জলের অতলে ডুবোজাহাজ, টাইটানে চড়ার মাথাপিছু খরচে চমকে উঠতে হবে!

Titan Submersible Sinking: ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইউরোপের দিকে যেতে গিয়ে ২৪ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন।

সমুদ্রের তলে পাঁচ কোটিপতির মৃত্যু হয়েছে। কোটিপতি শব্দটাও ফিকে। ধনকুবের বললেই বোধহয় যথার্থ বিচার হয়। সমুদ্রের গভীরে টাইটান সাবমার্সিবলের মধ্যে যারা ছিলেন কারও দেহাবশেষ মেলেনি। অথচ এদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন যাদের কাছে এমন রোমাঞ্চকর যাত্রা নেহাতই জলভাত! যাদের কাছে সমুদ্রের অতলকে ভয় করার কোনও কারণই নেই। স্টকটন রাশের কথাই ধরা যাক, OceanGate, Inc.-এর মিলিয়নেয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও। টাইটানের এক্সবক্স-কন্ট্রোলার-ওয়াইল্ডিং পাইলট। তাঁর বিশেষভাবে তৈরি করা সাবমার্সিবলটি লক্ষ লক্ষ টন জলের চাপে সম্ভবত ফেটে গিয়েছে। ওই অতলে বেঁচে থাকা অসম্ভব। মারা গিয়েছেন স্টকটন, মারা গিয়েছেন অন্য চার সহযাত্রী- হামিশ হার্ডিং, একজন ব্রিটিশ ধনকুবের; শাহজাদা দাউদ, একজন পাকিস্তানি কোটিপতি এবং তাঁর ছেলে সুলেমান এবং ফরাসি বিলিয়নেয়ার পল-হেনরি নাগেরোলেট, সমুদ্রতলদেশের গবেষণা সংস্থা আরএমএস টাইটানিক ইনকর্পোরেটেডের পরিচালক তিনি। এই সংস্থাটিই নিজেদের টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের মালিক বলে দাবি করে এবং আনসিঙ্কেবেলের ধ্বংসাবশেষ নিলাম করে নিজেদের ঋণ নিষ্পত্তি করতেও হয় তাদের।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং উপকূলরক্ষী বাহিনী যে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে তাতেও লক্ষাধিক অর্থ খরচ হবে। ওশানগেট গভীর সমুদ্রের বিপর্যয়ের জন্য কোনও ধরনের অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুতই ছিল না। জাহাজটিতে লোকেটার বীকন ছিল না এবং রংখানিও ছিল সাদা। মানে সমুদ্রের তলদেশে, ওই তরঙ্গের মাঝে এই ডুবোজাহাজের ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করাও প্রায় অসম্ভব। অথচ সমুদ্রের রহস্য আর টাইটানিকের অবশিষ্টাংশ খোঁজার ক্ষেত্রে ওশানগেটের তরফে স্টকটন রাশ বারবার বলেছিলেন, "আমি জানি, আমি নিয়ম ভঙ্গ করেও কাজটা নিরাপদেই করতে পারি।"

আরও পড়ুন-আশ্চর্য মিল! টাইটানিকে মৃত দম্পতির বংশধরই নিখোঁজ ডুবোজাহাজ টাইটানের চালকের স্ত্রী!

টাইটান সাবমার্সিবলের একজন ইঞ্জিনিয়ার ডেভিড লোচরিজ কিন্তু ২০১৮ সালে একটু ভিন্নভাবেই ভেবেছিলেন, ত্রুটিগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মূল্যও চোকাতে হয়েছিল তাঁকে। ডেভিড প্রথম বলেছিলেন, মূল যে বন্দর থেকে জাহাজ রওনা হবে সেখান থেকে মাত্র ১,৩০০ মিটার গভীরে ডাইভ দেওয়া সম্ভব! মানে, যেখানে টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপ আছে সেই সমুদ্রতলের গভীরতার এক তৃতীয়াংশেরও কম! বলার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি যায় ডেভিডের। এখন, এতকাল পর দীর্ঘকাল ধরে নিরাপত্তা সতর্কতা, খোলা চিঠি এবং আইনি প্রক্রিয়ার পরও, এমনকী মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ বিস্ফোরণের কথা শোনার পরেও, খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতোই নিরর্থক, দিনব্যাপী অনুসন্ধান কার্য চালানো হবে। আর এর জন্য টাকা দিয়ে যেতে হবে আমেরিকার জনসাধারণকে, নিজেদের কর হিসেবেই।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়ার এই রোমাঞ্চকর যাত্রা জনসাধারণের জন্য তো ছিল না! দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের অর্থ বাড়িয়ে বাড়িয়ে বিনোদনের উদ্দেশ্যে খরচের জন্য যারা অতিরিক্ত অর্থ খরচের যোগ্য উপায় খুঁজেছেন, তাঁরাই যোগ দিয়েছিলেন এই যাত্রায়। টাইটানিকের ধংসাবশেষের চারপাশে ১২ হাজার ফুট গভীরে গিয়ে রোমাঞ্চ করা বিশ্বের অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ব্যয়বহুল অ্যাডভেঞ্চারগুলির অন্যতম। ধনকুবের ছাড়া এই যাত্রা সম্ভবই না। এই যাত্রায় মাথাপিছু খরচই ছিল ২৫০,০০০ মার্কিন ডলার, ভারতের হিসেবে টাকাটা দু' কোটির খানিক বেশি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, টাইটানের যাত্রীদেরও গতি হলো টাইটানিকের নিম্নবিত্ত যাত্রীদের মতোই। ১৯১২ সালে ডুবে যাওয়ার সময়ও শ্রেণিগতভাবে বড়লোকরাই বেঁচে গিয়েছিলেন বেশি। টাইটানিকের প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মানুষ বেঁচে যান, যেখানে তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষই বেঁচেছিলেন।

