সংবিধানের দলিত, দলিতের সংবিধান: একটি বোঝাপড়া
Constitutional Rights of Dalits: সংবিধানের রক্ষাকবচ না থাকলে ভারতীয় দলিত বহুজন যে বহু পরিসর থেকে আজও বহু দূরে থাকত তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ইন্দিরা গান্ধি ভারতের গণতান্ত্রিক পরিসরে ‘জরুরি অবস্থা’ নামক যে সংকট এনেছিলেন তার পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে ২০২৫ সালে। ইন্দিরা গান্ধি সংবিধানকে মেনেই ভারতীয় গণতন্ত্রকে যে সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছিলেন তাতে সংবিধানই বিপন্ন হয়েছিল। ২০২৫ সালেই আবার আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠার একশো বছর । রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার একশো বছর উদযাপন করার অলিখিত অ্যাজেন্ডা ছিল ভারতীয় সংবিধানকে পরিবর্তিত করে ভারতীয় সংবিধানের সম্প্রীতির মূল সুরটি নষ্ট করা। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে নিরপেক্ষ ভাবে তাকালে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার নিরিখে কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুটি রাজনৈতিক দলকেই ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আজকের কংগ্রেস বিপাকে পড়ে বহুজন দলিত দলগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসলেও, ২০১৮ সাল থেকেই রাহুল গান্ধির নিজেকে দত্তাত্রেয় গোত্রের পৈতাধারী কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ সমস্যাজনক। মোদীর মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও বি সি মুখই হোক, রাহুলের মতো উদার সহনশীল বহুত্ববাদী কিন্তু ব্রাহ্মণ মুখই হোক, ইন্দিরা গান্ধির মতো মানবিক অথচ ফ্যাসিবাদী মুখই হোক, নেহেরুর মতো উদার অথচ অটোক্র্যাটিক মুখই হোক, কিংবা মহাত্মা গান্ধির মতো রামরাজ্যের ধারণা দিয়ে প্রায় সমস্ত ভারতীয়ের প্রতিনিধি হতে চাওয়া মুখই হোক— তাদের রাজনীতি প্রায় একশো বছর ধরে যে বইটিকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল ভারতীয় সংবিধান।
১৯৩০ সালের গোলটেবিল বৈঠক থেকে ভারতীয় সংবিধান যেভাবে আধুনিক ভারতীয় জাতি নির্মাণে ভূমিকা নিয়েছে তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। বেশিরভাগ দেশে জাতি ও জাতীয়তাবাদ থেকে সংবিধানের জন্ম হয়েছে। ভারতের সংবিধান সেই বিরল গ্রন্থগুলির একটি যা আধুনিক একটি জাতি ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয় দলিত ও বহুজনের অধিকার নিরবচ্ছিন্ন ভাবে রক্ষা করার মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধান ভারত নামের একটি আধুনিক রাষ্ট্র ও ভারতীয় নামের একটি আধুনিক জাতি গড়ে তুলতে পেরেছে।
আম্বেদকর বনাম গান্ধি
১৯৩০ সালে প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির প্রেক্ষিতে যে গোলটেবিল বৈঠক হয়েছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে, সেটিই আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর। আম্বেদকর এবং আর শ্রীনিবাসন এই গোলটেবিল বৈঠকে ভারতীয় দলিত বহুজনের প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের জন্য সেটাই ছিল দলিত বহুজন প্রতিনিধিদের সরাসরি অংশগ্রহণ। এই বৈঠকের আগে থেকেই এই বৈঠককে ঘিরে মহাত্মা গান্ধির ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষমতায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় গান্ধি প্রতিনিধিত্বের রাজনীতিকে দু'ভাগ করার পক্ষপাতী ছিলেন। ভাগ দুটি আজকের ভারতীয় রাজনীতিতেও খুবই চেনা— হিন্দু ও মুসলমান। গান্ধির মনে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের আলাদা পরিসর নিয়ে কখনও কোনও দ্বিধা ছিল না। এই পরিসরের বিপ্রতীপে তিনি অখণ্ড হিন্দু পরিসরকে রাখতে চাইছিলেন। তিনি মানতে চাইছিলেন না যে এই পরিসর যে বহুধা বিভক্ত এবং সেই ভাগগুলির মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থবিরোধী সংঘাতের অঞ্চলগুলি কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।
