসবিদদেরও একটা বড় অংশের মধ্যে চলে এসেছে। তবে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কিন্তু মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে আলীবর্দী খাঁ পর্যন্ত কাউকে ঘিরেই ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা দেখাতে পারেননি। শুজাউদ্দিন এবং সরফরাজ, এই দু'জনকেও চরিত্রহীন, লম্পট এবং নিষ্ঠুর বলে ঐতিহাসিকেরা বারবার বর্ণনা করেছেন (sirajuddaulah and east india company,1756-1757-- Brijen k Gupta, leiden, 1962, page 30)।
আরও পড়ুন- সিরাজ কি সত্যিই দেশপ্রেমিক ছিলেন?
সিরাজের পূর্ববর্তী নবাবদের ঘিরে যখন একই ধরনের অভিযোগ, তাহলে হঠাৎ সেই সমস্ত ব্যক্তিদের ঘিরে লাম্পট্য, নিষ্ঠুরতার অভিযোগগুলি সেভাবে আলোকিত হয় না কেন? হঠাৎ সিরাজকেই বারবার এই ধরনের অভিযোগের শিকার হতে হচ্ছে কেন? ব্রিজেন গুপ্তর গবেষণার সঙ্গে ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদ এস সি হিলের গবেষণার ফারাক কতখানি? (উৎসাহী পাঠক পড়ুন Bengal in 1756 1757S S C Hill , vol-3, londan -1905))
সিরাজের ব্যক্তিগত জীবন ঔপনিবেশিক ভাবনায় জারিত ইতিহাসবিদদের কাছে আলোচ্য নয়। তাঁদের কাছে বিবেচ্য, পলাশী ঘিরে চক্রান্তের জালকে কার্যকারণের যুক্তির উপর খাড়া করা। দেখানো যে, সিরাজের ব্যক্তিজীবনের সমস্যা ঘিরেই এই ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্রে ব্রিটিশদের ভূমিকাকে অত্যন্ত তরল করে দেখানোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা চেতনার দ্বারা পরিচালিত ইতিহাসকে শুধুমাত্র ভারতবাসীর কাছেই নয়, গোটা বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করেছিলেন এইসব ঐতিহাসিকেরা।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ঠিক সেভাবেই ইংরেজদের ষড়যন্ত্রকে গৌরবান্বিত করে, মুসলমান সম্প্রদায়কে দেশদ্রোহী হিসেবে, চরিত্রহীন হিসেবে, নিষ্ঠুর হিসেবে উপস্থাপিত করার চিন্তা থেকেই নতুন করে নির্বাচনী রাজনীতিতে সিরাজ সম্পর্কে নানা অপপ্রচার আবার অভিনব কায়দায় তুলে আনা হচ্ছে। মীরজাফর, জগতৎশেঠ, উমিচাঁদরা যেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ভারতকে বিক্রি করে দিয়েছিল, ভারতের সার্বভৌমত্বকে বন্ধক রেখেছিল, ঠিক সেভাবেই আজ এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিরা নতুন করে অনৈতিহাসিক বিতর্ককে রাজনৈতিক মাত্রায় তুলে আনতে চাইছে। কারণ তারা চায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্তমান পরিবর্তিত সংস্করণ অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির ধারক বাহকদের হাতে দেশকে তুলে দিতে। সেই কারণেই সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন নয়, ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ অবস্থা নয়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়, চরম বেকারত্ব নয়, ভয়াবহ দুর্নীতির আলোচনাকে আড়াল করে, সমস্ত ধরনের সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধিকে আড়াল করে,ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থতা প্রমাণ করার ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে, আবার সিরাজদৌলাকে নিয়ে অনৈতিহাসিক বিতর্ক রাজনৈতিক মোড়কে তুলে ধরা হচ্ছে।
মজার কথা হলো, অতীতের ঐতিহাসিকেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা অনেকখানি পরিচালিত হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আজকের ভারতের শাসকদল বিজেপির সিরাজকে ঘিরে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রদায়িক প্রচারের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য আছে। ব্রিটিশের নুন-খাওয়া ঐতিহাসিকেরা সিরাজের ব্যক্তি চরিত্রের যে কদর্যতার দিকগুলি নিয়ে সরব ছিলেন, তা কিন্তু সবটাই সিরাজ নবাবের মসনদে বসার আগের সময়কালের ঘটনা। সিরাজের ব্যক্তি চরিত্রের যে কদর্যতার কথা একদিন ব্রিটিশের তল্পিবাহক ঐতিহাসিকেরা বলেছিলেন বা আজকে বিজেপি বলছে, তার মধ্যে কিন্তু নবাব হওয়ার পরেই সিরাজের যে স্বল্পকালীন সময় বেঁচে থাকা, সেই সময়কালের একটি ঘটনাও তারা উপস্থাপিত করতে পারছেন না।
দুঃখের বিষয়, সিরাজকে নিয়ে একটা বড় অংশের ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের তথ্য অবলম্বনে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার থেকে সিরাজের জেদি একরোখা স্বভাব, মেজাজ, রাগ- এই সমস্ত দিকগুলির উপরেই সবথেকে বেশি জোর দিয়েছেন (Bengal- Peter Marshall page - 75, 78, এমনকী বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য রজতকান্ত রায়ও তাঁর Colonial Penetration গ্রন্থে একই ধরনের মতামত দিয়েছেন। পৃ-7, 14)। ব্যক্তিজীবনের এইসব বৈশিষ্ট্য ঘিরে একজন মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক চিন্তা-চেতনার ধারাকে কি অনুভব করতে পারা যায়?
