তালিবান শাসনের দু'বছর পূর্তি! কেমন আছেন আফগানিস্তানের মেয়েরা?

2 years of Taliban takeover in Afghanistan: এরা গোড়াতেই শিকল পরায় নারীশিক্ষার পায়ে। কারণ শিক্ষার আলো থেকে দূরে রাখতে পারলেই বাকি সমস্ত কিছু জলের মতো সোজা। আর সেই সোজা পথেই মেয়েদের সমস্ত জোরকে ভেঙে ফেলা যাবে এক লহমায়।

দু'বছরের তালিবান শাসন। আর তা-ই যেন আফগানিস্তানকে ফের ঠেলে দিয়েছে একশো বছর পিছনে। এ যেন কেমন রঁদেভু। যতবার একটু এগোতে চায় আফগানিস্তান, ততবার আরও কিছুটা করে পিছিয়ে যায় দেশটা। মানবাধিকার শব্দের তেমন দাম বা মর্ম নেই তালিবানদের কাছে। মৌলবাদী শাসনের কাছে ছোট পড়ে যায় বাকি সমস্ত দেশ, মানুষ, অধিকার।

২০২১ সালের ১৫ অগস্ট হঠাৎ করেই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরাতে শুরু করে আমেরিকা ও ন্যাটো। প্রায় দু'দশক পরে। কী ঘটতে চলেছে, তখনও বোধহয় আঁচ করতে পারেননি আফগানিস্তানবাসী। অল্প দিনের মাথায় আফগানিস্তানের দখল নিল কঠোর মুসলিমপন্থী সংগঠন তালিবান। শুরু হল অত্যাচার, নিষেধাজ্ঞা। নতুন পর্বের তালিবান শাসনের দেখতে দেখতে দু'বছর পার করল। নব্বইয়ের দশকে যখন তালিবানের দখলে ছিল আফগানিস্তান, তখন অবস্থা ছিল ভয়ঙ্কর। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে অবশ্য তালিবান দাবি করেছিল, এবার অনেকটাই নরমসরম তাঁরা। তবে খুব বেশিদিন লাগেনি প্রমাণ হতে যে তালিবান আছে তালিবানেই।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা অলীক স্বপ্ন, তালিবানের অধীনে যেভাবে দিন কাটে আফগানিস্তানের মেয়েদের

দেশে সরকার গড়ে একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে তালিবানেরা। মেয়েদের উপর শুরু হয় অত্যাচার। কেড়ে নেওয়া হয়, শিক্ষা-চাকরিবাকরির মতো একাধিক অধিকার। না, এর বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জায়গা নেই আফগানিস্তানে। কারণ যে কোনও ধরনের প্রতিবাদের একটিই মাত্র উত্তর, মৃত্যু। উনিশ থেকে বিশ হলেই মাথার উপর নেমে আসে অত্যাচারের খাঁড়া। ঘাড়ের কাছে উঁচিয়ে থাকে মৌলবাদের ছুরি। আর সেই অভিশাপ মাথায় করেই আরও দু'টি বছর বেঁচে রইলেন বাসিন্দারা।

সময়ের ঘড়ি সেখানে যেন উল্টোদিকে ছোটে। গোটা পৃথিবী যা করে, যা দেখে, তার থেকে একশো বছর পুরনো ভাবনাচিন্তায় চলতে বাধ্য হচ্ছেন সেখানকার মানুষ। শিক্ষার সুযোগ নেই, শিল্পের সুযোগ নেই, চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে নানা বাধার পাহাড়। ষষ্ঠ শ্রেণির পর আরও কোনও মেয়ে স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে পারবে না, জানিয়ে দিয়েছিল তালিবান। সেই অবস্থান থেকে টলানো যায়নি তাদের। বরং ক্রমশ আরও এক পা, দু-পা করে মেয়েদের সমস্ত অধিকারের দিকে হাত বাড়িয়েছে তারা। শিক্ষার পর মেয়েদের পোশাক, চাকরিবাকরি, প্রসাধনী ব্যবহার, স্যালো বা পার্লার ব্যবহার এম হাজারটা জিনিস এখন তালিবানদের আতসকাচের তলায়।

