অস্ত্রেও রাশিয়াকে টেক্কা, ‘চাণক্য’ জেলেনস্কির কূটবুদ্ধির জোরে এগিয়ে ইউক্রেন

সংস্কৃতে একটি প্রবাদ আছে, ‘বলং বলং বাহু বলং।’ এই প্রবাদবাক্য যেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেন্সকির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। দিনকয়েক আগেই নিরাপত্তা পরিষদে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধবাজ রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না, এমনটাই ছিল তাঁর অভিযোগ। ইতিপূর্বে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না করায় ন্যাটোর বিরুদ্ধেও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন জেলেন্সকি। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে রোজ। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্তর্গত অধিকাংশ দেশই জেলেন্সকিকে নৈতিক সমর্থন জানিয়ে দায় সেরেছে, কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি প্রায় কেউই। এই অবস্থায় কূটবুদ্ধির জোরে সামরিকভাবেও রাশিয়াকে টেক্কা দেওয়ার অবস্থানে পৌঁছল ইউক্রেন।

ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা ৭ এপ্রিল ন্যাটোর সদর দপ্তরে ন্যাটোর মুখ্যসচিব জেন্স স্টেলানবার্গের সঙ্গে বৈঠকে জানান, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের এখন মূলত অস্ত্রের প্রয়োজন, টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘ওয়েপনস, ওয়েপনস অ্যান্ড ওয়েপনস।’ তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রসঙ্গত, ইতিপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে প্রায় ২ কোটি ডলার দিয়ে সাহায্য করেছে তারা। এবার ইউক্রেনকে ৩০ কোটি ডলার দিল জো বাইডেনের দেশ। এছাড়াও তাদের সাহায্যের তালিকায় রয়েছে বেশ কিছু উন্নতমানের অস্ত্র।

গত কয়েকদিনে হাইপারসনিক অস্ত্রের সাহায্যে ইউক্রেনে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে রাশিয়া। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশের বেশ কিছু অংশে নিয়মিত মিসাইল আক্রমণ চালিয়েছে পুতিনের সেনাবাহিনী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ফলে রুশ হানাদার বাহিনীর আক্রমণের জবাব দেওয়ার মতো অস্ত্র এসে পৌঁছল ইউক্রেনের হাতে। বাইডেন সরকারের কাছ থেকে তারা পেল ৫০০০ এফজিএম-১৪৮ জ্যাভলিন। গত কয়েকদিন ধরে আমেরিকার তৈরি এই ট্যাঙ্কের ধাক্কা সামলাতে প্রায় হিমশিম খেয়েছে রুশ সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও জেলেন্সকির সেনাদের হাতে এসেছে ১,৪০০ স্ট্রিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র। রুশ যুদ্ধবিমানকে টক্কর দিতে এই ক্ষেপণাস্ত্রই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।

আরও পড়ুন: রুশ–ইউক্রেন যুদ্ধে নির্ণায়ক শক্তি, কী ভবিষ্যৎ বিটকয়েনের?

ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শত্রুপক্ষের একের পর এক সাঁজোয়া গাড়ি ধ্বংস হচ্ছে। ইতিপূর্বে ইউক্রেনের শহরাঞ্চলের সিংহভাগকে টি-৯০ এবং টি-৭২ ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল রাশিয়া । এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এটিজিএম জ্যাভলিনের দৌলতে সেই ট্যাঙ্কগুলোই গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হল জেলেন্সকির সেনাদল। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া কিছু ভিডিও ফুটেজে এমন চিত্রই ধরা পড়েছে।  তবে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শরিক বোধহয় শুধুমাত্র ইউক্রেনের সেনারা নয়।  রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়ায় জেলেন্সকি নিজে রণসাজে সুসজ্জিত হয়ে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জানিয়েছিলেন, দেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যাচ্ছেন না, এই যুদ্ধের শেষ দেখেই তিনি ছাড়বেন। কঠিন পরিস্থিতিতেও ইউক্রেনবাসীকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন জেলেন্সকি। ফলত, উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউক্রেনের আমজনতাও সেনাদের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। যদিও, অস্ত্র সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনে অপরাধের মাত্রা বাড়ছে বলে জানা যাচ্ছিল, কিন্তু যুদ্ধের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ইউক্রেনের পক্ষে সদর্থক বলেই মনে করা হচ্ছে।

ইউক্রেনকে পর্যুদস্ত করতে বেশ কিছু প্রাণঘাতী অস্ত্রের সাহায্য নিয়েছিল পুতিনের সৈন্যরা। সেই তালিকায় আছে ভ্যাকুয়াম বোমা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর চেয়ে নৃশংস অস্ত্র বড় বেশি নেই। আশেপাশের পরিবেশ থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এই বোমা। এছাড়াও রয়েছে 'নেক্সট জেনারেশন লাইট অ্যান্টি ট্যাংক ওয়েপন'। প্রায় ৮০০ মিটার দূর থেকে শত্রুপক্ষের ট্যাংককে নিমেষে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই অস্ত্র। 

এতকিছুর পরেও জেলেন্সকি 'বিনা‌ যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী'‌ নীতিতেই হাঁটছেন। শুধু সাহস নয়, তার পাশাপাশি তুখড় বুদ্ধিবলেও রাশিয়াকে এক কদম এগোনোর বিনিময়ে দু’কদম পিছোতে বাধ্য করেছেন জেলেন্সকি। 

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে– তা নিয়ে কোনওরকম ভবিষ্যৎবাণী এখনও করা সম্ভব নয়। দুই দেশের আলোচনার মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসতেও পারে। বস্তুত, বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, এমনটা হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তবে, যুদ্ধের পরিণতি যাই হোক না কেন, রাশিয়ার মতো একটা শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে লড়ছে ইউক্রেন। 

 

More Articles