রজতকান্ত রায় বা পিটার মার্শালের মতো ঐতিহাসিকেরা এখানেই থেমে যাননি। তাঁর নিষ্ঠুরতা, উন্মাদ স্বভাব, উশৃঙ্খলতা ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহারের পাশাপাশি এই সমস্ত পর্যায়ক্রমকে সিরাজের পরাজিতের মরণোত্তর পুরস্কার বলে অভিহিত করেছেন। সিরাজ সম্পর্কে এই যে মূল্যায়ন, তাকে কি কখনও কোনও ঐতিহাসিকের মূল্যায়ন বলা যায়? নাকি এই মূল্যায়ন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত অপরাধকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সিরাজকে কলঙ্কিত করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অঙ্গই বলা যায়?
রজতকান্ত রায়ের মতো মানুষ সরাসরি লিখছেন, সত্য যেটাই হোক না কেন, আলীবর্দী খাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে কখনই সিরাজদৌলাকে অভিহিত করা যায় না। কিন্তু আসল সত্য তবে কী, সে বিষয়ে পিটার মার্শাল থেকে রজতকান্ত রায় কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। তাহলে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে, তাঁর চরিত্র সম্পর্কে এই ধরনের বিশেষণ ব্যবহারের মধ্যে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আর সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে গোটা মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে সাম্প্রদায়িক তাস হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে আরএসএস-বিজেপি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উঁচু দরের কর্মচারী ছিলেন লুইক স্ক্রাফটন। তিনি লিখে গেছেন, নবাব হওয়ার পর সিরাজের মধ্যে একটা অদল-বদল এসেছিল। আলীবর্দীর মৃত্যুশয্যায় সিরাজ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি কখনও মদ স্পর্শ করবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা যে সিরাজ যতদিন বেঁচে ছিলেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন তা স্ক্রাফটনের লেখা থেকেই জানতে পারি (Reflections on the Government & ca of Indostan-- luke Scrafton.London 1760.page- 54, পাঠক লক্ষ্য করবেন, স্ক্রাফটন কিন্তু 'ইন্দোস্থান' লিখছেন)।
আরও পড়ুন- কৃষ্ণচন্দ্রই সনাতনীদের উদ্ধারকর্তা? কী বলছে ইতিহাস?
