সংসার মর্যাদা দেয়নি, চলচ্চিত্র জীবনেও জোটেনি খেতাব, বিস্মৃতির অতলে অভিনেত্রী গীতা দে

Gita Dey : গীতা দে বলতেই যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল আশি নব্বইয়ের দশকে পর্দার কুচুটে শাশুড়ি অথবা দজ্জাল ননদের প্রতিচ্ছবি

ভাঙাচোরা বাড়ির তেতলায় এক কামরার একটি ঘর, চুন খসানো দেওয়াল, তা থেকে উঠে এসেছে পলেস্তারা। উপরে ওঠার সিঁড়ির রেলিংটাও ভাঙা। শেষ জীবনে এখানেই থাকতেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী গীতা দে। কীভাবে আশি ছুঁইছুঁই বয়সে ওঠা-নামা করতেন ওই ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সে খোঁজ অবশ্য আজও অধরা। হয়তো অদম্য জেদ আর লড়াই করার যে ক্ষমতা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তার জোরেই পেরেছেন সবটা। জীবনের উপান্তে এসেও তাঁর একমাত্র সম্বল বলতে ছিল ওই মনের জোরটুকুই।

জীবনভর টালমাটাল পরিস্থিতির শিকার গীতা দে। জন্ম উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায়। ১৯৩১ সালের ৫ আগস্ট। বাবা অনাদি বন্ধু মিত্র ছিলেন পেশায় একজন ডাক্তার। যদিও বাবার সান্নিধ্য বেশিদিন পাননি গীতা দে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পরিস্থিতি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আদালতের দোরগোড়ায়। মা বাবার বিবাহ বিচ্ছেদের পর মা রেনু বালার কাছেই থাকতে চেয়েছিলেন ছোট্ট গীতা। লড়াই শুরু সেই থেকেই। নিশ্চিন্ত জীবনের ঘেরাটোপ থেকে নিমেষে বেরিয়ে এলেন গীতা দে। সংসারের অভাব কোনও দিন বড় স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। রোজগারের তাগিদে নামতে হয় ছোট বয়স থেকেই। তাই বেশি দুর পড়াশোনা করারও সুযোগ হয়নি তাঁর।

মাত্র ছয় বছর বয়সে মায়ের হাত ধরেই প্রথম চিনতে শুরু করেন অভিনয় জগৎকে। নাটকের দলে নাম লেখালেন গীতা দে। প্রবোধ গুহর মঞ্চে তখন মহড়া চলছে বিখ্যাত কালিন্দী নাটকের। সেই নাটকেই গান গাওয়ার সুযোগ হয় ছোট্ট গীতার। মাসিক আয় ৫ টাকা। শুধু গান গাওয়াই নয় তার পাশাপাশি অভিনয় করতেও শুরু করলেন ওই বয়সেই। এর আগেই অবশ্য বাবা অনাদিবন্ধু মিত্রের নজরে আসে মেয়ের গান ও অভিনয়ে প্রবল ঝোঁক। প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানী দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন তিনিই। তাঁর কাছেই গীতার প্রথম জীবনের নাচ, গান এবং অভিনয় শিক্ষা।

আরও পড়ুন - গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় প্রথম গানেই কিস্তিমাত, তবু কেন হারিয়ে গেলেন ‘গায়িকা’ সুচিত্রা সেন

গীতা দে বলতেই যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল আশি নব্বইয়ের দশকে পর্দার কুচুটে শাশুড়ি অথবা দজ্জাল ননদের প্রতিচ্ছবি। বাস্তব জীবনে অমন সাদামাটা মানুষটা কী অবলীলায় যেন যথাযথ হয়ে উঠতেন প্রতিটি চরিত্রেই। মাত্র ছয় বছর বয়সে যে সফর শুরু হয়েছিল তাঁর তা চলেছে টানা ছয় দশক। চরিত্র নিয়ে বাদ বিচার করার সুযোগ পাননি তিনি, সংসারের টানাপোড়েনই তাঁকে বাধ্য করেছিল নিজেকে দজ্জাল শাশুড়ির ভূমিকায় ফুটিয়ে তুলতে। অভিনয় দক্ষতা যে তাঁর মর্মে মর্মে প্রোথিত ছিল তা বোঝা যায় বাস্তব গীতা দে এবং চরিত্রের গীতা দে এই দুই ছবির তফাৎ দেখেই।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “গীতা দে ভীষণ শক্তিশালী অভিনেত্রী। ও ভালো গানও জানে। ওর অভিনয় জীবন শুরু শ্রীরঙ্গমে, খুব ছোটোবেলায়। তারপরে শিশির ভাদুড়ির কাছে ওর নাট্যশিক্ষা, ও একই সঙ্গে নাটকে অভিনয়। সিনেমাতেও ক্যারেক্টার অ্যাকট্রেস হিসাবে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ডাইনি’।” পর্দার “ডাইনি” চরিত্রটি যেন গীতা দে ছাড়া সত্যিই অসম্ভব ছিল। কী অনবদ্য অভিনয়, কী অসাধারণ বাচনভঙ্গি। নায়িকা হিসেবেও এটি গীতাদের কেরিয়ারে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এককালে একা দুর্বল মেয়েদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশে ডাইনি অপবাদ দেওয়া হত প্রত্যন্ত নানা গ্রামে। সেইরকম একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন গীতা দে।