'এরা যতবেশি পড়ে, যত বেশি জানে, তত কম মানে।'- এই আপ্তবাক্য যেন যে কোনও স্বায়ত্ত্বশাসনেরই। হীরক রাজার মুখের সেই কথা যেন অবিকল ধ্বনিত হয় তালিবানদের কাজকর্মে। তাই যেন এরা গোড়াতেই শিকল পরায় নারীশিক্ষার পায়ে। কারণ শিক্ষার আলো থেকে দূরে রাখতে পারলেই বাকি সমস্ত কিছু জলের মতো সোজা। আর সেই সোজা পথেই মেয়েদের সমস্ত জোরকে ভেঙে ফেলা যাবে এক লহমায়। সেখান থেকে ভাঙবে সমাজ, দেশ ক্রমশ। যৌনদাসী করে রাখা যাবে মেয়েদের ইচ্ছামতো। আর এমনই সব পরিকল্পনা নিয়ে কাবুল জয়ের দু'বছর পালন করে ফেলল আফগানিস্তানের তালিবান সরকার।

সেই জয়ের উদযাপন উপলক্ষে বিবৃতি জারি করেছেন তালিবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ। সেখানে তিনি জয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তালিবানের পবিত্র সংগ্রামীদের। তাঁদের এই জয়ের জন্য ধন্যবাদ জানাতে বলেছেন সর্বশক্তিমান আল্লাহকে। বিজয়দিবস উপলক্ষে নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে দেশ। ঘোষণা করা হয়েছে জাতীয় ছুটি। আত্মবিশ্বাসের কমতি নেই কোনও অংশে। তালিবানের মতে, আফগানিস্তানে তালিবান সাম্রাজ্য 'ওপেন এন্ডেড'। এককথায় তারা অপ্রতিরোধ্য। তাদের শাসনব্যবস্থা টলাতে পারে এমন শক্তি তাদের আশপাশে নেই। অতএব নিশ্চিন্তে দেশে চলবে তালিবান শাসন। নারীশিক্ষার ব্যাপারেও অবস্থান পরিবর্তনের প্রশ্নে নেই তারা। সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের তরফে।

দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহার, যাকে তালিবানদের আতুড়ঘর বললে খুব একটা ভুল বলা হয়না, সেখানে দেখা গেল অদ্ভুত ছবি। তালিবানি পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ছেলেপুলেরা। রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি। তরুণ তুর্কিরা সব সাইকেল, বাইকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে সত্যিই কি মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মৌলবাদী প্রশ্নে! এদিকে ক্রমশ নিম্নমুখী আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা। বছর দুয়েক আগেও অন্যান্য দেশগুলি থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থসাহায্য পেত। আফগানিস্তানের বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশই আসত সেখান থেকে। তবে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে তা প্রায় বন্ধ। কোভিডকালীন পরিস্থিতি আরও কিনারায় ঠেলে দিয়েছিল আফগানিস্তানের মানুষদের। চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব, অপুষ্টির মতো সমস্যা ছেঁকে ধরেছে তাঁদের। তার উপরে তিন বছর ধরে লাগাতার খরার জেরে বিপাকে পড়েছে দেশ। কমছে পারিবারিক আয়। তার উপর আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কগুলি আফগানিস্তানের সঙ্গে কোনওরকম অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো লেগেই আছে।

আরও পড়ুন: তালিবানের বন্দুক, প্রকৃতির রক্তচক্ষু…, আর কত দুঃখ সইবে আফগানরা

সব মিলিয়ে ভালো নেই আফগানিস্তান। ভালো নেই বাসিন্দারা। অবশ্য প্রজাকল্যাণ নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা তালিবানের নেই। আর তা থাকার কথাও না। বরং মৌলবাদের মতো সংক্রমণকে দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই বেশি মজে তারা। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ভয়াবহ শাসনকাল চালিয়েছিল তালিবানেরা। সেই প্রথম পর্যায়ের ভয়বহতাকেও কি মাত দিতে চলেছে তালিবান 2.O? আর কতদিন এমন দগ্ধে দগ্ধে বেঁচে থাকবেন আফগানিস্তানের মানুষ। কতদিন অন্ধকার বোরখার নিচে চাপা পড়ে থাকবে মেয়েদের মৌলিক অধিকারটুকু। সেই প্রশ্নটাই শুধু এখন ঘুরপাক খায় বাতাসে। কিন্তু সদুত্তর মেলে না।

More Articles