সিরাজের ব্যক্তি চরিত্রের কদর্যতা নিয়ে তাঁর সময়কালে প্রথম যিনি নানা ধরনের তথ্য উপস্থাপনা করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মঁসিয়ে জাঁ ল (Law's Memoir, Bengal-- S C Hill, Vol-3, page- 162)। লঁও কিন্তু সিরাজের চরিত্রের যে কদর্যতার কথা উপস্থাপিত করেছেন, সেগুলি যে সবই তাঁর মসনদে বসবার আগের সময়ের, সে কথা তিনি খুব স্পষ্টভাবেই নিজের লেখার মধ্যে বলেছেন। লঁ লিখছেন; সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল নবাব হয়ে নিশ্চয়ই সিরাজ অনেক বেশি মানবিকভাবে নিজেকে গড়ে তুলবেন। লঁ নিজের অভিমত হিসেবে লিখছেন, তাঁর বিশ্বাস একদিন সিরাজ নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন আনবেন এবং নিজেকে পরিশীলিতভাবে মেলে ধরবেন। লঁ নিজেই লিখছেন; সিরাজের থেকে অনেক বেশি চরিত্রহীন এবং উশৃঙ্খল ছিলেন যারা পরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে তিনি তরুণ নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খানের নাম তাঁরই স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। নওয়াজিস মহম্মদ খান ছিলেন ঢাকার নবাব। সম্পর্কে তিনি ছিলেন সিরাজের মেসোমশাই, বহু আলোচিত ঘসেটি বেগমের স্বামী। যিনি সিরাজের চরিত্র নিয়ে দশরকম কথা বলছেন, সেই লঁ কিন্তু লিখছেন, ফরাসিদের প্রতি সিরাজ অত্যন্ত বন্ধুত্বপরায়ণ ছিলেন (ঐ, পৃ-১৬৩)। লঁ-র লেখার মধ্যে কেমন স্ববিরোধিতা কাজ করেছিল সেদিকে পাঠক একটু নজর দিতে পারেন। লঁ লিখছেন, ফরাসিদের প্রতি কখনও নিষ্ঠুরতা বা উগ্রতার পরিচয় সিরাজ দেননি (ঐ)।
এবারে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উপস্থাপিত করা যাক। বাংলার মসনদের দাবিদার হিসেবে ঘসেটি বেগম এবং শওকত জঙের সঙ্গে যে সংঘাতের আবহাওয়া ছিল, সেই প্রেক্ষিতে বলতে হয়, এই দুই আত্মীয়ের প্রতি কখনও কি সিরাজ হঠকারিতা বা অবিবেচকের মতো আচরণ করেছিলেন? ঘসেটি বেগম কিন্তু কখনই সিরাজকে বাংলার নবাব হিসেবে চাননি এবং সিরাজ যাতে বাংলার নবাবের মসনদে না বসতে পারেন, তার জন্য বিরাট চক্রান্তও করেছিলেন।সেই ঘসেটি বেগমকে সিরাজ অত্যন্ত মানবিক আচরণের মধ্যে দিয়েই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে, কিছুটা হলেও নিজের আয়ত্তের মধ্যে আনতে পেরেছিলেন। তবে সে কথা কিন্তু ইউসুফ আলি খানের গ্রন্থ 'তারিখ-ই-বাংলা-ই মহবতদজঙ্গী'-তে (Tarikh -i- Bangla-i Mahabatjangi by Yusuf Ali Khan, Transleted by Abdus Subhan.Calcutta- 1982.page- 118) খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।
সিরাজের এই কূটনৈতিক ভূমিকার প্রশংসা, ইউসুফ মুক্তকণ্ঠে করেছিলেন। সিরাজ তাঁর মাসি ঘসেটিকে খানিকটা নিজের আয়ত্তে আনতে পারলেও শওকত জঙ্গকে কূটনীতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ করতে পারেননি। শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে সিরাজকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল এবং তাকে পরাজিত করে সিরাজ নিজের সিংহাসনকে নিরাপদ করেছিলেন।
ভুলে গেলে চলবে না ব্রিটিশ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজ কিন্তু প্রথম দফায় শান্তিপূর্ণ মীমাংসার যথেষ্ট প্রয়াসী ছিলেন। পরে অস্ত্র ধরলেও, পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালানোর পথটি রুদ্ধ করে দেননি। কাশিমবাজারে ইংরেজরা যে কুঠি স্থাপন করে, সেখানকার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন উইলিয়াম ওয়াটস। ওয়াটস সিরাজের হঠাৎ করে ক্ষমতা আর প্রভূত পরিমাণে ধন-সম্পত্তির মালিক হয়ে যাওয়ার দরুন কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ার একটা বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু বেসামাল হয়ে যাওয়া বলতে কিন্তু ওয়াটস সিরাজের চরিত্র বা তাঁর রাজত্ব পরিচালনা করবার ক্ষেত্রে কোনও নিষ্ঠুরতার একটিও বিবরণ দেননি।