জীবন বারবার খাদের ধারে থেকে দিয়েছে গীতা দে-কে, ঘুরে দাঁড়িয়ে খানিকটা পথ চলেছেন, খানিকটা লড়াই করেছেন, আবার নতুন বিপদ ধেয়ে এসেছে জীবনে। আজীবন উপেক্ষিতা গীতা দে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় গীতার। সম্ভ্রান্ত পরিবার। তবে তো সুখের সময় অভিনেত্রীর। কিন্তু জীবন চাকা বড়োই নিষ্ঠুর। হঠাৎই এই সময় মাকে হারালেন গীতা দে, ছোট ছোট ভাই বোনেদের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। এদিকে তিনি তখন সদ্য বিবাহিতা। এমনিতেই বৌমা অভিনয় করে জেনে শাশুড়ির পছন্দ ছিল না তার ওপর আবার বাড়তি ভাই বোনের দায়িত্ব, মেনে নিল না শ্বশুরবাড়ি। প্রতারিত হলেন স্বামীর থেকেও। ছোট ছোট ভাই বোন এবং নিজের তিন সন্তানকে নিয়ে কার্যত রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন গীতা দে। বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় বলতে ছিল কেবল ওই অভিনয় দক্ষতাটুকুই। আবার ফিরে গেলেন অভিনয়ের কাছে।

আরও পড়ুন - উত্তমের সঙ্গে দারুণ ভাব, অথচ সুচিত্রাকে চলতেন এড়িয়ে, অনুপ কুমারকে কি ভুলেছে বাঙালি?

আজীবন কষ্ট করেছেন গীতা দে। সংসার তাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দেয়নি কখনওই। দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেননি বলেই হয়তো এই পরিণতি! ‘ডাইনি’, ‘মৌচাক’, ‘সাথী হারা’, ‘পুত্রবধূ’, ‘পিতা পুত্র’, ‘হাটে বাজারে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘তিন কন্যা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মর্জিনা আব্দুল্লাহ’, ‘মেম সাহেব’, ‘আক্রোশ’, ‘ঝংকার’, ‘জতুগৃহ’, ‘দেবীপক্ষ’, ‘তিন ইয়ার কথা’ একের পর এক অনবদ্য কাজ। অথচ সঞ্চয় করতে পারেননি কিছুই। সারা জীবন ভাই বোন এবং সন্তানদের মানুষ করতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় টলিপাড়াতেও তিনি পরিচিত ছিলেন গীতা মা নামে, এমনটাই আগলে রেখেছিলেন সকলকে। অথচ নিয়তি এতই নিষ্ঠুর যে শেষ বয়সে আবারও একা করে দিয়েছিল এমন মানুষকে। আবার নিসঙ্গ জীবন। শোনা যায়, শেষ বয়সে শাড়ির ব্যবসাও করতে হয়েছে ডাকসাইটে অভিনেত্রীকে।

‘গীতা দে’ নামটা যেন কেমন করে কালের গর্ভে তলিয়ে গেল, এ দায় কার? শুধুই তাঁর পরিবার? বাংলা ইন্ড্রাস্ট্রির কি একেবারেই কোনও দায় নেই এতে? গীতা দে-র অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে এক বিদেশি পরিচালক বলেছিলেন, ইউরোপ বা আমেরিকায় জন্মালে অবশ্যই অস্কার পেতেন অভিনেত্রী। অথচ ষাট বছরের অভিনয় জীবনে তাঁর পুরস্কারের ভাঁড়ার শূন্য। সবটাই কেবল নিয়তি? কেন আজও বিস্মৃতির অতলে অনবদ্য অভিনেত্রী, এই সহজ অঙ্কের হিসেব মেলে না কিছুতেই।

More Articles