'চড়াম চড়াম' বাণী এখন অতীত, জেলের ভিতর কেমন আছেন বীরভূমের 'কেষ্ট'
Anubrata Mondal in jail: একটা সময় তাঁর কথাতেই বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। এখন অবশ্য জেলের ওপারে অনুব্রত মণ্ডল।
''পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোড়া করে দেবো,
বলেছে পাড়ার দাদারা
অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই...!''
দাদা আপনি কই! ঠ্যাং খোড়া করে দেওয়ার আবহেই যে দাদার একাধিক শব্দবন্ধ একদিন ঝড় তুলত রাজ্যে, কাঁপিয়ে দিত বঙ্গের রাজনীতির মঞ্চ। যা রোজ বাড়াত বিতর্ক। সেই উপজীব্য, সেই রসদের আজকের হাল কেমন? 'ঠ্যাং ভেঙে দেব! চড়াম চড়াম ঢাক বাজাব! পাঁচন-বাড়ি। নকুলদানা খাওয়াবো। পুলিসের গাড়িতে বোমা মারব!' হাতকাটা দিলীপ অথবা চোখ কানা ওসমানদের অপরাধ-জগতের ভাষা কিনা সেসব ভেবে ওঠার আগেই এরকম নানা শব্দের ফুলঝুড়ি ঘটাতেন যিনি, আজ তিনি কোথায় রইলেন? কী অবস্থা তৃণমূলের 'কেষ্ট'র?
আরও পড়ুন : সততার প্রতীক প্রশ্নের মুখে, ঘুরে দাঁড়াতে কী করবেন মমতা?
অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal)। বীরভূমের 'কৃষ্ণ' তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) প্রিয় 'কেষ্ট'। যাঁর মাথায় অক্সিজেন ঠিক কতটা যাচ্ছে, সেই প্রশ্ন এখন অতীত। বরং অনুব্রতর মাথার চুলে ঠিক কতটা পাক ধরেছে, সেই প্রশ্নেই উত্তাল হচ্ছে আসানসোলের জেল-কুঠুরি। তিনি কি বৃদ্ধ হচ্ছেন? কয়েদি নম্বর ১০০ না ২০০, সেটা আমাদের জানা না থাকলেও কালীর গায়ে কয়েকশো ভরির গয়না পরানোর কারিগরের বর্তমান অবস্থা ঠিক কী, এ সম্পর্কে অনেকটাই অবগত এ রাজ্য! শান্তিনিকেতনের মাছ বিক্রেতা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা। সামান্য জেলা সভাপতি থেকে রাঢ়ভূমের শেষ কথা! অনুব্রত-জীবনীর ছত্রে ছত্রে যে দাপটের কথা লেখা রয়েছে, যে 'গাঁজা কেসে'র উপত্যকা রচিত হয় বারবার, সেই অনুব্রতর এমন অনাবৃত চেহারা দেখে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
কী যে হল সাধের কেষ্টর!
অনেকেই বলছেন, রূপ-রস আর যৌবনের বন্দরে যাতায়াত কমেছে তাঁর। লেনদেন বন্ধ হয়েছে ভালো থাকার। তাই, একাকী দাপুটে নিঃসঙ্গ-সম্রাট আজ যেন বিবাগী! দুঃখী! স্ত্রীর মৃত্যুর পর একমাত্র কন্যার 'বিপদে'র চিন্তাতেও মশগুল হয়তো তিনি! শুক্রবার সেই চিন্তা বেড়েছে আরও। আর চিন্তা বেড়েছে তাঁর দলের অন্দরেও। ফের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশে আটকে গিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। দিল্লির আদালত, ইডি-র মামলার বিড়ম্বনার মধ্যেই আসানসোলের বিশেষ আদালতের বিচারকের এই নির্দেশে অস্বস্তি আর শঙ্কা বেড়েছে ফের।
আরও পড়ুন : অনুব্রত মন্ডলের বেনামি সম্পত্তির আড়ালে আসলে তিনি, কে এই আবদুল লতিফ?
কী থেকে কী হয়ে গেল!