কমবেশি ১৫ মাস সিরাজ বাংলার নবাব ছিলেন। কেবলমাত্র বাংলা নয়, বাংলা- বিহার-ওড়িশার নবাব ছিলেন। এই সময়কালে ইংরেজদের পকেটস্থ লোকজন সিরাজ সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বলেছেন বা যে সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া যায়, তার মধ্যে সিরাজের নিষ্ঠুরতা বা অর্বাচীনতার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন- ইতিহাস ও ইতিহাসচর্চার আলোকে পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজদ্দৌলা
নবাব হিসেবে, দেশের শাসক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরবার যে চেষ্টা সিরাজ করেছিলেন, সেটা তাঁর নেতিবাচক দিক হতে পারে না। প্রতি শাসকের নিজের কর্মপদ্ধতির ধারা থাকে, তা শাসন প্রক্রিয়াকে জোরদার করার কৌশল। ভুলে গেলে চলবে না, ইংরেজরা যে নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে, নিজেদের কর্মপদ্ধতিকে প্রসারিত করছিল এবং ভয়ঙ্কর ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিচ্ছিল, তা সিরাজ মেনে নিতে পারেননি। ইংরেজদের সিরাজের উপরে রাগের মূল কারণ ছিল এটাই। সিরাজের এই অনমনীয় মনোভাবই ছিল তাঁকে কলঙ্কিত করবার জন্য ব্রিটিশের নানা ধরনের অপকৌশল ব্যবহারের নেপথ্যের কারণ।
কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস লিখছেন, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের প্রতি সিরাজের প্রত্যাশা ছিল, তারা কোনও সংশয় ছাড়াই নবাবের আদেশ মেনে চলবে। ওয়াটস লিখছেন, মসনদে বসবার পর, সিরাজ নিজেকে যুদ্ধবাজ বলে মেলে ধরেছিলেন, এমন ভাবা ঠিক নয়। নবাব হওয়ার পর সিরাজ যখন কাশিমবাজারের ইংরেজদের কুঠি আক্রমণ করেন এবং ইংরেজরা বাধ্য হয় সিরাজের কাছে আত্মসমর্পণ করতে, তখনও সিরাজ কোনও ইংরেজ কর্মচারীর প্রতি বৈরিতার মনোভাব প্রকাশ করেননি। কাশিমবাজারের ইংরেজ কর্মচারীরাই বিভিন্ন নথিপত্রে লিখেছেন, কাশিমবাজারের কুঠি অবরোধ করবার পর যখন ইংরেজ কর্মচারীরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়, তখনও পরাজিত ইংরেজ কর্মচারীদের প্রতি অত্যন্ত উদার মনোভাবই সিরাজ দেখিয়ে গিয়েছেন (Sirajauddaulah- Brijen K Gupta, page- 5)।
কাশিমবাজার কুঠির পতন এবং ইংরেজ কর্মচারীদের সিরাজের কাছে আত্মসমর্পণের পর কলকাতা যাত্রা করেন সিরাজ। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওয়াটস এবং কোলেড বলে কাশিমবাজার কুঠিরই উচ্চস্তরের ইংরেজ কর্মচারী। সিরাজ কিন্তু তাদের বন্দি করেননি। এই দু'জনকে সিরাজ সঙ্গে নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন কলকাতার গভর্নর ড্রেকের উপর কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে। সিরাজ আশা করেছিলেন শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথে যাবেন ড্রেক।
কাশিমবাজার কুঠিতে ইংরেজদের যে সম্পত্তি ছিল, তা সিরাজ হস্তগত করেননি, বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত করেননি। কেবলমাত্র কাশিমবাজার কুঠির ভেতরে যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিল, সেগুলি সিরাজ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস লিখছেন; স্বভাবের দিক থেকে সিরাজ অত্যন্ত নিরীহ এবং ভীতু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন (Watts to his father , 13 th August, 1757, S C Hill ,Bengal , Vol-2, page- 467)।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার এতকাল পরেও সিরাজ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আজও ব্রিটিশের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাহিনি এবং বিকৃত ইতিহাসকেই আমরা একমাত্র আশ্রয় করছি। নবাবি শাসনের অবসান বিষয়টিকে আসলে মুসলমানের হাত থেকে মুক্তি হিসেবেই দেখাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কাছে আত্মসমর্পণ করা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র থেকে শুরু করে রাধাকান্ত দেব প্রমুখদের হিন্দুত্ববাদীরা মহান, হিন্দুধর্মের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখিয়ে নিজেদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।