বারবার টার্গেট প্রধানমন্ত্রী, কতটা আটোসাঁটো মোদীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের হুমকি দিয়ে ই-মেল এসেছে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনআইয়ের মুম্বই দপ্তরে। ই-মেলের প্রেরক যে অন্তত ২০ টি স্লিপার সেল প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করছে। তাঁদের কাছে প্রায় ২০ কেজি আরডিএক্স রয়েছে। সমস্ত পরিকল্পনা হয়ে গেছে বলেও জানানো হয়েছে ই-মেলে। কয়েক বছর আগে এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদীর নিরাপত্তায় প্রতিদিন ১ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা খরচ হয়। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে সম্ভব এমনটা করা? কে বা কারা রক্ষা করেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে? বিভিন্ন সভা, পদযাত্রার সময়ে কী প্রোটোকল মেনে তাঁর নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়? 

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব কার?

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে রয়েছে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ ( এসপিজি)। দেশে এবং বিদেশেও শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীকেই ২৪ ঘন্টা নিরাপত্তা দেওয়াই কাজ এই সংস্থার। তবে শুধু প্রধানমন্ত্রী নয় তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার জন্যও নিযুক্ত রয়েছে এই ভারতীয় সংস্থা। কার্যকালের মেয়াদ ফুরানোর পরেও বেশকিছু বছর মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেন এই সংস্থাই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারা জারি করা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত নির্দেশিকাগুলি বিস্তৃত রয়েছে ' ব্লু বুক' -এ।সেই নির্দেশিকা মেনেই এসপিজি পরিকল্পনা করে থাকে তাঁর নিরাপত্তার। ১৯৮৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পরেই এই সংস্থা তৈরি করা হয়। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তর ছাড়ার পর প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকে ১০ বছর পর্যন্ত নিরাপত্তা প্রদান করতো এই সংস্থার সেনারা। পড়ে বাজপেয়ী সরকারের আমলে তা কমিয়ে ১ বছর করা হয়।

কী ভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এসপিজি?

প্রধানমন্ত্রী কোথাও গেলেই প্রতি পদক্ষেপে তাঁর সাথে এসপিজির নিখুঁত শ্যুটার থাকে তাঁর চারপাশে। এই শ্যুটাররা কোনোরকম ভুল না করেই সেকেন্ডের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীকে খতম করতে সক্ষম। এসজিপিতে প্রায় ৩০০০ সেনা রয়েছে যারা প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার জন্য দায়ী। আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।এর সৈন্যদের কাছে FNF-২০০০ অ্যাসল্ট রাইফেল, স্বয়ংক্রিয় বন্দুক এবং আধুনিক অস্ত্রের মধ্যে ১৭ এম রিভলভার রয়েছে। এমনকী প্রধানমন্ত্রীর দিল্লীর বাসভবনে সর্বক্ষণ পাঁচশোর অধিক এসপিজি কম্যান্ডার থাকেন তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।

ব্লু বুকের নিয়ম অনুসারে,প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন রাজ্য সফরের তিনদিন আগে সমস্ত নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বৈঠক সেরে ফেলেন স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ। এই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোটা পরিকল্পনা শেয়ার করা হয়। জেলার ক্ষেত্রে ওই জেলার পুলিশের সিনিয়র সুপারিনটেনডন্ট, ম্যাজিস্ট্রেটও এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং চিফ সেক্রেটারিকে জানানো হয়।

শুনে অবাক হলেও সত্যি, সফরপথে কোনো ঝোপঝাড় থাকলে তাও অনেকক্ষেত্রে কেটে দেবার নির্দেশ দেন এসপিজি। সরু রাস্তার ক্ষেত্রে ম্যাপ প্রস্তুত করানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয় সেখানে। এসপিজি শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর শরীরের কাছের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