১১ আগস্ট, ২০২২। সকাল সকাল শান্তিনিকেতনে অশান্তির সূত্রপাত। বহু চেষ্টা, অণ্ডকোষ-পায়ুদ্বারের নানা সমস্যার দোহাইয়ের পরেও অনুব্রতর দুয়ারে হাজির হয় সিবিআই। জেরা-পর্ব কাটিয়ে ওজনদার কেষ্টকে আটক করে সিবিআই। সংবাদমাধ্যম তোলপাড় করে ওইদিন দুপুর নাগাদ আসানসোল পৌঁছে পাকাপাকিভাবে গ্রেফতার হন অনুব্রত। বহু চেষ্টা আর আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি।
'গরু-বিপদে কয়লা-কালো'
দেহরক্ষী সায়গল হোসেন-ফাঁদে জড়িয়ে যান সবুজ শিবিরের বীরভূমের বড়কর্তা। বগটুই গণহত্যার অভিযোগ-বিপদ যাঁকে টলাতে পারেনি, একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীর বাড়ি ধবংস থেকে শুরু করে রক্তের ইতিহাসের অভিযোগেও যিনি অবিচল, সেই অনুব্রত মণ্ডলকেই গ্রেফতার করেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্তারা। গরু পাচারের কালো টাকা-সহ বৃহত্তর দুর্নীতির জালে আবদ্ধ হন তিনি। এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ণ ওয়ার্ডের বিলাসী বাগিচা (হাসপাতালের বেড) ছেড়েই অনুব্রতর জায়গা জোটে জেলে। ১১ আগস্ট থেকে সিবিআই হেফাজত। তারপর থেকে প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে জেলবন্দী রয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন : সরষের মধ্যেই ভূত! কেন মানুষের আস্থা হারাচ্ছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা?
জেলযাপনে কেষ্ট-বিড়ম্বনা
অনুব্রত আসানসোলের জেল আর বিশেষ আদালতের মধ্যেই খুঁজে চলেছেন শান্তি! বিতর্ক তৈরি হয়েছে এখানেও। পুকুরের কাতলা থেকে পুজোর সময় বিশেষ মেনু। আবার কৌশিকী অমাবস্যায় তারার পুজোয় বিশেষ ব্যবস্থা। একাধিক ক্ষেত্রে কেষ্টর আবদার নিয়ে ছড়িয়েছে খবর। সত্যি-মিথ্যার দোলাচলে একাধিক বিতর্কও তৈরি হয়েছে বারবার। কিন্তু এখন!
২৪ অগাস্ট, ২০২২
১১ তারিখের গ্রেফতারি এবং আদালতে হাজির করানোর পরে ফের, আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে আসেন অনুব্রত। 'গরুচোর' স্লোগানে বিধ্বস্ত নেতাকে আদালতে পেশ করে সিবিআই (CBI) । তখনও সাংবাদিকদের সরিয়ে দেওয়া আবার প্রশ্নের উত্তরে, 'বলব না কিছু' থেকে শুরু করে 'ঠিক করেছেন দিদি'! অনুব্রত মণ্ডলের আলোচিত ব্যক্তিত্বের অবনমন ঘটেনি সে-দিনও। ক্রমেই ফিরহাদ হাকিম থেকে মমতা, অনুব্রত মণ্ডলের পাশে দাঁড়িয়েছেন সকলেই। 'বীরভূমের বাঘে'র ক্ষেত্রে পার্থ চট্টোপাধ্যায় সুলভ ব্যবহার করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। অনুব্রত থেকেছেন স্ব-মেজাজেই! দলীয় বৃত্তেও খামতি থাকেনি তাঁর।
১ সেপ্টেম্বর, ২০২২
এবার কেষ্ট কলকাতায়। পিজি হাসপাতাল নয়, গন্তব্য বিধাননগর আদালত। এলেন কিন্তু খানিকটা যেন বিধ্বস্ত তিনি! চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। ততদিনে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে তদন্ত। একের পর এক তথ্য আসছে সামনে। চলছে ম্যারাথন জেরা।
৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২
ভার্চুয়াল না স্বশরীরে উপস্থিতির জল্পনার মধ্যেই ফের আদালতে হাজির হলেন অনুব্রত। খানিকটা চুপচাপ। কিন্তু চোখেমুখে খুব একটা পরিবর্তন না এলেও বেশ পরিবর্তিত হয়েছেন কেষ্ট। গ্রেফতারিতে চুল কলপের সংস্থান না থাকলেও মাত্র এই এই কয়েক দিনেই উকি মেরেছে মাথার সাদা চুল!
