যোগীর শাসন কি তালিবানি শাসনের চেয়ে ভালো? উত্তরপ্রদেশে বেঁচে থাকার শর্ত কী কী?
Yogi Adityanath and Taliban Rule: যোগী এর আগেও "ওরা ২০ আমরা ৮০" বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে ভয়ে নতজানু হয়ে থাকা উচিত সংখ্যালঘুদের, মুসলিমদের।
এইবারের লোকসভা নির্বাচনে যে পরিমাণ বিদ্বেষবাণী শোনা গিয়েছে শাসক বিজেপির তরফে, তা যে কোনও বিগত নির্বাচনী প্রচারকে যে হার মানাবে তা হলপ করে বলা যায়। সংখ্যালঘুদের নিয়ে ক্রমাগত বিষোদ্গার করেছে বিজেপি। চলেছে একজনের বিরুদ্ধে অন্যজনকে ক্রমাগত উস্কে দেওয়ার কৌশল। এবারের প্রচারে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের মুখে সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে 'তালিবান' শব্দটি। গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী প্রচারে গিয়ে বলেছেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা ক্ষমতায় এলেই ইসলামি শরিয়া আইন জারি করবে। যোগী একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নাগরিকদের প্রশ্ন করছেন, "আপনারা কি ভারতে তালিবানি শাসন মেনে নেবেন?”
কংগ্রেস এলেই দেশে মুসলিমরা সব পেয়ে যাবে এই কথা খোদ মোদিও বলেছিলেন রাজস্থানের এক নির্বাচনী সভা থেকে। বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে বিলিয়ে দেবে সংখ্যালঘুদের মধ্যে। সারবত্তাহীন এসব উস্কানির অর্থ কী? বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ নেতারা ভয় দেখানোকেই ভোট টানার পদ্ধতি সিসেবে ব্যাপক হারে ব্যবহার করছে। এই ধরনের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বার্তাটি হলো, কোনও অ-বিজেপি দল ক্ষমতায় এলেই মুসলিম মৌলবাদীদের আধিপত্য অনিবার্য। তাই মোদি, যোগী সকলেই বলেছেন, কংগ্রেসের ইস্তেহারে হিন্দু মহিলাদের গয়না এবং অন্যান্য সম্পদ ছিনিয়ে মুসলিমদের বিলিয়ে দেওয়া হবে। যে মানুষের কাছে শিক্ষা নেই, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের ক্ষমতা নেই, যে মানুষ ভীত ও রক্ষণশীল সেই দুর্বল জনসাধারণের মধ্যে অযৌক্তিক ভয় তৈরি করার এর চেয়ে ভালো পন্থা আর নেই। তাই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে হামেশাই এই ধরনের অসুস্থ প্রচার চলেছে। বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান এখানে নেই।
আরও পড়ুন- অযোধ্যায় দীপাবলি উৎসবে প্রদীপের অবশিষ্ট তেল নিতে কাড়াকাড়ি, যোগীরাজ্যের ‘অচ্ছে দিন’ আসলে এই?
তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে সতর্ক করতে গিয়ে যোগী কিন্তু জনগণকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে বলছেন না একেবারেই বরং তিনি হিন্দুত্বের রূপক ব্যবহার করছেন। সংবিধান নয় তিনি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে ত্রাতা হিসেবে, বিকল্প দল হিসেবে বিজেপিকেই বেছে নিতে বলছেন। মুঘলসরাইতে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে যোগী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন প্রবল রামভক্ত, তিনি ৫০০ বছরের সংগ্রামের পর অযোধ্যায় ঐশ্বরিক ও মহান মন্দিরে রামলালাকে স্থাপন করেছেন। ‘রাম-বিরোধী’ সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস বলছে, তারা ক্ষমতায় এলে ব্যক্তিগত আইন প্রয়োগ করবে। এর মানে তারা তালিবানদের মতো শাসন জারি করতে চায়।" যোগী এই প্রথম এমন বলছেন তা নয়। এর আগেও "ওরা ২০ আমরা ৮০" বলে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে ভয়ে নতজানু হয়ে থাকা উচিত সংখ্যালঘুদের, মুসলিমদের। সংসদীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তিনি 'আলি বনাম বজরংবলী'-তে নামিয়ে এনেছেন। বারেবারে পাকিস্তান এবং মুসলিমদের অপরাধী বলে উল্লেখ করেছেন। তালিবানি শাসনের সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগই নেই। ধর্মীয় গোঁড়ামি তিনি চান না এমন নয়, তিনি চান ইসলামিক মৌলবাদ নয়, ভারতে কায়েম হোক হিন্দু আধিপত্য।
তালিবানি শাসন বৃহত্তর ইসলামিক আধিপত্যের কথা বলে, বিরোধীদের নৃশংস দমনের কথা বলে। তালিবানি শাসন মানেই সেখানে বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কোনও জায়গা নেই। ধর্মীয় মৌলবাদী শাসক নিয়ন্ত্রিত সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেওয়া হয় যেখানে মহিলাদের কী অমানবিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় কিছুকাল আগে তার নিদর্শন দেখেছে বিশ্ব। সমালোচকদের নিপীড়ন এবং শিল্প, খাদ্যাভ্যাস, প্রেম, বিয়ের মতো সমস্ত ব্যক্তিগত পছন্দের জন্য এখানে কোনও মুক্ত আকাশ নেই। জনগণের অধিকার নয়, সরকারের ক্ষমতার ওপরই জোর দেওয়া হয় তালিবানি শাসনে।
এর বদলে যোগী যে হিন্দু আধিপত্যের কথা বলছেন, সেই ‘যোগী মডেল’ ঠিক কী? যোগী শাসনে ভিন্নমত, প্রতিবাদ, সমালোচনা, রাজনৈতিক প্রতিরোধ সংগঠিত করার জায়গা বেড়েছে নাকি কমেছে?
দ্য ওয়্যারের একটি প্রতিবেদন বলছে, বিতর্কিত যে কোনও আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় প্রতিবাদীদের অকথ্য মারধর করা হয়েছে, জেলে ঢোকানো হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অর্থাৎ সিএএ-র বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন সরকার তাদের ছবি সম্বলিত হোর্ডিং বসিয়েছিল রাস্তার মোড়ে মোড়ে যেন 'মোস্ট ওয়ান্টেড' অপরাধীদের তালিকা ঝোলানো হয়েছে! লাভ জিহাদের নামে উত্তরপ্রদেশে ঠিক কী কী ঘটে? ভিন্ন ধর্মে প্রেম তো দূর অস্ত, সামান্য পার্কে পাশাপাশি হাঁটাও ভিনধর্মী প্রেমিক-প্রেমিকাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে। একজন মুসলিম ছেলে কোনও হিন্দু মেয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে পারে না, রেস্তোরাঁয় খেতে যেতে পারে না, আড্ডা মারতে পারে না। দেশের সংবিধানে তো কোথাও এমন উল্লিখিত নেই। যোগীর সংবিধানে তাহলে এত বৈরিতা ঠাঁই পেল কীভাবে? এটা কি তালিবানি শাসন নয়? উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস বা সমাজবাদী সরকারের আমলে এমন ভয়ের পরিবেশ কি স্বাভাবিক ছিল? গরুর মাংস রাখার সন্দেহে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল কি? যদি এসব তালিবানি সংস্কৃতি না হয়, যদি এই নীতি পুলিশি তালিবানি না হয় তাহলে তালিবানি শাসন বলতে যোগী কী বোঝাতে চাইছেন? বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিতে কি এমন হয়?
