মাছ ছাড়া ভাত খান না স্বয়ং কালী, লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গিয়েছে বাংলার এই শক্তিপীঠ
Kiriteswari Shakti Peeth Temple : নবাবি আমলের স্থাপত্য আজও রক্ষিত রয়েছে এই মন্দিরের পরতে পরতে। জাতি-ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এখানে।
সতীর মুকুটের কনা বা কিরীট পড়েছিল বলেই এই স্থানে দেবীর রূপের নাম হয় কিরীটেশ্বরী। পুরাণ মতে, সতীর মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে পাগল হয়ে তাণ্ডব মৃত্যু শুরু করেছিল মহাদেব। সতীর নিথর দেহ নিয়ে বিশ্ব ব্রম্ভান্ড তাণ্ডব চালিয়েছিলেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে বিষ্ণুদেব তাঁর চক্রের সাহায্যে সতীর দেহ ৫১ টা টুকরো করেন। এবং সেই টুকরোগুলোই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায়। পরবর্তীকালে দেহের ওই নির্দিষ্ট খন্ডাংশের নামেই সেই জায়গায় স্থাপিত হয় দেবীর মন্দির। পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে প্রায় ১৪ টি সতীপিঠ। ইতিহাস আর ঐহিহ্যের জোর যে অনেকখানি তা অবশ্য নতুন করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। তার সঙ্গে যদি আবার যোগ হয় মিথ তবে তো জোর অনেকটাই বেড়ে যায়।
শক্তি পিঠের এই ইতিহাস অনেক পুরনো। মুর্শিদাবাদ জেলার একমাত্র সতীপীঠ এটাই। খুবই জাগ্রত হিসেবে লোকমুখে প্রচার পান দেবী কিরীটেশ্বরী। কালীঘাটের কালীর যেমন মাছ ছাড়া ভোগ অসম্পূর্ণ থেকে যায় ঠিক তেমনই এখনকার দেবীও সন্তুষ্ট হন মাছ ভাতেই। নবাবি আমলের স্থাপত্য আজও রক্ষিত রয়েছে এই মন্দিরের পরতে পরতে। জাতি -ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিরীটেশ্বরী সতীপীঠে আজও যেন জীবন্ত মায়ের রূপ। এখানে দেবীর দেহের কোনও অংশ পড়েনি, কথিত রয়েছে মুকুট পড়েছিল এখানে তাই অনেকে একে উপপীঠও বলেন। যদিও এই স্থানের নাম নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু ভিন্ন মত। কেউ এই তীর্থস্থানকে ডাকেন কীর্তিশ্বরী নামে। আবার দেবীর মুকুটের অংশ পড়েছিল বলে অনেকেই একে ডাকেন মুকুটেশ্বরী বা মুক্তেশ্বরী বলে। শাস্ত্র অনুযায়ী দেবী এখানে বিমলা রূপে পরিচিত আর তাঁর ভৈরবের নাম সম্বর্ত।
আরও পড়ুন - ঘুমের বড়ি নয়, মিষ্টি খেয়েই ঘুমাতে যান কালীঘাটের কালী, জানেন কী নাম এই মিষ্টির?
যদিও এই সবের মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হল, এই এত বিখ্যাত মন্দিরে প্রবেশ করলে কোনও দেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় না এখানে। এমনকী নিদেনপক্ষে একটা ছবিও নেই কোনও। একটা পাথরে লাল রঙের শিলাকে আবরণ জড়িয়ে পুজো করা হয় এখানে। নিয়ম মেনে প্রতি বছর দুর্গাষ্টমীতে এই আবরণটি পাল্টানো হয়। শোনা যায়,যে মুকুটের মহিমাতেই এই শক্তিপীঠের উৎপত্তি তা রানি ভবানীর গুপ্তমঠে সুরক্ষিত রয়েছে। এই গুপ্তমঠ দেবী মন্দিরের কাছেই।
এখন যে মন্দিরটি মুর্শিদাবাদের শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত, সেটা অবশ্য পরবর্তীকালে তৈরি করা হয়েছে। প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ নতুন মন্দিরের সামনে এখনও পড়ে থাকতে দেখা যায়। অতীতের সেই ভগ্ন মন্দিরটি ছিল দক্ষিণদুয়ারী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪০৫ সালে দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। তার পরে ১৯ শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায় এই নতুন মন্দির নির্মাণ করেন।
আরও পড়ুন - হাত পাতলেই মেলে ‘চাউমিন’ প্রসাদ, যেভাবে কলকাতার কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চিনারা
মুর্শিদাবাদ মানেই ইতিহাসের শহর। নবাবি আস্তানা। এখনও সেই যুগের ইতিহাস বয়ে বেড়ায় এই শহর। যার ব্যতিক্রম নয় মন্দিরটিও। কথিত রয়েছে,পলাশীর যুদ্ধের পর যখন মিরজাফর, নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা রাজবল্লভকে ডুবিয়ে মারেন। সেই দিন এই মন্দিরের এক শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই ফেটে গিয়েছিলমল। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, মিরজাফর শেষ বয়সে কুষ্ঠ রোগের অব্যর্থ হিসেবে আন হয় দেবীর চরণামৃত। এমনকী এ কথাও শোনা যায় যে, আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় পাণ্ডারা মূল মন্দির থেকে গুপ্তমঠে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে প্রথমে জনাকয়েক পাণ্ডা দেবীর রূপ দেখেন তারপরেই নাকি তারা অন্ধ হয়ে যান। আসলে এই সব প্রাচীন বিশ্বাসের কোনও সঠিক প্রমাণ মেলে না, তবুও লোকমুখে প্রচার পেয়েই জনপ্রিয়তা বাড়ে।
প্রতিবছর ভাগীরথী তীরে এই মন্দিরে কালীপুজোর দিন বিরাট করে পুজো হয়। পাঁচ পদ রান্না ছাড়া ভোগ মুখে তোলেন না দেবী। আবার মাছ ছাড়াও মোটেই ভাত খেতে পারেন না তিনি। প্রিয় মাছ পোড়া শোল মাছ। রাতে আবার পাঁঠার মাংস খান দেবী।ইতিহাসবিদরা বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। আজও মন্দিরে পা দিলেই শুরু হয় টাইম ট্রাভেল। ইতিহাস যেন অচিরেই পা চেপে ধরে। তিন ধর্মের স্থাপত্যের মিশেলে এই মন্দির যেন সাক্ষাৎ ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও কালীঘাট, কঙ্কালীতলা অথবা কালীঘাটের মতো সেইভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি এই জায়গা, কিন্তু ইতিহাসের জোরে বাকি শক্তিপীঠগুলির সঙ্গে একই সারিতে বিরাজ করেন দেবী কিরীটেশ্বরী।