নিজেকে নস্যাৎ করতে শেখান গায়ত্রী

গায়ত্রীর এক বৃহত্তর দুনিয়ার নারীবাদ নিজেকেও বাদ রাখে না সমালোচনার পরিসর থেকে। লিঙ্গ বৈষম্যের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনকে জুড়ে দেখার কথা বারবার বলেছেন গায়ত্রী।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক শেষ এক দেড় দশক ধরে ভারতীয় অ্যাকাডেমিয়ায় বিবিধ কারণে কুখ্যাত হয়েছেন। ভারতীয় দলিত বিদ্যা দিন দিন যত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, গায়ত্রী তো বটেই, রণজিৎ গুহদের পুরো সাবঅল্টার্ন চর্চাটিকেই বিবিধ সমালোচনায় বিদ্ধ করা হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদের যে ধারাটি গায়ত্রী, চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তি, রাজেশ্বরী সুন্দর রাজন, কুমারী জয়বর্ধনেরা তাঁদের মেধা দিয়ে পুষ্ট করতেন, সেই ধারাটিই বন্দনা শিবা, শর্মিলা রেগেদের তোলা বিবিধ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ফলে আজকের দিনে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের গুরুত্ব নিম্নবর্গ চর্চার ক্ষেত্রেই হোক , কিংবা, নারীবাদের ক্ষেত্রেই হোক অনেকটাই কমেছে। তাহলে গায়ত্রী চর্চাকে আমি একজন দলিত নারীর প্রেক্ষিত থেকে কি বাতিল সংস্কৃতি হিসেবে ধরব? গায়ত্রীর ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রবণতার হেতু কি একজন দলিত নারী হিসেবে আমি গায়ত্রীকে পড়ব না? আমি গায়ত্রীর নারীবাদ নিয়ে ভাবতে বসি। ভাবতে বসেই মহাশ্বেতা দেবীর মুখ ভেসে আসে আমার সামনে। মহাশ্বেতার লেখার মধ্যে উদ্ধারকারী একটা প্রবণতা থাকলেও, সেই প্রবণতা মহাশ্বেতার লেখার শোষণের বিরুদ্ধে মূল যে সুর তাকে কখনোই চাপা দেয় না। মহাশ্বেতার লেখাকে হাতিয়ার করে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক যখন ফরাসি নারীবাদের সর্বগ্রাসী প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন আমি গায়ত্রীর দিকে তাকাই।

তাকিয়ে দেখি সারা দুনিয়ার নারীকে এক ও অভিন্ন হিসেবে ভাবার যে ইউরোপীয় প্রবণতা তাকে মহাশ্বেতার ‘স্তনদায়িনী’ গল্পটির যশোদা চরিত্রটির বিশ্লেষণ করে কী অনায়াসে প্রশ্ন করছেন তিনি। ইউরোপীয় নারীবাদে মাতৃত্বকে বরাবরই মাগনার শ্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাতৃত্বকে দেখা হয়েছে ‘নারীর অর্থনীতিতে বিন্দুমাত্র সাহায্য না করা একটি অস্তিত্ব’ হিসেবে। বারংবার বলা হয়েছে মাতৃত্ব এমন একটি পরিসর যেখানে একটি মেয়ের অর্থনৈতিক ভাবে ফায়দাজনক কাজের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসে। গায়ত্রী ইউরোপীয় এই লেন্সকে তাকাতে বলেন মহাশ্বেতা দেবীর যশোদার দিকে। যশোদা যিনি একজন ‘প্রফেশনাল মাদার’। যশোদা বারবার মা হয়। উচ্চশ্রেণির বাচ্চাদের মধ্যে যাদের মায়ের বুকের দুধ জোটে না ,তাদের স্তন্য পান করিয়ে দু’টো পয়সা কামানোর জন্য। ইউরোপীয় নারীবাদের ধারণার সীমাবদ্ধতার বিপ্রতীপে গায়ত্রী যশোদার চরিত্রটিকে তৃতীয় বিশ্বের নারী হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। যশোদা তৃতীয় বিশ্বের সেই নারী যে মাতৃত্বকেও তার তথাকথিত স্বর্গীয় গরিমা থেকে সরিয়ে আক্ষরিক অর্থেই দুই-পয়সার কাজে রূপান্তরিত করে এবং সেই দুই পয়সার হেতুই সে তার স্তনকে ব্যবহার করে চলে । যশোদার স্তন ক্যানসার অব্ধি চাপা পড়ে যায় দুই পয়সার তাড়নায়। যশোদা নিজের পঙ্গু স্বামী ও বাকিদের প্রতিপালন করে চলে ‘প্রফেশনাল মাদার’ হিসেবে। গায়ত্রী এই প্যারাডক্সকেই আলোচনায় এনেছেন বারবার নারীবাদকে একটি নির্দিষ্ট বৃত্ত থেকে বের করে আনতে। অথচ একাডেমিক হিসেবে তাঁর দ্বারা সমালোচিত ফরাসি নারীবাদকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বৃহত্তর দুনিয়ার পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটিও কিন্তু গায়ত্রী নিজেই করেছেন অনুবাদক হিসেবে।