আরও পড়ুন : দুঁদে গোয়েন্দা না বিচারপতি! অভিজিতের নতুন স্ট্র্যাটেজি হার মানাবে ফেলুদাকে
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২
ব্যর্থ অনুব্রত। সিবিআই জালে বন্দি নেতার ফের হেফাজতের নির্দেশ। আবারও জেলেই থাকতে হল তাঁকে। প্রথম পুজো কাটল জেলে। এদিকে কন্যা সুকন্যা মণ্ডল, স্কুলের চাকরি নিয়ে একাধিক বিতর্ক সামনে আসতে শুরু করেছে ফের। বাবার পরে মেয়ের বিপদ বেড়েছে ফের। আশঙ্কা বাড়ল অনুব্রতর। তারপর...
অক্টোবরের আদালত পর্ব কাটিয়ে ৫ নভেম্বর, ২০২২। ফের জামিনের আবেদন নাকচ। সুকন্যা বিপদের দোলাচলেই জেলেই রইলেন অনুব্রত মণ্ডল।
২৫ নভেম্বর, ২০২২
আবারও ফেল! এদিন আর তেমনভাবে জামিনের আবেদন করেননি অনুব্রত মণ্ডলের আইনজীবি। ফের জেল হেফাজতে যেতে হয়েছে তাঁকে। এদিকে বৃহস্পতিবারও জেলে বসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। এতদিনে জোরালো হয়েছে লটারি কাণ্ড।
কয়েকদিন আগে জেলেই খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নিয়ে যাওয়া হয় জেলেরই হাসপাতালে। ফের সুস্থ হয়ে ওঠেন অনুব্রত। এমনিতেই একাধিক শারীরিক সমস্যা রয়েছে তাঁর। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য?
অনেকেই বলছেন, নিজেকে নিয়ে ঠিক যতটা পরিমাণ চিন্তিত তিনি। তার সঙ্গেই চাপ বাড়িয়েছেন একমাত্র কন্যা-চিন্তা। যাঁকে নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে অনুব্রত মণ্ডলের! জেলে বসেই খবর নিচ্ছেন তিনি। যোগাযোগ রাখছেন মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু কী হবে! এই প্রশ্নে চাপ বেড়েছে বৃদ্ধ বাবা অনুব্রতর।
আরও পড়ুন : সাজতেন অনুব্রতর ৫৭০ ভরি সোনায়, কেষ্টর গরু পাচারের দুর্নাম ঘোচাবেন কালীই!
তৃণমূলে অনুব্রত-অশান্তি?
শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবেও ভালো নেই তিনি! কিন্তু তাঁর দল? শোনা যাচ্ছে, ইডি-র টানে আর আসানসোল নয়, এবার দিল্লি যেতে পারেন তিনি। যেখানে ইতিমধ্যেই তাঁর মেয়েকে জেরা করা হয়েছে। সেই দিল্লির অলিন্দেই কি এবার পা পড়বে অভিযুক্ত অনুব্রতর! তারপর? ঠিক এই অবস্থার মধ্যেই চিন্তা বেড়েছে তৃণমূলে। যদি জেলবন্দী অনুব্রত মণ্ডলকে আরও চাপে ফেলে একাধিক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেখানে দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই খানিকটা চাপে পড়বে তৃণমূল। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, বীরভূম শুধু নয়, জঙ্গলমহলের একাধিক জেলা যেখানে ইতিমধ্যেই খানিকটা শক্তি বাড়িয়ে বিজেপি। সেই জেলা তো বটেই বর্ধমানের একটা বিরাট অংশেও সংগঠনে প্রভাব রয়েছে অনুব্রত মণ্ডলের। ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচনে মমতাকে আসন পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা থাকে অনবরত। এই অবস্থায়, একদিকে খানিকটা বিপর্যস্ত অনুব্রত নিয়েই চাপ বেড়েছে। তার উপর তাঁর দিল্লি যাত্রা নিশ্চিত হলে সেই অনুব্রত আমেজে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, এদিনই আসানসোলের বিশেষ আদালতে দাঁড়িয়ে বীরভূমে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বিজেপি-র সভার পাল্টা সভা করতে কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন কেষ্ট। বুঝিয়ে দিয়েছেন আহত বাঘ আরও বেশি ভয়ঙ্কর! প্রকাশ্যে নিজের দাদাসুলভ মহিমা বজায় রেখেছেন প্রভাশালী অনুব্রত। তবে সত্যিই কি তাই?
চুল পেকেছে। আসলে কলপে সুসজ্জিত কেশের আসল চেহারা বেরিয়েছে এবার। চোখমুখে এসেছে বয়স বাড়ার ছাপ। অনেকেই বলছেন, ওজন খানিকটা কমেছে দাদার! স্থূলকায় কেষ্টর ওজন কমায় শারীরিক লাভ হলেও এই ঘটনা খুব একটা সুখকর নয় তৃণমূল নেতার কাছে। প্রত্যেক মুহূর্তে টানটান উত্তেজনা আর দুর্নীতির অভিযোগে বলির পাঁঠা হয়ে যাওয়া অনুব্রতকে দেখে যেন, 'খুব একটা ভালো নেই,' এ-জিনিস প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানের আদালত উপস্থিতিতে বারবার যেন সামনে এসেছে এমন হাবভাব।
আরও পড়ুন : প্রতিদিন একটু একটু করে অক্সিজেন, জেলে হেসেখেলেই সময় কাটছে কেষ্টর
কেন? মনোবিদরা বলছেন, "অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না, এই বিষয়ে আমরা জেলের ভিতরের খবর কেউ বলতে পারব না। কিন্তু একজন মানুষ, তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপনের মধ্যে হঠাৎ যদি একটা অন্য পরিবেশ, বদ্ধ জায়গায় অবতীর্ণ হন, তাহলে এই যে হঠাৎ ধাক্কা, সেটি অবশ্যই মারাত্মক। সেখানে অনুব্রত মণ্ডলের মতো ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রকাশ্য হাবভাবে খুব একটা সেটির প্রকাশ না করলেও আদতে যে তিনি কেন, কেউ-ই অভিযুক্ত হিসেবে ওই নতুন পরিবেশে ভালো থাকবেন না, থাকতে পারেন না, এটাই সত্যি।''
আর ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই সত্যিই কি ভালো নেই অনুব্রত। 'আজকে আমার মন ভালো নেই'- এ কথা প্রকাশ্যে বা তাঁর মুক্তির একমাত্র আমেজ আদালতে দাঁড়িয়ে বলছেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর মনের গহীনে কি জমছে এই ভালো না থাকার রসদ? দাপুটে নেতার শরীরী ভঙ্গি কি বারবার বলে দিচ্ছে এ কথাই। একাধিক প্রশ্ন আর উত্তর পাওয়ার তাগিদে শুরু হয়েছে জল্পনা। একদা শিরোনামে থাকা অনুব্রত-কাহিনির ক্লাইম্যাক্স আসার আগেই শুরুর চিত্রে ধরা দিচ্ছে কি অন্যকিছু! বিতর্কের আবহেই বিশ্লেষণ হচ্ছে ফের! কিন্তু জবাব কি দিয়েই রেখেছে তাঁর শরীর, তাঁর মুখচ্ছবির বর্তমান প্রকাশ! যা তাঁর দল তো বটেই সার্বিকভাবে অনুব্রত-কাহিনির প্রকাশে বিপদ যে আনবে না, এ কথাও বলছেন না অনেকেই।