খোদ ওয়ারেন হেস্টিংসের পছন্দ ছিল এই পদ, ডায়েট যুগেও কেন ভরসার নাম গরিবের ‘পান্তা’

Village Food Panta Bhaat : চাঁদি ফাটা রোদ্দুরের দিনে পাতে পড়ুক বাংলার সেকেলে পদ, শরীর ঠান্ডা রাখার পাশাপাশি একগুচ্ছ উপকার করে গরিবের পান্তা ভাত...

জল ঢালা বাসি ভাত, একটু সর্ষের তেল, নুন, কাঁচা লঙ্কা আর কাঁচা পেঁয়াজ। গরমের দিনে এটাই চিরকেলে শান্তির প্রতিরূপ। আজকালকার প্রজন্ম অবশ্য পান্তা ভাতের নাম শুনে খানিক ভ্রু কুঁচকে তাকাবে, তাদের চোখে এখন বার্গার, মোমো, পিৎজা কিংবা বিরিয়ানির স্বপ্ন। তবে হলপ করে বলা যায়, এই পান্তার স্বাদ একবার চেখে দেখলে নিমেষেই মজতে বাধ্য সকলেই। এককথায়, গরমে ঠান্ডা হওয়ার আদি খাবার এই পান্তা। রাতের গরম ভাতে জল ঢেলে মাটির হাঁড়িতে সেঁদিয়ে রাখা হয়। বাংলাদেশে যেহেতু জলকে পানি বলা হতো, সেহেতু পানিতে ভেজানো ভাতকে এমন নামে সূচিত করা হয়। ‘পান্তাভাত’। ভাত সংরক্ষণের প্রাচীন পন্থাও বলা যেতে পারে একে।

কথায় বলে, “পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল”! গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে এই ভাতেই লুকিয়ে রয়েছে অকৃত্রিম শান্তি। পান্তাভাতের সঙ্গে সঙ্গত করে কাঁচালঙ্কা বা শুকনো লঙ্কা পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, সরষের তেল ও নুন। আর সঙ্গে যদি থাকে অতিরিক্ত ডালের বড়া, মাছ ভাজা অথবা একটা ডিম ভাজা, তবে তো আর কোনও কথাই নেই। এখানেই শেষ নয়, এই পান্তাভাতের জল থেকে তৈরি করা হয় আমানি। আমানি একধরনের দেশি ঠান্ডা পানীয়। আবার একেই একটু বেশি সময় গেঁজিয়ে একধরনের সুরাও তৈরি করা হয়। আজও গ্রামেগঞ্জে এর প্রচলন দেখা যায়।

সাধারণত খেটে খাওয়া মানুষের খাবার বলে পরিচিত হলেও হিন্দুশাস্ত্রতেও উল্লেখ রয়েছে এই পান্তাভাতের। ভগবানের ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হতো পান্তা। আজও মা দুর্গাকে দশমীতে পান্তা ভোগ দেওয়ার রেওয়াজ বহাল আছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও উল্লেখ রয়েছে পান্তাভাতের। পান্তা ভাতের আরেক নাম কাঞ্জী। বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণকে পান্তা ভোগ দেন জ্যৈষ্ঠ মাসে। এর নাম পাকাল ভোগ। এতে থাকে পান্তাভাত, দই, চিনি, কলমি শাক ভাজা এবং দুই একরকমের নিরামিষ তরকারি।

আরও পড়ুন - পিরামিডের যুগেও ছিল তন্দুরের চল, দেখতে কেমন ছিল প্রাচীন ভারতীয় চুলাগুলি?

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে ১২ ঘণ্টার পর ৭৩.১১ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। এছাড়া ১০০ গ্রাম পান্তাভাতে ৩০৩ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৮৩১ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ৮৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। গরমে শরীরে জলের অভাব দূর করে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। দীর্ঘক্ষণ ভাত ভিজিয়ে রাখার ফলে সহজপাচ্য হয় এর ফলে পেটের রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