আজ যে অখণ্ড হিন্দুত্বের কথা বিজেপি ঠারেঠোরে বলে চলে তার দায় মহাত্মা গান্ধির অখণ্ড হিন্দু পরিসর চাওয়ার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে। আম্বেদকর জানতেন, অখণ্ড হিন্দু পরিসরে দলিত বহুজনের সামাজিক সমস্যাগুলিকে সেভাবে গুরুত্বই দেওয়া হবে না। তাই জাত ও জাতি যা ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে বৃহত্তর ভাবে শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন আম্বেদকর। গান্ধি যখন দলিত বহুজনের প্রতি হাজার হাজার বছর ধরে সংগঠিত ভাবে চলে আসা সামাজিক অবিচারকে সাবর্ণ হিন্দুর মানসিকতা পরিবর্তন করে শুধরাবার পক্ষে সওয়াল করছেন, আম্বেদকর সাবর্ণ হিন্দুদের মানসিক সদিচ্ছার উপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। ভারতীয় সংবিধানকে কার্যকরী করার আগেই যে যে রক্ষাকবচের শর্ত আম্বেদকর দলিত বহুজনকে দিয়েছিলেন সেটাই দলিত বহুজনকে আধুনিক ভারতীয় জাতির অংশ হতে সাহায্য করেছে।
দলিত বহুজন পরিসরকে ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’ পরিভাষা দিয়ে চিহ্নিত করার একটি কারণ যদি অবশ্যই হয় ইউরোপীয় শাসককে সহজ ভাবে বোঝানো, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই জাতের সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কটি সাবর্ণ হিন্দুদের ভুলতে না দেওয়া। ভারতীয় বামদলগুলি যদি এই সম্পর্ক অনুধাবন করতে পারত, তাহলে ভারতের বাম রাজনীতির ইতিহাস হয়তো অন্য খাতে বইত। আম্বেদকর বর্ণিত ডিপ্রেসড ক্লাসের এই রক্ষাকবচগুলিই ভারত রাষ্ট্রের খুব জরুরি স্তম্ভ।
সাত জরুরি শর্ত
যে সাতটি শর্তাবলী আম্বেদকর দিয়েছিলেন তার প্রথমটিই হল ভারতে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি বিষয়ে সমানাধিকার। এই জরুরি শর্তের ফলেই দ্বিতীয় শর্তটি লিপিবদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে ভারতীয় সংবিধান অস্পৃশ্যতাকে একটি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। এই শর্তটি না থাকলে আধুনিক ভারতীয় জাতির গঠন প্রক্রিয়ায় শুরু হত না। এই শর্তের মূল কথাটিই ছিল দলিত বহুজনকে যে কোনও ভাবে ভারতবর্ষীয় গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের সামাজিক বয়কট থেকে বাঁচানো। যে সামাজিক বয়কট লিপিবদ্ধ আইনকেও অস্বীকার করার সাহস দেখায়। মহাত্মা গান্ধি এই শর্তের বাস্তবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন যে দলিত বহুজনকে আলাদা পরিসর হিসেবে না দেখে সাবর্ণ হিন্দুর গোঁড়ামি দূর করতে সাবর্ণ হিন্দুর মনের প্রসারতা বৃদ্ধিই আধুনিক ভারতের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আম্বেদকর ভারতীয় সমাজকে খুব ভালো করে চিনতেন বলেই এই ‘স্বাভাবিক’ মনের পরিবর্তনের অপেক্ষা করতে রাজি হননি । ‘স্বাভাবিক’ মনের পরিবর্তনের অপেক্ষা করলে আজও তা সম্ভবপর হত না, যে কোনও সংবাদপত্রের ম্যাট্রিমোনিয়াল ও ম্যাট্রিমোনিয়াল অ্যাপ ও সাইটগুলোয় গেলেই তা টের পাওয়া যায়।