আরও পড়ুন:সংবিধানের দলিত, দলিতের সংবিধান: একটি বোঝাপড়া

গায়ত্রীর এক বৃহত্তর দুনিয়ার নারীবাদ নিজেকেও বাদ রাখে না সমালোচনার পরিসর থেকে। লিঙ্গ বৈষম্যের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনকে জুড়ে দেখার কথা বারবার বলেছেন গায়ত্রী। নিজেকে যশোদার জায়গায় বসাবার অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়েছেন। তারপর ভেবে দেখতে বলেছেন গায়ত্রীর মতো তথাকথিত প্রিভিলেজপ্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের নারীদেরকে কীভাবে ব্যবহার করেছে ইউরোপীয় ও মার্কিন অ্যাকাডেমিয়া।

১৯৫০-এর কলকাতায় গায়ত্রীর মতো উচ্চঘরের পড়াশোনায় ভালো মেয়েদের শেষ পরিণতি যে ইংরেজি অনার্স এবং তারপর ইউরোপ বা আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে কেবলমাত্র ইংরেজি সাহিত্য নিয়েই অধ্যাপনা করা তা যেন আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকত। এই মেয়েরা যখন এই লাইন না মেনে ইউরোপ বা আমেরিকায় গিয়ে নারীবাদকে নিজেদের পেশাদার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে থাকল, তাই নিয়ে তথাকথিত রক্ষণশীল অ্যাকাডেমিকদের যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছিল। এই অস্বস্তি নিয়েই গায়ত্রীর নারীবাদী চর্চার শুরু এবং নারীবাদকে নিজের দেশের প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন ভাবে দেখার চেষ্টা করা।

আরও পড়ুন:গায়ত্রী স্পিভাকদের নিয়ে আমরা কী করি?

গায়ত্রীর এই যাত্রাপথটি যদি আমরা একটু সংবেদনশীল হয়ে দেখি, তাহলে দেখতে পাব, একটি মেয়ে এক বৃহত্তর দুনিয়ার সন্ধানের জন্য নিজের জন্য পূর্ব-নির্ধারিত একাডেমিক পরিকল্পনা বাতিল করতে করতে এগোচ্ছে ক্রমাগত। নিজের চর্চার ক্ষেত্রকেই বারবার সে আলাদা আলাদা প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করে সমালোচনায় বিদ্ধ করছে। আপাত ভাবে আমাদের তাকে খুব দ্রুত মতামত পাল্টাতে থাকা এক নারী মনে হতে পারে। তখনই আমার মনে হয় নারী বলেই তো যা কিছুই শিখেছেন তাকে দ্রুত আনলার্ন করতে বলেছেন গায়ত্রী বারবার। নারী বলেই তিনি জানতেন, আনলার্নিং সেই পথ যা একজন নারীর পক্ষে সবচেয়ে জরুরি শিক্ষা। তাই নিজেই নিজের মতকে বারবার প্রশ্ন করেছেন, ভেঙেছেন এবং নয়া ভাবে গড়েছেন গায়ত্রী। বাংলা-বিহারের সীমান্তবর্তী এক এলাকায় নিজের দাদুর জমিদারিতে একবার দুই ধোপা-বউ-এর কথাবার্তা শুনেছিলেন গায়ত্রী ভারত স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরপরই। সেই দুই মহিলা নিজেদের জমির মালিকানা প্রসঙ্গে বারবার ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র উল্লেখ করছিল। তরুণী বয়সের গায়ত্রী ভেবেছিলেন তথাকথিত শিক্ষা থেকে দূরত্বের জন্যই এই শ্রেণির মহিলাদের এই ভুল ধারণাগুলো থাকে এবং ভুল ধারণাগুলোর জন্যই তারা শোষিত হন। অনেক বছর পর সেই দুই মহিলার সংলাপ নিয়ে আবার ভাবতে বসেন গায়ত্রী এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছন, ওই দুই মহিলা ঠিকই বলছিল। তথাকথিত স্বাধীন ভারতবর্ষেও ওই দুই মহিলার জমির মালিকানা ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র আমলের চেয়ে কিছু বেশি হয়ে যায়নি কারণ পিতৃতান্ত্রিকতার প্রশ্নে দুই কালেই পার্থক্য খুব সামান্যই। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে , নিজের জানাকে নিজেই আনলার্ন করে জানার যে চর্চা তার বীজভূমি তৈরি করতে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের অবদান অনস্বীকার্য ।

More Articles