হারলেও ত্রিপুরার ভোটের 'কিংমেকার' তারাই, বিজেপির কপালের ভাঁজ বাড়াল তিপ্রা মথা

Tripura Assembly Election 2023 : এই লাল-হলুদই গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের লাইমলাইটের নিচে। তিপ্রা মথা – এই নামটিই এখন রাজনীতির আলোচ্য বিষয়

এর আগে গোটা ভারত এই বিশেষ দলটির নাম শুনেছে কিনা, সত্যিই জানা নেই। লাল-হলুদ পতাকার মধ্যে একটা আনারসের ছবি। এক ঝলকে দেখে মনে হবে, ইস্টবেঙ্গলের কোনও ফ্যান ক্লাব। কিন্তু এই লাল-হলুদের সঙ্গে ময়দানের ফুটবল আর লড়াইয়ের কোনও যোগ নেই। এমনকী, এই বাংলারও কোনও যোগ নেই। আপাতত এই লাল-হলুদই গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের লাইমলাইটের নিচে। তিপ্রা মথা – এই নামটি রাতারাতি ভারতের রাজনীতির জগতে আলোচ্য বিষয় হয়ে গিয়েছে। আর এই নামটিই কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে বিজেপির।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি, সোমবার ত্রিপুরায় ছিল বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্ব। বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ ছিল ভোট গণনার দিন। সেখানেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের একবার মসনদ দখল করল বিজেপি। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা ডঃ মানিক সাহার মুখের চওড়া হাসিই সেই কথা বলে দিচ্ছে। দোলের আগেই ত্রিপুরার বিজেপি সমর্থক, নেতারা গেরুয়া আবির খেলায় মেতেছেন। আনন্দের মধ্যেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিজেপি শিবিরে।

কেন? গত নির্বাচনের থেকে ফল এবার বেশ খানিকটা খারাপ হয়েছে। গুজরাতের মতোই ত্রিপুরাতেও রেকর্ড গড়বে গেরুয়া শিবির, এমনই আশায় ছিলেন নেতারা। কিন্তু সেই কাজ হল না। অন্যদিকে, বাম-কংগ্রেস জোট আশা নিয়ে থাকলেও, দিনের শেষে সেভাবে কিছুই হল না। আর এই সমস্ত ছবিটার পেছনে রয়েছে তিপ্রা মথা পার্টি (Tipra Motha)। সঙ্গে রয়েছেন তাদের সুপ্রিমো প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য দেববর্মণ।

আরও পড়ুন : ‘নোটা’র কাছেও গো হারা হারল তৃণমূল! কেন ত্রিপুরায় এমন ভরাডুবি হল জোড়াফুলের?

এর আগে এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলটির নাম বিশেষ শোনা যায়নি। এর উত্থানও খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। তার আগে আসা যাক প্রদ্যোত মাণিক্য দেববর্মণের ব্যাপারে। যারা ইতিহাস চর্চা করেন, তাঁরা এই নামটি দেখেই কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছেন। হ্যাঁ, প্রদ্যোত ত্রিপুরার বিখ্যাত, ঐতিহাসিক রাজ পরিবারের সন্তান। ত্রিপুরার শেষ রাজার ছেলে তিনি। মাণিক্য দেববর্মণ বংশের রক্ত বইছে তাঁর শরীরে। কাজেই গোটা ত্রিপুরা জুড়ে তাঁর পরিচিতি, কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। অসংখ্য মানুষ তাঁকে চেনেন। তবে প্রথমদিকে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

২০১৯ সাল নাগাদ প্রদ্যোত মাণিক্য দেববর্মণ ত্রিপুরার কংগ্রেসের সভাপতি হন। কিন্তু খুব বেশিদিন সেই পদে থাকেননি তিনি। হাতে গোনা কয়েক মাস পরই কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন প্রদ্যোত। তারপর একটি সামাজিক সংগঠন তৈরি করেন। নাম ‘তিপ্রা ইন্ডিজেনাস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালাওয়েন্স’। সেখান থেকেই আজকের তিপ্রা মথা পার্টির উত্থান।

এই রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মূল কাজ আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা। এনিয়ে বিভিন্নভাবে প্রচারও করেন প্রদ্যোত মাণিক্য দেববর্মণ। তিপ্রা মথার মূল লক্ষ্য হল, ত্রিপুরা ও তার সংলগ্ন আদিবাসীদের জন্য আলাদা রাজ্য তৈরি করা। তার নাম ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’। সেখান থেকেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে মূল বিরোধিতা শুরু। এর আগে ২০২১ সালে ত্রিপুরার ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনমাস ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলের নির্বাচনে অংশ নেয় তিপ্রা মথা। সেখানে জয়ের মুখও দেখে এই দলটি। তখন থেকেই ত্রিপুরার আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে যায় প্রদ্যোত দেববর্মণ ও তাঁর তিপ্রা মথা দলটি।

আরও পড়ুন : নির্বাচনে ডাহা ফেল বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল, এই মাস্টারস্ট্রোকেই ত্রিপুরায় বাজিমাত বিজেপির

২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনেও এই দলটি যে ভোগাবে, তা বিলক্ষণ জানত বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস। তাই নির্বাচনের আগেই নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেছিল সব পক্ষই। কিন্তু তিপ্রা মথার মূল শর্ত ছিল একটাই, জিতলে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড ও আদিবাসীদের সংরক্ষণের দাবি মানতে হবে। সেই কথা লিখিত আকারে আগে দিতে হবে। তারপরই জোটের ভাবনা। এই শর্তে কেউই রাজি না হওয়ায় নির্বাচনে একাই লড়ার সিদ্ধান্ত নেয় তিপ্রা মথা।

আর ফলাফল? প্রথম নির্বাচনেই বাজিমাত প্রদ্যোত দেববর্মণের দলের। কেবল ১২টি আসন জেতাই নয়, নির্বাচনে বিজেপি আর অন্যান্য বিরোধীদের মাঝে দাঁড়িয়ে আসল কিংমেকারের ভূমিকাও পালন করেছে তিপ্রা মথা। বিজেপির আশানুরূপ ফল না হওয়ার পেছনেও এরাই দায়ী। তাই এখন থেকেই কপালে চিন্তার ভাঁজ বেড়েছে মানিক সাহাদের। কে জানে, আবার কোন ঝড় শুরু করে এই নতুন দলটি!

More Articles