ভারতীয় জাতি গঠন করতে গেলে যে সাবর্ণ হিন্দুর আগ্রাসন থেকে দলিত বহুজনকে বাঁচাতেই হবে তা আম্বদেকর বুঝেছিলেন। তাই ভারতীয় রাষ্ট্রের যে কোনও পরিসরে দলিত বহুজনের অবাধ ও ভয়মুক্ত উপস্থিতি ছিল তাঁর তৃতীয় শর্ত। ভয়মুক্ত এই পরিসর না থাকলে যে ভারতীয় জাতি গঠনে দলিত বহুজনের প্রায় কোনও ভূমিকাই থাকবে না তা আম্বেদকর তাঁর ইতিহাসবোধ এবং ব্যক্তি অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন। চুনি কোটাল, রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা দেখায় ঠিক কতটা ভয় অপেক্ষা করে দলিত বহুজনের জন্য তথাকথিত শিক্ষিত পরিসরেও। সংবিধানের রক্ষাকবচ না থাকলে ভারতীয় দলিত বহুজন যে বহু পরিসর থেকে আজও বহু দূরে থাকত তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পাঁচ নম্বর শর্তটি ছিল সরকারি চাকরিতে দলিত বহুজনের পর্যাপ্ত সুযোগ। সম্ভবত এই শর্তটিই আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি দেয় গোঁড়া সাবর্ণ মননে। মেধা ও জ্ঞানের একটা সুবিধাজনক সংজ্ঞা তৈরি করে ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দু যে ক্ষমতায় নিজের মৌরসিপাট্টা কায়েম করেছে এবং এখনও বজায় রেখেছে, তা যে ভারতীয় জাতির পক্ষে বিপজ্জনক আম্বদেকর সেটা বুঝেছিলেন।
কাঞ্চা ইলাইয়া শেপার্ড তাঁর অতীব গুরুত্বপূর্ণ বই হোয়াই আই অ্যাম নট এ হিন্দু-তে দেখিয়েছেন যে বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগ দক্ষতাকে গুরুত্ব না দিয়ে সাবর্ণ হিন্দু সমাজ ব্রিটিশ শাসনকালে কেরানিবিদ্যা এবং ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চাকে যুক্তিহীন ভাবে গুরুত্ব দেওয়ায় ভারতীয় জ্ঞান ও সরকারি চাকরি পরিসরে সাবর্ণ হিন্দুর ক্ষমতায়ান হয়েছে। দলিত বহুজনের চাষের ক্ষমতা, বয়নের ক্ষমতা, দেশীয় কারিগরি দক্ষতাকে ঔপনিবেশিক মননে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে। শিক্ষা এবং সরকারি চাকরির পরিসরকে গড়েই তোলা হয়েছে সাবর্ণ হিন্দু যেভাবে সুবিধাবোধ করবে সেইভাবে। এর ফলে ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে দলিত বহুজন অনেক পিছিয়ে গেছে। তাকে এগিয়ে আনতে হলে সরকারি চাকরিতে তার প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। আম্বেদকর এই রক্ষাকবচ না দিলে ভারতীয় দলিত বহুজন তথাকথিত হোয়াইট কলার জব পরিসরে আজও প্রায় অনুপস্থিত থাকত। ষষ্ঠ ও সপ্তম শর্ত দুটি জুড়ে ছিল ভারতীয় রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের রাজ্যগুলিতে দলিত বহুজনের অধিকার যদি ক্ষুণ্ণ করা হয়, তাহলে সেই অধিকার রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুঃখের বিষয় এই যে এই দুটি শর্ত ভারতে আজও ঠিকঠাক ভাবে রক্ষা করা হয় না।
ভারতীয় দলিত বহুজন খুব ভালো করেই জানে, ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য সংবিধানই তার একমাত্র হাতিয়ার। সংবিধান বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই পরবর্তী নির্বাচনে ভারতীয় দলিত বহুজন যেন অদৃশ্য এক ছাতার তলায় এসে, এক সুরে সংবিধানকে বিপন্ন করতে পারে যে এমন শক্তিকে দায়িত্ব নিয়ে দুর্বল করে দেয়। ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থা জারি করার পরবর্তী নির্বচনই হোক, রাজীব গান্ধির চারশো পার করার পরবর্তী নির্বাচনই হোক, কিংবা মোদির সুপ্রিম ফ্যাসিস্ট হওয়ার আকাঙ্খার নির্বাচনই হোক— ভারতীয় দলিত বহুজন ভোট দিয়ে এদের ক্ষমতা খর্ব করে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতীয় সংবিধানকে অবিকৃত রাখাই ভারতীয় দলিত বহুজনের কাছে প্রথম প্রায়োরিটি।