কংগ্রেস এলেই তালিবানি শাসন জারি হবে এই মিথ্যার নেপথ্যে যোগী হাতিয়ার করেছেন কংগ্রেসের ইস্তেহারকে। কংগ্রেসের ইস্তেহারের ন্যায়বিচার নিয়েই কথা বলা হয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে তাতে। সম্পদ বা উত্তরাধিকার করের পুনর্বণ্টনের কোনও উল্লেখই সেখানে নেই। কোথাও বলা নেই হিন্দুর গয়না কেড়ে মুসলিমদের দেওয়া হবে। জনগণের অধিকার এবং সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে কথা বলেছে কংগ্রেসের ইস্তেহার। বামপন্থীরাও স্বাভাবিকভাবেই জনগণের রুজি-রুটির নামেই ভোট চেয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন, কেন্দ্রীয় সংস্থার অপব্যবহার, বিরোধীদের নির্বাচনী লক্ষ্যবস্তু করা এবং সামাজিক সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
বিজেপির শীর্ষ নেতারা বৈচিত্র্যবিরোধী। বৈচিত্র্য হলেই শাসনের অসুবিধে। ঠিক একই কথা বিশ্বাস করে তালিবানরাও। বিজেপি সংখ্যালঘুদের জন্য সামান্য স্থান ছাড়াকেও বিপদ মনে করে। মোদি, যোগী, শাহ জনসাধারণের সাম্য, সংহতি এবং সম্প্রীতি নিয়ে কখনও কথা বলছেন, শোনা যায়নি। সংখ্যালঘুরা পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর তা নিয়ে উদ্বেগ দেখাননি। সমস্যা নিরসনে নয়, 'সমস্যা' বলে মনে করা গোষ্ঠীকে সমূলে তুলে ফেলতে আগ্রহী শাসক বিজেপি। সমাজের আরেক দুর্বল অংশ দলিত বা আদিবাসীদের নিয়ে ইদানীং বড়-বড় কথা বলছেন মোদি। কীভাবে বলছেন? বলছেন মুসলিমদের সব সুবিধা দিতে তাঁদের ওবিসি শংসাপত্র পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে আর আসল ওবিসি যারা তাঁদের ভাঁড়ে মা ভবানী। অর্থাৎ আবারও বিভেদ। 'ও সব পেয়ে যাচ্ছে' এই মর্মে ভোট হচ্ছে দেশে। আমাদের কী পাওয়া উচিত তা নিয়ে সওয়াল কই?
আরও পড়ুন- যোগী বলছেন রাষ্ট্রীয় ধর্ম সনাতন, আদৌ কোনো রাষ্ট্রধর্ম আছে? কী বলছে সংবিধান?
রাম মন্দির নির্মাণ ও উদ্বোধন তো সরকারের প্রকল্প হয়ে উঠল। দেশের প্রধানমন্ত্রী বা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একই আগ্রহ দেখান? এ যদি প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব না হয় তবে কোনটা? যোগী সরকার প্রতি বছর হরিদ্বারে যাওয়া ভক্তদের উপর ফুল বর্ষণ করে, দীপাবলিতে অযোধ্যায় লক্ষ লক্ষ মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রেকর্ড গড়ে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকেই কি ঝুঁকে নেই তারা? তালিবানরা তো এই গরিষ্ঠাতাপন্থীই। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান মেনে চলত। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখরা, খুন হয়ে যাওয়া, ফাঁসি হয়ে যাওয়া সূর্য সেন, প্রীতিলতারা এই ধর্মের ভেদ তো চাননি। ভারত রাষ্ট্র সংবিধান ও আইন মেনে কাজ করবে যেখানে ঐক্য থাকবে, সমঝোতা থাকবে, ‘বুলডোজার' থাকার তো কথা ছিল না।
লিভ-ইন করলে এখন বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে পুলিশের কাছে গিয়ে নিজেদের নাম, ধাম, পরিচয় জানাতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনের উপর এই সরকারি নিয়ন্ত্রণ তো তালিবান শাসনে হয়। উত্তরপ্রদেশে হিন্দুদের উৎসবের সময় আমিষ খাবারের দোকান বন্ধ থাকে। এদিকে বহু হিন্দুই সারা বছর তেড়েফুঁড়ে আমিষ খাবারই খেতে চায়। তাহলে কোন হিন্দুদের জন্য এই নিয়ম? মুসলিম বিক্রেতাদের জীবিকাতে হাত দেওয়ার অধিকার কি সরকারের আছে?
মোদি এবং যোগীর এই তালিবানি শাসনের মডেল আসলে কী? তালিবানরা মদ ও শুয়োরের মাংস নিষিদ্ধ করেছে। সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করেছে। মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ। আর এই দেশে প্রেমে পড়তে গেলে কেন সরকারকে ভয় পেতে হবে? কেন একজন মানুষ তার পছন্দের খাবার খেতে ভয় পাবে? কেন নাগরিকদের পছন্দসই পোশাক নিয়ে সরকার প্রশ্ন তুলবে? কেন মুসলমানদের এমন জায়গায় নামাজ পড়তে দেওয়া হবে না যেখানে হিন্দুদেরও আনন্দের স্থান রয়েছে? একজন লেখক কেন তাঁর মতামত প্রকাশ করতে ভয় পাবেন? প্রতিবাদ করলে একজন নাগরিককে কেন জেলে ঢোকানো হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই লুকিয়ে আছে তালিবানি শাসন বনাম যোগী শাসনের আসল চিত্র।