এখানেই শেষ নয়, ইতিহাসের পাতাতেও জায়গা করে নিয়েছে গরিবের পান্তা। জলসিক্ত এই মামুলি খাবার হরণ করতে পেরেছিল স্বয়ং ইংরেজ শাসকদের মনও। জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল খোদ ওয়ারেন হেস্টিংসেরও প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকত বাংলার এই সেকেলে ছাপোষা পদটি। বাংলার বড়লাটের মন কীভাবে জয় করতে পেরেছিল এই পদ তার পেছনেও রয়েছে এক সুন্দর কাহিনী। সময়টা ১৭৫৬ সাল, নবাব বনাম হেস্টিংস লড়াই তখন তুঙ্গে। বলা ভালো, ওয়ারেন হেস্টিংস একপ্রকার কোণঠাসা। সেই সময় একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিম্নপদস্থ পদে চাকরি নিয়ে কাশিমবাজারে গা ঢাকা দেন হেস্টিংস। সেখানেই কর্মসূত্রে এক বাঙালি কৃষ্ণকান্ত নন্দীর সঙ্গে পরিচয় হয় হেস্টিংসের। নবাবের চোখ এড়িয়ে তিনিই তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন বন্ধু হেস্টিংসকে। তবে বিনা নোটিশে আগত বন্ধুকে দেওয়ার মতো সেই মুহূর্তে ঘরে কোনও খাবার না থাকায় কৃষ্ণকান্ত হেস্টিংসকে খেতে দিয়েছিলেন পান্তা ভাত আর কুচো চিংড়ি। ব্যাস, তাতেই কেল্লাফতে। মুহূর্তের মধ্যে ওই পান্তা এমন মন জয় করল হেস্টিংস সাহেবের যে তার স্বাদ আজীবন ভুলতে পারেননি তিনি। এমনকী পরবর্তীতে কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল বা বড়লাট নিযুক্ত হয়েও ওয়ারেন হেস্টিংস ওই পান্তা ভাতকে সযত্নে রেখেছিলেন তাঁর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়।

সময়ের ফেরেই হোক, অথবা ইতিহাসের দৌড়ে, গরমের দিনের রোজনামচায় ফের ফিরছে পান্তা ভাত খাওয়ার প্রথা। এমনকী আজকাল শহর কলকাতার বেশ কিছু নামজাদা রেস্তোরাঁতেও মেনুতে থাকে পান্তা ভাতের সাজানো থালি। তার ওপর আবার আজকের ডায়েট মেনে চলা প্রজন্মের কাছে স্বস্তির খোঁজও তো দিতে পারে এই পদ। শুনতে অবাক লাগলেও বিষয়টি সত্যিই। ভাত খেলে ওজন বাড়ে ঠিকই তবে পান্তা হলেই তা থাকে নাকি নিয়ন্ত্রণে! শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু গুণ রয়েছে এই পান্তা ভাতের। সেই কারণে এই বাসি খাবারে বিশেষ না নেই খোদ ডাক্তারদেরও। আসুন এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক, ঠিক কোন কোন পুষ্টিগুণ লুকিয়ে রয়েছে এই পান্তা ভাতের নেপথ্যে...

আরও পড়ুন - এদেশের উত্তরে নয়, আসলে বিদেশেই জন্ম এর! কীভাবে ভারতে জনপ্রিয়তা বাড়ল ছোলে-বাটুরের?

গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এবং হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে পান্তা ভাত। ফার্মেন্টেশনের ফলে পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি এই গরিবী খানায় থাকে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন বি১২। যা শারীরিক ক্লান্তি দূর করতে সহায়তা করে। এই কারণেই গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের পছন্দ এই পান্তা। এছাড়া এতে প্রচুর পরিমাণে থাকে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি। অন্যদিকে, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে পান্তা ভাত। যাঁরা উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্যও চিকিৎসকেরা পান্তা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

এছাড়াও গোটা রাত জুড়ে টানা ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তায় কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে ওয়েট লসে কার্যকরী হয়, তবে খেয়াল রাখতে হবে খাবারের পরিমাণ যেন পরিমিত থাকে। পাশাপাশি এই পান্তা ভাত কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে বলে একে বিউটি সিক্রেট অফ এশিয়া বলা হয়। এটি ত্বকের ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি করে ত্বক মসৃণ, টানটান ও উজ্জ্বল রাখতেও সহায়তা করে। ফলে সব মিলিয়ে পান্তার অনেক গুণ। হিন্দু শাস্ত্র, মঙ্গল কাব্য এমনকী ইতিহাসের পাতা থেকে শুরু করে আজকের যুগের ডায়েট তালিকা, পান্তা ভাতের অনন্ত যাত্রা চিরকালীন হয়ে থেকেছে এই বাংলায়, ভবিষ্যতেও যে থাকবে তা হলফ করে বলা যায়।

More Articles