মাতঙ্গিনী হাজরার আন্দোলনের পিছনে ছিল বড় পরিকল্পনা, পাল্টে যেতে পারত ভারতের ইতিহাস
মাতঙ্গিনী হাজরার কথা উঠলে আমরা সবাই সেই বিখ্যাত মিছিলের ঘটনা বললেও তার পিছনে থাকা বৃহৎ উদ্দেশ্যের কথা আমরা ভুলে যাই।
স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে বাংলার বহু বিপ্লবী আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। মেদিনীপুরের মাটিতে সেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ৭২ বছর বয়সি মহিলার নাম। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে আমরা তাঁর ব্যাপারে কতটা জানতে চেয়েছি? মেদিনীপুরের গান্ধীবুড়ির শেষ লড়াইয়ে কি সত্যি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে সাহায্য করার পরিকল্পনার বীজ বপন করা হয়েছিল? মাতঙ্গিনী হাজরা কি শুধুই বহু মানুষ নিয়ে মিছিল করে একটা থানা দখল করতে গিয়েছিলেন, না কি তার পিছনে ছিল এক বিশাল পরিকল্পনা?
১৯৪২ সাল। মানুষ তখন সর্বস্তরে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা শুরু করেছে। সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানিতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর একটা অংশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তখন তার পরিচয় শুধু সুভাষচন্দ্র বসু নেই। মানুষের কাছে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জার্মানিতে থেকে তিনি ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। সেই সময় মহাত্মা গান্ধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন। ভারতের সর্বত্র এই আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছিল। বিপদ দেখে ইংরেজরা সমস্ত আন্দোলন প্রতিহত করার ব্যবস্থা করলেও মেদিনীপুরের আন্দোলনের তীব্রতা হয়তো তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ভারত ছাড়ো ডাক শুনে কিছু মিছিল, অবরোধ অথবা দখলের থেকেও বেশি দূর যে মেদিনীপুরের মানুষ এগিয়ে যাবে তা হয়তো সেই সময়ে কারওরই মাথায় আসত না। ব্রিটিশরা তাদের ততটাও গুরুত্ব দেয়নি, আন্দোলনকারীদের অংশ হিসেবেই দেখছিল। কিন্তু মেদিনীপুরের মানুষের মাথায় তখন অন্য পরিকল্পনা ছিল।
গান্ধীর ইংরেজ ভারত ছাড়ো ডাক শুনে মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা ঠিক করেছিলেন যে, তাঁরা মেদিনীপুরে ব্রিটিশদের উৎখাত করে তাঁর বদলে ভারতীয়দের সরকার স্থাপন করবেন। সেই পরিকল্পনামতো বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা কেটে, গাছ ফেলে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। এই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে এল সেই দিন। ২৯ সেপ্টেম্বর প্রায় ছ'হাজার মানুষের মিছিল তমলুক পুলিশ স্টেশন দখলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল। মিছিলের শুরুতে এগিয়ে চলেছেন তাঁদের নেত্রী, ৭২ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা। মানুষের কাছে তিনি গান্ধীবুড়ি নামে পরিচিত ছিলেন। বহু সামাজিক এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর সঙ্গে জড়িত মাতঙ্গিনী মানুষের খুবই কাছের ছিলেন। কথিত আছে যে, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর জন্য জেলবন্দি থাকার পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ামাত্র তিনি মানুষের সেবায় ছুটে গিয়েছিলেন। ভাবাই যায় না যে, সেই সময় এক বৃদ্ধা নিজে মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ছ'হাজার মানুষকে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ভাবলে মনে হয়, কল্পকাহিনি; কিন্তু বাস্তব মাঝে মাঝে কল্পনার থেকেও এগিয়ে থাকে। লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পুলিশের তরফ থেকে ১৪৪ ধারার কথা জানিয়ে গুলি চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। মাতঙ্গিনী তাদের হুঙ্কার শুনে দমে যাননি। পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখপত্র অনুযায়ী তিনি একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। হয়তো গুলিগুলো ছুটে এসেছিল ইংরেজদের অধীনে কাজ করা কোনও ভারতীয়র তাক করা বন্দুক থেকেই। বিপ্লবী সংবাদপত্র অনুযায়ী জানা যায় যে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি সবাইকে পিছনে ফেলে একাই এগিয়ে গিয়েছিলেন। শেষে হাতে পতাকা ধরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে সংগ্রামের আগুন আরও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। তারই ফলস্বরূপ ১৭ ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: একসময় স্বাধীনতা সংগ্রামের আখড়া, আজ কলকাতার রাজপথে অবহেলিত হয়ে দাঁড়িয়ে এই বাড়ি
ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় বিভিন্ন এলাকায় বিপ্লবীদের দ্বারা নিজেদের সরকার গঠন হলেও তাম্রলিপ্ত সরকারের মতো দীর্ঘ সময়ের জন্য সেইগুলি স্থায়ী হতে পারেনি। ১৭ ডিসেম্বর গঠিত হওয়া এই সরকার ৮ আগস্ট, ১৯৪৪ অবধি স্থায়ী ছিল। এই স্বাধীন সরকারের নিজস্ব এলাকা, আদালত, থানা এমনকী, রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি ছিল। ব্রিটিশ শাসনের পাশাপাশি এই স্বাধীন সরকার নিজের বিভিন্ন কার্যকলাপ বজায় রেখেছিল। সতীশকুমার সামন্ত, সুশীলকুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো বিপ্লবীরা এই সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। সেই সময় মেদিনীপুরে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা হয়েছিল। তাম্রলিপ্ত সরকারের পক্ষ থেকে দুর্যোগ-কবলিত এলাকায় ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্কুলে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাম্রলিপ্ত সরকার বিদ্যুৎবাহিনী নামে একটি সেনাদল তৈরি করেছিল। এই সেনাদের প্রধান ছিলেন সুশীলকুমার ধাড়া। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া তাঁদের একটি গোপন উদ্দেশ্য ছিল। নেতাজি সেই সময়ে ব্রিটিশ শাসনের ওপর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যদি নেতাজি সেনা-সহ বাংলায় প্রবেশ করতে পারেন, তাহলে বিদ্যুৎবাহিনীর তাঁকে সবরকমের সাহায্য করার পরিকল্পনা ছিল। মহাত্মা গান্ধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন বন্ধ করার অনুরোধের পর তাম্রলিপ্ত সরকারের অবসান ঘটে।
মাতঙ্গিনী হাজরার কথা উঠলে আমরা সবাই সেই বিখ্যাত মিছিলের ঘটনা বললেও তার পিছনে থাকা বৃহৎ উদ্দেশ্যের কথা আমরা ভুলে যাই। আসলে আমরা নিজেদের ইতিহাস ভুলে যাই। তাই হয়তো তাম্রলিপ্ত সরকার এত বড় একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলার পরেও ইতিহাসের একটা ধুলোপড়া পাতায় কয়েকটা লাইন হয়ে থেকে গিয়েছে।