দিল্লি পুলিশ ও রাজ্য পুলিশের দায়িত্ব

রাজধানী সংলগ্ন এলাকায় বা অন্য রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর সভার ক্ষেত্রে সেই স্থানের নিরাপত্তার বিষয়টি খুঁটিয়ে দেখেন দিল্লী পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশ। সফরের সূচি এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি আগেই রাজ্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।তবে এসপিজি নিবিড়ভাবে সফরের নিরাপত্তা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিষয়গুলি তদারকি করে।যে পথ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি চলেছে সেই রাস্তায় কোনো জনসমাগম বা ঝুঁকি নেই এই মর্মে রাজ্য পুলিশ এসপিজির কম্যান্ডোদের গ্রিন সিগন্যাল দেন।এর পরেই ওই পথে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি যায়। তবে একাধিক ব্যাকআপ রুটের পরিকল্পনা করা থাকে প্রধানমন্ত্রীর সফরে।

আরও পড়ুন-মোদীর প্রাণনাশের হুমকি এই প্রথম নয়! বারবার ঘুম উড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের

এছাড়া নিজের বাসভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী কোনো সভার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে তাঁর সম্পূর্ণ যাত্রাপথের একটি দিক ১০ মিনিটের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। দিল্লী পুলিশের একটি গাড়ি প্রধানমন্ত্রীর কনভয়ের আগে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেলে তবেই সেপথে এগোয় সেই কনভয়। এই সাইরেনের অর্থ রাস্তা নিরাপদ রয়েছে।
সভাস্থলেও মানুষের যাতায়াতের ওপর কড়া নজর রাখা হয়।মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয় প্রবেশ পথে।সভা মঞ্চের তদারকি, আবহাওয়ার খবর, ইন্টেলিজেন্সের দেওয়া তথ্য সবকিছু ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখা হয়।

জেড প্লাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাঁকে জেড প্লাস নিরাপত্তা দেওয়া হয়।এনএসজি বা ব্ল্যাক ক্যাট নামে পরিচিত সেনারা এই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন।এই সেনাবাহিনী জঙ্গি মোকাবিলায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এমপি-৫ বন্দুক ও উন্নত মানের যোগাযোগের যন্ত্রসম্পন্ন এই বাহিনীকে মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরা অস্ত্র ছাড়াও যুদ্ধ করতে পারদর্শী। ৩৬ জন এনএসজি কম্যান্ডো নিযুক্ত রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায়।

প্রধানমন্ত্রীর কনভয়

প্রধানমন্ত্রীর কনভয়ে দুটি বিএমডাব্লিউ ৭ সিরিজের সেডান, ছয়টি বিএমডাব্লিউ এক্স -৫,একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ অ্যাম্বুলেন্স সহ এক ডজন গাড়ি থাকে। পাশাপাশি টাটা সাফারি জ্যামারও থাকে তাঁর কনভয়ের সাথে।জ্যামার গাড়িটির মাথায় একাধিক অ্যান্টেনা রয়েছে, যা রাস্তার দুপাশে ১০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত পড়ে থাকা কোনও বোমকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। এই কনভয়ের একবারে সামনে এবং শেষে থাকে দিল্লী পুলিশ তথা রাজ্য পুলিশের গাড়ি। মাঝে দুটি গাড়ির মধ্যস্থলে থাকে প্রধানমন্ত্রীর বুলেটপ্রুফ বিএমডাব্লিউ গাড়িটি।

আক্রমণকারীকে বিভ্রান্ত করতে এই একই মডেলের দুটি ডামি গাড়ি ব্যবহার করা হয় তাঁর কনভয়ে।এই কনভয়ের সবকটি গাড়ি মিলিয়ে প্রায় ১০০ জন নিখুঁত এনএসজি শ্যুটার থাকে। গাড়ি থেকে নেমে সভার মঞ্চে পৌঁছনো পর্যন্ত এঁরা নিজেদের পোশাকে বা অন্য পোশাকে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে থাকেন।