নিম্নবিত্তকে ডুবিয়ে মারা সহজ, প্রায় ঐতিহ্যের কাছাকাছি গিয়েছে এই প্রবণতা। সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, গ্রিসের উপকূলে কমপক্ষে পাঁচশো উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়ে একটি জাহাজ ডুবে যায়, যাতে অন্তত ৭৮ জন নিহত হয়েছেন। টাইটানকে বাঁচাতে যেমন লাখো লাখো টাকা খরচা করে উদ্ধার অভিযান চলছে, গ্রিসের বেলা কিন্তু এসব হয়নি! গরিবগুর্বোদের বাঁচাতে এত টাকা কেই বা কবে খরচা করেছে! অথচ এটি প্রমাণিতও হয়ে গিয়েছে যে সেই জাহাজটিতে বিপজ্জনকভাবে অত্যধিক মানুষ তোলা হয়েছিল! ভূমধ্যসাগরে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জড়িত বিবিধ বিপর্যয়ের এটি অন্যতম। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইউরোপের দিকে যেতে গিয়ে ২৪ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। শুধুমাত্র এই বছরেই সংখ্যাটা ১,১০০ ছাড়িয়েছে। সংখ্যাটা প্রতি বছর একটি করে টাইটানিক ডোবার চেয়েও বেশি। তবে খবরে, সোশ্যাল মিডিয়াতে এইসব ঘটনার রেশও মিলবে না।

আরও পড়ুন- যাত্রীদের দেহের ছিটেফোঁটাও মেলেনি! অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজ হারিয়ে গেল কীভাবে?

যেখানে জাহাজের ধ্বংসাবশেষের অন্ত নেই, কেন আমরা সেখানে টাইটান এবং টাইটানিক নিয়ে এত মগ্ন? আসলে, টাইটানিক আর টাইটান দুই নিয়েই প্রচার হয়েছে সর্বোচ্চ স্তরে। টাইটানিক 'মিথ' হয়ে গেছে বহুকাল আগেই। টাইটানিকের ঐশ্বর্য, টাইটানিকের অন্দরের বিচিত্র কাহিনি এবং সর্বোপরি নানা তথ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্রে এই জাহাজটিকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা শতবর্ষ পরেও বাঁচিয়ে রেখেছে টাইটানিকের রহস্যকে। টাইটানিকের জন্মলগ্ন থেকেই 'আনসিঙ্কেবল' হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিলই। সমুদ্রকে সম্পূর্ণ জয় করার অহংকারের গন্ধ ছিল সেই 'আনসিঙ্কেবলে'র গায়ে।

আর পরিযায়ীদের, উদ্বাস্তুদের জাহাজ তো হামেশাই ডোবে, সমুদ্রে বা জীবনে। শরণার্থী হোক বা পরিযায়ী শ্রমিক, নিজেদের পথ নিজেদের লিখতে হয়, মাঝে মাঝে কেউ কেউ অসীম ক্ষমতাধর সেই পথে এসে স্যানিটাইজার ছড়িয়ে দেয় বা জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। পুঁজিপতিদের জীবনের দাঁড়িপাল্লায় হামেশাই নীচে পড়ে যান মরিয়া উদ্বাস্তুরা। সস্তার জীবন কোনও ঢেউ তোলে না। সমুদ্রেও না, জীবনেও না।

More Articles