একসময় স্বাধীনতা সংগ্রামের আখড়া, আজ কলকাতার রাজপথে অবহেলিত হয়ে দাঁড়িয়ে এই বাড়ি

৪৮ নম্বর বিধান সরণির বাড়িটি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো এই যে, এত বড় কর্মকাণ্ডর সঙ্গে জড়িত বাড়িটা মানুষের কাছে সেইরকম গুরুত্ব এবং সন্মান পায়নি, যা তার প্রাপ্য ছিল।


স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের বহু অধ্যায় ইতিহাসের পাতায় শুধু কয়েকটা লাইন হয়েই রয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং তাদের আখড়ার বহু অজানা ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে রয়েছে। সাধারণ মানুষের অবহেলা সহ্য করে তারা আমাদের চারপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের অবদান আমরা কয়েকটা লাইন লিখে এবং ইতিহাস বইতে পড়ে শান্তি পেলেও তাদের বহু অজানা গল্প শুনতে চাই না।

১৯০২ সালে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতি। প্রমথনাথ মিত্র, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ এবং বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এই সমিতির গঠন, প্রসার এবং কার্যকলাপে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ এবং সাধারণ মানুষের জন্য অনুশীলন সমিতি শরীরচর্চার কেন্দ্র ছিল। যদিও শরীরচর্চার কেন্দ্রের আড়ালে এই সমিতি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ-বিরোধী সহিংস আন্দোলনে জড়িত বিপ্লবীদের সংগঠন। সময়ের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলায় বিভিন্ন এলাকায় অনুশীলন সমিতি নিজেদের শাখা ছড়াতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকার অনুশীলন সমিতি। স্কুলশিক্ষক পুলিনবিহারী দাস এই শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতির বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য 'যুগান্তর' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকার মূল কাজ ছিল, অনুশীলন সমিতির চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। এই পত্রিকায় লেখার কারণে বহু বিপ্লবী গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে 'যুগান্তর' নামে বিপ্লবীদের একটি সংগঠন তৈরি হয়, যাঁরা সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন।

১৯০৭ সাল থেকে অনুশীলন সমিতি বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছিল। সেই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনটি ঘটনার ফলে অনুশীলন সমিতি ব্রিটিশদের কালোতালিকাভুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গের ফলে তৈরি হওয়া নতুন পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ট্রেনে হামলার প্রচেষ্টা, ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার পরিকল্পনা এবং ৩০ ডিসেম্বর কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা। এক মাসের মধ্যেই তিনবার ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ তারা সহজে মেনে নিতে পারেনি। হাওড়া ব্রিজের কাছে গঙ্গার ধারে কুস্তির আখড়া অথবা কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের একটা শরীরচর্চার কেন্দ্র থেকে যে আসলে ক্ষুদিরাম বসু অথবা প্রফুল্ল চাকী বেরিয়ে আসতে পারেন, সেই কথা হয়তো ব্রিটিশরা ভাবতে পারেনি। তাদের প্রিয় কলকাতায় এইরকম এক সহিংস আন্দোলনের সমিতির সূচনা এবং মাছ-ভাত খেয়ে মৌখিক বিরোধিতা করা মানুষগুলো হঠাৎ বন্দুক, বোমা নিয়ে তাদের ওপর হামলা করছে দেখে ব্রিটিশরা যে খুশি হতে পারেনি, সেটা বলাই বাহুল্য। নিজেদের ওপর আক্রমণ হতেই ধরপাকড় শুরু হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই ব্রিটিশরা মুরারিপুকুরের কাছে এক বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির কারখানার হদিশ পেয়েছিল। এই ঘটনার ফলে শুরু হয় বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলা।

আরও পড়ুন: আত্মহত্যা না খুন? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও রহস্যে মোড়া প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু

আলিপুর বোমা মামলার ফলে কলকাতায় অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ কিছুটা থমকে যায়। পুলিশ গুপ্তচর সমিতির সদস্যদের ওপর নজর রাখতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে শিরোনামে উঠে এসেছিল ঢাকার অনুশীলন সমিতি। অনুশীলন সমিতি বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও তারা নিজেদের মধ্যে স্বতন্ত্র ছিল। যদিও তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। কথিত আছে যে, কলকাতায় অনুশীলন সমিতি পুলিনবিহারী দাসকে আশ্রয় দিত। বহুবার বিভিন্ন সমিতির একসঙ্গে তৈরি করা পরিকল্পনার কথা জানা যায়। পুলিনবিহারী দাস এবং ভূপেশচন্দ্র নাগ ঢাকার অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠা এবং প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিলেন। তাদের পরে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী এবং প্রতুলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় অনুশীলন সমিতি গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৩২ সালের মধ্যে ঢাকা এবং তার আশপাশের এলাকায় পাঁচশোর কাছাকাছি অনুশীলন সমিতি গড়ে উঠেছিল। যুগান্তর এবং ঢাকা অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুঠ, ইউরোপীয় ক্লাবে হামলা এবং জালালাবাদের লড়াইয়ের কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। মাস্টারদার মৃত্যুর পরে সমিতির তরফে এই ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমান উত্তর কলকাতার বিধান সরণির একটি বাড়ি থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ চলত। সেই ৪৮ নম্বর বিধান সরণির বাড়িটি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো এই যে, এত বড় কর্মকাণ্ডর সঙ্গে জড়িত বাড়িটা মানুষের কাছে সেইরকম গুরুত্ব এবং সন্মান পায়নি, যা তার প্রাপ্য ছিল। তাতে হয়তো তার কিছুই আসে না। হাজার হোক, বিপ্লবীদের আখড়া বলে কথা। বিপ্লবীদের মতোই স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজের যোগদানের পরে সে চুপ করেই রয়েছে। সেই চুপ করে দাঁড়িয়ে হয়তো সে তার দেশভাগ এবং স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরের অবস্থা দেখছে।

More Articles