ব্যাগ পিঠে রোজ ৩ কিমি রাস্তা পেরিয়ে স্কুল, শেখার স্বপ্নে মশগুল আশির 'ছোকরা'

78YO Mizoram Man: এই বয়সে এসেও ইংরেজি শিখতে চান তিনি। শুধু শিখতেই চান না, ইংরেজিতে গড়গড়িয়ে চিঠিও লিখতে চান লালরিং। টিভি-তে ইংরেজি খবর শুনবেন, সেসব বুঝতে পারবেন, এ সাধ তাঁর কতদিনের।

কথায় বলে, শেখার কোনও বয়স হয় না। কথায় এ-ও বলে, বয়স সংখ্যা মাত্র। এসব শুধুই কি কথার কথা, নাকি কেউ কেউ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দেন এসব বাগধারা, কথার কথাকে। এই মানুষটার কথাই ধরুন না, বয়স আটাত্তর পেরিয়েছে। ক্রমে ধীর পায়ে হাঁটা লাগিয়েছেন আশির দিকে। অথচ ইচ্ছাশক্তিতে পড়েনি বয়সের ছোপ। বরং বয়সের ভারকে কাঁচকলা দেখিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন নতুন কিছু শেখার, জানার আনন্দের কাছে।

টাকা পয়সার অভাব, সংসারের জোয়াল কাঁধে নিতে গিয়ে পড়াশোনা শেখার ইচ্ছাটাকে শিকেয় তুলতে হয়েছিল মিজোরামের বাসিন্দা লালরিংথারাকে। অর্থাভাবে স্কুলছুট হওয়ার ঘটনা এ দেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়। সংসার টানতে গিয়ে কমবয়সেই উপার্জনের পথে নামাটাও। সেই একই স্রোতে ভাসতে হয়েছিল লালরিংথারাকেও।

আরও পড়ুন: অবিশ্বাস্য! বয়সকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন এই ব্যক্তি? কীভাবে?

কিন্তু তাই বলে স্বপ্ন কি থেমে থাকে! শিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা পিছু ছাড়েনি তাঁর এই আটাত্তরেও। আর সেই অদম্য ইচ্ছের ডানায় ভর করেই আশির দোরগোরায় পৌঁছে স্কুলে যান লালরিং। ১৯৪৫ সালে মিজোরাম-মায়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চম্পাই জেলার খুয়াংলেং গ্রামে জন্ম লালরিংয়ের। পরিবার-পরিস্থিতির চাপে দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। বাবার মৃত্যুর পর মাকে সাহায্য করতে হাত লাগাতে হয়েছিল চাষবাসের কাজে। তারপর বাড়িবদল। পড়াশোনার যেটুকু সুযোগ ছিল, তা-ও যেন শেষ করে দিল। লালরিংয়ের মতো আশা ছাড়েননি মা-ও। বছর তিনেক পর চেষ্টাচরিত্র করে ফের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করালেন ছেলেকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ফের সংসারের চাপে স্কুলছুট হলেন লালরিং।

বেঁচে থাকার জন্য, পেট চালানোর জন্য স্থানীয় একটি গির্জায় পাহারাদারের চাকরি নিলেন লালরিং। এখনও সেই চাকরি করছেন তিনি। তবে তার সঙ্গে করছেন স্বপ্নপূরণও। বাংলা ভাষায় স্বশিক্ষিত বলে একটি কথা আছে। লালরিংও কিছুটা তাই। নিজের চেষ্টায় মিজো ভাষাটি শিখেছেন তিনি। ২০১৮ সালে সমস্ত বাধা-বন্ধকতার মুখের উপর দিয়ে ফের স্কুলে গিয়ে নিজের নাম নথিভুক্ত করান লালরিং। সত্তর বছর বয়সে এসে ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে। যেখানে তিনি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন পড়াশোনা। হ্রুয়াইকাওম গ্রামের ওই স্কুলেই সেরেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠন। তবে তার পর ফের বাধা। এর পরে আর পড়াশোনার সুযোগ নেই গ্রামে। হাইস্কুলের পড়াশোনা অসম্ভব সেখানে থেকে। কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ লালরিং।

গত এপ্রিল মাসে লালরিং গিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছেন রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান হাই স্কুলে। সেটা তাঁর গ্রাম থেকে আরও তিন কিলোমিটার দূরের পথ। কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। আশির দোরগোরায় পৌঁছেও প্রতিদিন ওই রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে যান লালরিং। বৃষ্টি হোক, জল হোক, চাঁদি ফাটানো গরম হোক। কোনও কিছুই আটকাতে পারেনা লালরিংয়ের পথ।

লালরিংয়ের সাফ কথা, বয়স তাঁর জ্ঞানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না কিছুতেই। এই বয়সে এসেও ইংরেজি শিখতে চান তিনি। শুধু শিখতেই চান না, ইংরেজিতে গড়গড়িয়ে চিঠিও লিখতে চান লালরিং। টিভি-তে ইংরেজি খবর শুনবেন, সেসব বুঝতে পারবেন, এ সাধ তাঁর কতদিনের। লালরিংয়ের অসম্ভব মনের জোর দেখে স্তম্ভিত স্কুল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শেখার ইচ্ছে ও ক্ষমতা, দুটোই কমে। আর লালরিং যেন সেই দুনিয়ায় নিপাতনে সিদ্ধ। স্কুল থেকে ইতিমধ্যেই বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়েছে পোশাকআশাক ও প্রয়োজনীয় বইপত্তর। ওই স্কুলের এক শিক্ষক জানিয়েছেন, স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কোনও বাধা বয়স নেই। ফলে লালরিংকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বরং তার এই অদম্য ইচ্ছে ও মনের জোরকে কুর্নিশ জানিয়েছে স্কুল। লালরিংয়ের এই যাত্রার সঙ্গী হতে পেরে, তাঁর স্বপ্নপূরণ করতে পেরে খুশি স্কুল কর্তৃপক্ষও। তাঁদের তরফে জানানো হয়েছে, লালরিংয়ের পড়াশোনা শেষ করতে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করবে স্কুল।

আরও পড়ুন: ১০৩ বছর বয়সেও লাগাতার জিম! বয়সকে তুড়ি মেরে দূরে সরানোর যে মন্ত্র শেখাচ্ছেন এই ‘ঠাকুমা’

চল্লিশ পেরোলেই চালসে, গেটে বাত, কোমর কনকনের যুগে লালরিংথারা যেন উদাহরণ, যিনি শেখান জীবনের প্রতিমুহূর্তকে নিংড়ে কীভাবে বাঁচতে হয়। কোন মন্ত্রে বৃদ্ধ অশীতিপর শরীরেও মনকে রাখা যায় টগবগে টাটকা। আসলে এ-ও এক শিক্ষা। যা তিনি অর্জন করে ফেলেছেন বহু আগেই। এই হার না-মানার মানসিকতা আর লালরিংয়ের আশ্চর্য জীবনীশক্তিকেই কুর্নিশ জানাচ্ছে গোটা দুনিয়া।

More Articles