এখনও বেজে ওঠে উত্তম কুমারের হারমোনিয়াম, অবহেলায় দিন গুনছে কলকাতার ঐতিহ্য 'মেলোডি'

The Melody Harmonium Uttam Kumar : দোকান দেখলে কে বলবে, এই ‘মেলোডি’-ই বাংলার সঙ্গীত জগতের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ?

কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউয়ের এই দোকানটাকে বাইরে থেকে দেখলে সেরকম কিছু হয়তো মনে হবে না। পুরনো একটি দোকান, চারদিকের কংক্রিটের গন্ধের মধ্যে ছোট্ট একটা পুরনো কলকাতার স্পর্শ। এমনিতে সেরকম ভিড় নেই। ভেতরে একমনে কাজ করে চলেছেন কয়েকজন। কাঠ পালিশ, সপ্ত সুরের জাদু আর টুং টাং আওয়াজ। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, দোকানের ভেতর আপন মনেই কিছু সুর তৈরি হচ্ছে। রাসবিহারী এভিনিউয়ের ‘দ্য মেলোডি’ এরকমই সুরের আস্তানা। বাইরের বোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘হোম অফ মেলোডি হারমোনিয়াম’। আজকের এমন জনশূন্য, বিধ্বস্ত অবস্থা দেখলে আসল ছবিটা ঠিক ধরা যাবে না। দোকান দেখলে কে বলবে, এই ‘মেলোডি’-ই বাংলার সঙ্গীত জগতের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ? বলা ভালো, নিজেই জ্বলজ্যান্ত একটি ইতিহাসের অধ্যায়!

ঘরের ভেতর সার দিয়ে রাখা কাঠ, পালিশ করার যন্ত্র, ছেনি-হাতুরি। বিশ্বকর্মার এই দরবারে সর্বক্ষণই চলেছে সুরের নির্মাণ। আজ থেকে নয়, প্রায় ৮৫ বছর ধরে এই আধো অন্ধকার ঘরেই চলছে হারমোনিয়াম তৈরির কাজ। গান শিখতে গেলে হোক, কিংবা রেওয়াজ করা – হারমোনিয়াম তো সঙ্গীত স্রষ্টা, গায়ক-গায়িকাদের নিত্যসঙ্গী। তাই তাকে তো ঠিকঠাক করতেই হবে। ‘মেলোডি’ সেই সুর সাজানোর বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। একসময় তাবড় কিংবদন্তিদের ঠিকানা ছিল এই দোকানটি। ‘মেলোডি’ মানেই যাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা জায়। এখনও সেই দক্ষতার জায়গাটা এক থাকলেও, ভিড়ের ছবিটা নেই। এখন ছোট্ট গলিটায় ঘুরে বেড়ায় ইতিহাসের ফিসফিস স্বর…

আরও পড়ুন : শ্মশান থেকে মৃতদেহ তুলে আনা হতো পুজোয়, চমকে দেয় উত্তর কলকাতার কালী মন্দিরের ইতিহাস

এই মেলোডি দোকানটি আজও একটি বিশেষ কারণে অনন্য। কলকাতা কেন, বাংলার কোনও দোকানেই সেই বিশে ঘটনাটি ঘটে না। তার জন্য একটু খোঁজখবর নিয়েই আসতে হবে আপনাকে। তখন দেখবেন, বার্মা টিক কাঠের তৈরি একটি হারমোনিয়াম। তাঁকে ঘিরে দোকানের কর্মীদের যত্নআত্তির শেষ নেই। মন দিয়ে হারমোনিয়ামটি পালিশ করছেন তাঁরা। কেউ গিয়ে রিডগুলো ঠিক করে দিচ্ছেন, কেউ হারমোনিয়ামটির কি গুলো ঠিক করছেন। কেউ আবার নেড়েচেড়ে দেখে নিচ্ছেন টিউনিং ঠিক আছে কিনা। টেবিল মডেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম এটি; কিন্তু বিশেষত্ব কোথায়? একটু নজর দিলেই দেখা যাবে আসল জিনিসটি। হারমোনিয়ামের গায়েই খোদাই করা আছে তাঁর নাম – ‘উত্তম কুমার’।

তাঁকে দেখে সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকত। অভিনয়ের ময়দানে তিনি মহানায়ক, অমন ভুবন ভোলানো হাসি আর কোনও বাঙালি পুরুষের কাছে ছিল? উত্তম কুমার বাঙালির আইকন ছিলেন, আছেন, থাকবেন। অবশ্য কেবল অভিনয় নয়, তিনি সঙ্গীত সাধনাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হারমোনিয়াম নিয়ে নিয়মিত রেওয়াজ করতেন। জানা যায়, উত্তম কুমারের মোট দুটি হারমোনিয়াম ছিল। একটি ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়িতে, অন্যটি ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে, যেখানে সুপ্রিয়া দেবী থাকতেন।

ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়িতে থাকা হারমোনিয়ামটি আজও রয়েছে বহাল তবিয়তে। উত্তম কুমার নেই; কিন্তু তাঁর সাধের হারমোনিয়াম এখনও নিজের মধ্যে ভেজে চলে সারেগামার মন্ত্র। আর সেই যন্ত্রের আত্মাটিকে ঠিক রাখার দায়িত্ব ‘দ্য মেলোডি’-র। আজ থেকে নয়, বহু বছর ধরে উত্তম কুমারের হারমোনিয়াম ঠিক রাখার দায়িত্বে রয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এখনও বছরে বেশ কয়েকবার মেলোডির আধো আলো, আধো অন্ধকার ঘরে মেরামত করা হয় ওই বিশেষ হারমোনিয়াম। একটা সময় খোদ উত্তম কুমারও নাকি এখানে আসতেন। কারিগর রোহিত হাইত নিজেই বহু বছর ধরে এই হারমোনিয়াম সারাই করছেন। সেই পুরনো কর্মীদের মুখেই বারবার ঘুরে বেড়ায় পুরনো দিনের সোনালি সময়ের কথা।

আরও পড়ুন : হাত পাতলেই মেলে ‘চাউমিন’ প্রসাদ, যেভাবে কলকাতার কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চিনারা

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শ্যামল মিত্র – কাদের পা পড়েনি এখানে? মান্না দে তো ‘মেলোডি’ ছাড়া আর কোনও দোকানকে পাতাই দিতেন না। হারমোনিয়ামের সামান্য সমস্যা হলেই ছুটে আসতেন এই দোকানে। এখানকার ‘বিশ্বকর্মা’দের আগলে রেখেছিল বাংলার সঙ্গীত জগত। সেখানেই জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন গল্প। একবার লোডশেডিং হয়ে গিয়েছে। তারই মধ্যে মান্না দে-র হারমোনিয়াম একটু বিগড়েছে। ব্যস, সেই সময়ই সটান মেলোডি-তে চলে এলেন তিনি। হারমোনিয়াম নিয়েই চলছে সুরের সাধনা। দোকানে বসেই গান গেয়ে চলেছেন মান্না দে! দোকানের পুরনো কর্মীদের কাছে এখনও নাকি সেই গান রেকর্ড করা রয়েছে।

কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথাই ধরা যাক। একবার বাংলাদেশে প্রোগ্রাম করতে যাওয়ার আগে মেলোডি-তে এসেছেন নতুন হারমোনিয়াম কিনতে। তখন হেমন্তবাবুর বয়সও হয়ে গিয়েছে। জীবনের শেষ লগ্ন প্রায়। সেই চিরাচইত হারমোনিয়াম বেছে পছন্দ করলেন। কর্মীরা বললেন, এখন বয়স হয়েছে, কেন ভারী হারমোনিয়াম নিচ্ছেন? শরীরের কষ্ট হবে তো! হালকা একটা কিছু নিন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মিত হেসে বললেন, পোর্টেবল হালকা হারমোনিয়াম কখনও ব্যবহার করেননি। এখনও করবেন না।

মেলোডি-র কর্মীদের সঙ্গে এই কিংবদন্তি গায়ক, সুরকারদের এক অদ্ভুত আত্মীয়তার বন্ধনও তৈরি হয়েছিল। এই যেমন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি যখনই আসতেন, হারমোনিয়াম দোকানের কর্মীদের হাতে ধরিয়ে দিতেন। তারপর দোকান থেকেই অন্য একটি হারমোনিয়াম টেনে নিতেন। যতক্ষণে বাকিরা ওই হারমোনিয়ামটি সারাচ্ছেন, ততক্ষণ একমনে গান গেয়ে চলেছেন মানবেন্দ্র। শ্রোতা কেবল মেলোডি-র কর্মীরাই। এইভাবেই তৈরি হতো একের পর এক ইতিহাস। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুবিনয় রায় – অনেকেই এসে ভিড় জমাতেন এখানে। সে এক এলাহি ব্যাপার ছিল।

আরও পড়ুন : মাত্র দেড়শো টাকা আর চূড়ান্ত অপমান! সেই মহালয়া উত্তমের কাছে ছিল অভিশাপের মতো

আর আজ? সেই সোনালি দিনের কথা ভেবে হতাশ হয়ে যান দোকানের বর্তমান কর্মীরা। একটা সময় একসঙ্গে ১৪-১৫ জন কর্মী সমানে কাজ করে যেতেন দোকানে। আর আজ সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৪-৫ জনে। হারমোনিয়ামের সঙ্গে গুটার, সেতারও মেরামত করে মেলোডি। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তো আর এদিকে আসছে না। তাঁদের ধৈর্য নেই। সেই সোনালি দিনগুলোও তো আর নেই। রাসবিহারী এভিনিউয়ের একটা কোণে একপ্রকার ‘নেই’ হয়ে আছে ‘দ্য মেলোডি’। তার ইতিহাস আজ জানে কজনে!

More Articles