বিশ্বমানের নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে ধেয়ে আসা একে-৪৭ বন্দুকের বুলেট বা শক্তিশালী বোমাকেও হার মানাবে তাঁর গাড়ির গার্ড।এমনকি গাড়িরও কোনো ক্ষতিই হবে না। গ্রেনেড হামলাতেও এই গাড়ির নিরাপত্তা থাকবে অটুট।এছাড়াও বিএমডাব্লিউ সিরিজের এই গাড়িটি ২ মিটার দূরত্ব থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত টিএনটি বিস্ফোরকের ধাক্কা সামলে নিতে পারবে।এমনকি গ্যাস অ্যাটাক থেকেও বাঁচাবে প্রধানমন্ত্রীকে।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা

নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এসজিপি কম্যান্ডোদের কাছে ৩.৫ কেজি রাইফেল রয়েছে যা বেলজিয়াম থেকে রপ্তানি করা। এই রাইফেল থেকে প্রতি মিনিটে ৮৫০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া সম্ভব। অত্যাধুনিক এই রাইফেলের রেঞ্জ ৫০০ মিটার পর্যন্ত।অনেকের হাতে সেমি অটোমেটিক বন্দুকও থাকে। হালকা ওজনের (২.২ কেজি) বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বরাদ্দ রয়েছে প্রত্যেক কম্যান্ডোর আছে।সাথে রয়েছে হাত পায়ের গার্ড। অত্যাধুনিক কালো চশমা ব্যবহার করেন এই কমান্ডোরা। এতে কোনো সন্দেহ ছাড়াই তাঁরা সামনের মানুষের ওপর নজর রাখতে পারেন। এমনকি কোনো আক্রমণের সময়েও চশমা পড়ে সহজেই দেখতে পান আশেপাশের জিনিস। বিশেষ ধরনের জুতো এবং গ্লাভস ব্যবহার করে থাকেন এঁরা। প্রশিক্ষণ চলাকালীন কম্যান্ডোদের মার্শাল আর্টেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

আকাশপথে নিরাপত্তা

প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন রাজ্যে বা বিদেশ সফরের সময় ভারতীয় বায়ু সেনার বিমান ব্যবহার করেন।তিনি সোজা বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল অংশে  প্রবেশ করেন যা দিল্লীর দ্বারকার কাছে অবস্থিত। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দুটি বিমান রাখা থাকে।এর মধ্যে একটি স্ট্যান্ড বাই হিসেবে রাখা হয় যা দরকারে ব্যবহার করা হয়। তাঁর ব্যবহৃত বিমানটি হল বোয়িং ৭৪৭-৪০০ এআই-১ (AI 1) বিমানবন্দরে প্রবেশ করা মাত্রই সেই জায়গার আকাশপথে অন্য বিমানের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় অল্প সময়ের জন্য। বিমানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর কর্মচারী এবং এনএসজি কম্যান্ডো থাকে।

অন্যান্য দেশ প্রধানদেরদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন?

শুধু ভারতে নয় আমেরিকা,রাশিয়া, চিনের মতো দেশেও প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে নির্দিষ্ট সংস্থা। প্রেসিডন্ট পুতিনের নিরাপত্তা রক্ষার্থে বুলেটপ্রুফ ব্রিফকেস, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পিস্তল সহ দেহরক্ষীর পাশাপাশি খাবারের স্বাদগ্রহণের জন্য লোক রয়েছে। অন্য দিকে, পুতিন এবং বাইডেন দুজনেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বুলেটপ্রুফ লিমোসিন গাড়ি ব্যবহার করেন। এই দেশ নেতাদের মতোই চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নিরাপত্তাও এতই কঠোর যে কাকপক্ষীও গলতে পারবে না। কঠোর প্রশিক্ষণের পরেই এদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োগ করা হয়। ৮ হাজারের বেশি সেনা চিনা রাষ্ট্রনেতার নিরাপত্তার দিকটি দেখাশোনা করেন।বলা হয়, জিনপিং যে গাড়ি ব্যবহার করেন তা যুদ্ধের ট্যাংকের থেকে কিছু কম নয়।কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের নিরাপত্তা বলয়। ১৫ হাজার নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে কিমের। এছাড়া তাঁর ব্যবহৃত লিমো গাড়ি যে কোনো ধরনের বিস্ফোরণের মোকাবিলা করতে সক্ষম।

More Articles