অযোধ্যায় দীপাবলি উৎসবে প্রদীপের অবশিষ্ট তেল নিতে কাড়াকাড়ি, যোগীরাজ্যের 'অচ্ছে দিন' আসলে এই?

Ayodhya Deepotsav 22 lakh Diyas : "এরা বরং অবশিষ্ট তেল নদীতে ফেলে দেবে কিন্তু গরিবদের নিতে দেবে না," বলছেন তেল নিতে আসা শোভা।

২২ লাখ! ২২ লক্ষ প্রদীপে দীপাবলি উৎসবে সেজে উঠেছিল অযোধ্যা। রামমন্দিরের শহর অযোধ্যা এই ২২ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নাম তুলেছে। আলোর ঠিক নীচেই যে অন্ধকার, তাও সাপের মতো বেরিয়ে এসেছে যোগী রাজ্যের স্যাঁতসেঁতে গর্ত থেকে। এই ২২ লক্ষ প্রদীপ জ্বলেছে তেল দিয়ে, কত লিটার তেল লেগেছে? ভারতে সরষের তেলের দাম এখন কত? সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যের খেটে খাওয়া গরিবরা। ওই ২২ লক্ষ প্রদীপ থেকে বেঁচে যাওয়া তেল রান্না করার জন্য সংগ্রহ করতে দেখা গিয়েছে মানুষকে। নির্দ্বিধায়, এই তো আচ্ছে দিন, এই তো প্রকৃত 'শুভ' দীপাবলি!

২০১৭ সালে যোগী আদিত্যনাথের সরকার গঠনের পরেই অযোধ্যায় দীপোৎসব শুরু হয়। সরকার ২০১৭ সালে প্রায় ৫১,০০০ প্রদীপ জ্বালায়। ২০১৯ সালে ৪.১০ লক্ষ প্রদীপ জ্বালায়। প্রতিবছর নিজের রেকর্ড নিজে ভাঙার দৌড়ে নেমে পড়ে প্রশাসন। ২০২০ সালে ৬ লক্ষেরও বেশি প্রদীপ জ্বালানো হয়। ২০২১ সালে ৯ লক্ষ প্রদীপ জ্বালানো হয়। ২০২২ সালে, রাম কি পৌরী ঘাটে ১৭ লাখেরও বেশি প্রদীপ জ্বালানো হয়েছিল। তবে, সেই বছর গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কেবলমাত্র সেই প্রদীপগুলিকেই গোনে যেগুলি কমপক্ষে পাঁচ মিনিট জ্বলেছিল, তাই রেকর্ড গড়া হয় ১৫,৭৬,৯৫৫টি প্রদীপের।

এবছর ২২ লক্ষ। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ পুরোদমে চলছে। সব ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি রাম মন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার কথা। ফলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন আর রামমন্দির উন্মোচনের আগে ২০২৩ সালটি আদিত্যনাথ ও বিজেপি সরকার দুইয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ বছরে ২২ লক্ষ প্রদীপের আলোয় রাজ্যের গরিবদের প্রকৃত অন্ধকার প্রকাশ্যে এসেছে।

রান্নার জন্য সরষের তেল সংগ্রহ করছেন মানুষ প্রদীপ থেকে! দেবতাদের উদ্দেশ্যে জ্বালানো প্রদীপ থেকে মানুষ পরিবারের রান্নার তেল নিতে বাধ্য হচ্ছেন, এমন উত্সবের আলো কি দেশকে ম্লান করে না? এবছরই প্রথম না, এই বিপুল প্রদীপ জ্বালানোর উৎসবের শুরু থেকেই এই ঘটনা চলে আসছে। যে উৎসবে দেবতার ঘরে আলো জ্বলে আর অন্ধকারের প্রাণীদের প্রদীপ থেকে বেঁচে যাওয়া তেল দিয়ে সংসারের খাবার রাঁধতে হয় সেই উৎসবে প্রাণ আছে না স্রেফ ক্ষমতা?

অযোধ্যায় এই ২২ লাখ প্রদীপের দীপাবলির কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে দরিদ্র মহিলা এবং শিশুরা জ্বলন্ত প্রদীপ থেকে অবশিষ্ট তেল সংগ্রহ করছে। এই শিশু, মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ ১১৬ কিলোমিটার দূরে বাহরাইচ অঞ্চল থেকে এসেছেন বলেও দাবি। ২২ লক্ষ প্রদীপের নষ্ট হওয়া তেল নিতে ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যে মানুষ আসে, এই উৎসব তাঁকে ছোঁয় কতখানি?

 

এই শিশু ও মহিলাদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে অযোধ্যার পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে। এক ঘাট থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মহিলারা ফের সেই একই বা অন্য ঘাটে ফিরে গেছেন তেল নিতে। তেল নিতে আসা এক মহিলা জানাচ্ছেন, “আমরা গরিব, তেল কেনার সামর্থ্য নেই। আমরা প্রতি বছর এখানে যে তেল নিয়ে যাই, তা দিয়ে আমাদের কয়েক মাস, কখনও কখনও ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত রান্না হয়ে যায়।” অযোধ্যারই বাসিন্দা অন্য এক মহিলা জানাচ্ছেন, পুলিশদের মহিলাদের মারার কোনও অধিকার নেই। "এরা বরং অবশিষ্ট তেল নদীতে ফেলে দেবে কিন্তু গরিবদের নিতে দেবে না," বলছেন তেল নিতে আসা শোভা। বাহরাইচের এক মহিলা একটি অনলাইন পোর্টালকে জানান, তিনি এবং আরও কয়েকজন অবশিষ্ট তেল সংগ্রহের আশায় গত তিন বছর ধরেই দীপোৎসবে আসেন। রেশন কার্ড আছে তাঁর। বিনামূল্যের রেশন পান। কিন্তু সব সময় তেল কেনার সামর্থ্য থাকে না। প্রদীপ থেকে সংগৃহীত তেল দিয়ে ছ’ মাসের মতো চলে যায়।

বিজেপির সমর্থকদের একটি অংশ পাল্টা প্রচার করছে যে, এই মহিলারা 'তেল চুরি' করছেন আসলে। এই মহিলারা ফুটপাতে খাবারের দোকানে এই তেল বিক্রি করবে। অনেকে বলছেন, এটি সরষের তেল না তিলের তেল এবং কর্পূরে প্রদীপগুলি ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই প্রদীপের পোড়া তেল রান্নার জন্য ব্যবহার করা যাবেও না। উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং হিন্দু ধর্মকে হেয় করার জন্যই নাকি এই মহিলাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজ্য সরকার মাটির প্রদীপের জন্য টাকা দেয়। প্রতিটি প্রদীপের দাম ১ টাকা থেকে ১.৫০ টাকার মধ্যে। প্রদীপ এবং সরষের তেল ছাড়াও তিলের তেল এবং কর্পূরে প্রদীপ জ্বালানোর হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে রাম মন্দির উদ্বোধনের সময় কতগুলি প্রদীপ জ্বালানো হবে তা অনুমান করাই যায়। তবে তা যে ২২ লক্ষের রেকর্ডকেও ভেঙে দেবে তেমন সম্ভাবনা রয়েছে। এই এত প্রদীপ, প্রদীপের তেল ও আয়োজনে যে টাকা খরচ হয়েছে, তার হিসেব উত্তরপ্রদেশের মানুষ চাইবে না। মানুষ চাইবে খাদ্যের নিরাপত্তা, ন্যূনতম খাবার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিষেবা। ২২ লক্ষ প্রদীপের আলোয় সেই অধিকার রক্ষিত হবে কি?

More Articles