এদেশের উত্তরে নয়, আসলে বিদেশেই জন্ম এর! কীভাবে ভারতে জনপ্রিয়তা বাড়ল ছোলে-বাটুরের?

Chole Bhatura : উত্তর ভারতীয় খাবার হিসাবে পরিচিতি পেলেও জন্ম আসলে দেশের বাইরে, কীভাবে ভারতে জনপ্রিয়তা পেল ছোলে বাটুরে?

দেখতে অনেকটা বড় বড় লুচির মতো, সঙ্গে পরিচিত কাবলি চানার কষা কষা তরকারি, এরই পোশাকি নাম ছোলে বাটুরে। আজকের দিনে পেটচুক্তি আহারের তালিকায় গোটা দেশেই বেশ জনপ্রিয় এই পদ। আজ থেকে বছর দশেক আগেও বাংলায় সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি এই ছোলে বাটুরে। এমনকী এমন নামটাও তখন ছিল যথেষ্টই অচেনা। কায়দা করে এমন নামে ডাকলে রীতিমতো ভ্রম হতো পরিচিত লুচি আর চানার তরকারির সঙ্গে। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কলকাতা তথা পার্শ্ববর্তী এলাকার জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুডের মধ্যে পড়ে এটি। ব্যস্ত শহরের মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে দোকান। শুধু তাই নয় নামজাদা রেস্তোরাঁর মেনু চার্টেও এখন থাকে এটি।

মূলত উত্তর ভারতীয় পদ হিসেবেই গোটা দেশে জনপ্রিয় হয় এই ছোলে বাটুরে। কিন্তু জানেন কি বাংলা তো নয় এমনকী ভারতের উত্তর প্রান্তেও জন্ম নয় এই পদটির। বাস্তবে উত্তর ভারতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত ছোলে বাটুরে আসলে ভারতীয়ই নয়! কথাটা শুনে হয়তো অবাক হচ্ছেন ঠিকই, তবে এটাই সত্যি। এর পিছনে রয়েছে প্রাচীন এক ইতিহাস। আসুন জেনে নেওয়া যাক কবে কোথায় কীভাবে তৈরি হয়েছিল হালফিলের ছোলে বাটুরে, কীভাবেই বা ভারতে ঢুকে পড়ে ক্রমে এত জনপ্রিয়তা পেল এটি?

আরও পড়ুন - আদৌ ভারতে জন্ম নয় ইডলির! কীভাবে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই পদ?

হরদম কোলাহল, ব্যস্ত অফিস পাড়া, আর টিফিন টাইম এই তিনটের সঙ্গেই মিলে মিশে যায় কিছু জনপ্রিয় খাবারের অনুষঙ্গ। ভরপেট মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে আবার অফিসের কাজে ফেরা, আর এর মাঝেই ভিড় জমে রাস্তার ধারের ঘুমটি দোকানগুলোতে। ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁর সঙ্গে অবশ্য মেলে না এই ছবিটা, এখানে একটা প্যাচপ্যাচে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আছে, জমাটি আড্ডা আছে, প্রচণ্ড ব্যস্ততা আছে, আর তারই মাঝে সবথেকে বেশি করে জমিয়ে যেটা আছে সেটা হল পরিচিত কিছু খাবারের গন্ধ। একটা সময় পর্যন্ত কেবল বাঙালি খাবার অথবা কিছু শুকনো খাবারই ছিল কলকাতার অফিস পাড়াগুলির তালিকায়। পরে অবশ্য সময় এবং চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বদলে সেই রেওয়াজ। আর সেই বদলে যাওয়া সময়ের হাত ধরেই মাছে ভাতে বাঙালির খাদ্য তালিকায় ঢুকে পড়ে আরও অনেক পদ। তার মধ্যেই অন্যতম হল আপাত উত্তর ভারতীয় হিসেবে পরিচিত ছোলে বাটুরে। আজকাল শুধু অফিস পাড়ার টিফিন বলে নয়, ছুটির দিনের জলখবারেও যথেষ্ট জনপ্রিয় খাবার এটি।

দেখতে খানিকটা লুচির মতো হয় প্রণালীর দিক থেকে বেশ কিছু পার্থক্য আছে এই বাটুরের সঙ্গে বাঙালি বাড়ির লুচির। একে তো আকারে বড় হয় বাটুরে, এছাড়াও এক্ষেত্রে ময়দ মাখার সময় পরিমাণ মতো নুন, চিনি এবং ময়ানের সঙ্গে অবশ্যই যেটা দিতে হয় তা হল ইস্ট। এতে করে ভাজার পর খাবারটি বেশ ফাঁপা হয়, এবং খানিকটা পাউরুটির মতো হয় ভিতরের দিক থেকে। তবে ছোলে নামের মধ্যে কোনও বাড়তি রহস্য নেই, একেবারেই কাবুলি ছোলা দিয়ে তৈরি পদ বলেই অমন নাম। আদা, গুঁড়ো মশলা দিয়ে কষিয়ে রাঁধা হয় এই পদ।

বাঙালি তো বটেই এমনকী সমগ্র ভারতীয়রাই কমবেশি খাদ্যরসিক। তাই কোনও খাবার কীভাবে এ দেশে জনপ্রিয়তা পেল তার উত্তর দিতে গেলে এই খাদ্য রসনার তত্ত্বকে অস্বীকার করা চলে না। ওটাই মূল কারণ। ছোলে বাটুরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আপাতভাবে উত্তর ভারতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত এই পদটি আসলে এসেছে মধ্য প্রাচ্য থেকে। ইতিহাস বলছে, ওখানেই জন্ম এই পদের। প্রথমে ছোলার তরকারি পরিবেশন করা হতো একেবারেই পাউরুটি সদৃশ পদ দিয়ে। পরে পরিবর্তিত হয়ে বাটুরের আকার নেয়। আর পুরনো ঐতিহ্য বজায় রাখতেই পাউরুটির মতো বাটুরে তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ইস্ট।

কথিত আছে, মুঘল শাসকরদের হাত ধরে অন্যান্য ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে এই খাবারটিও প্রবেশ করে ভারতে। ছোলে বাটুরের ভারতে প্রবেশ নিয়ে যদিও এমন আরও অনেক ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শোনা যায়, পেশোরি লাল লাম্বা নামে এক ব্যক্তি দিল্লির কনট প্লেসে ‘কোয়ালিটি’ নামে একটি রেস্তোরাঁ তৈরি করেছিলেন। তিনিই নাকি তাঁর রেস্তোরাঁ প্রথম এই ছোলে বাটুরে নামের পদটি বানান। যদিও এই গল্পটিই সর্বোচ্চ বলে মান্যতা পায় না, বরং দিল্লিতেই এই ছোলে বাটুরের জন্ম নিয়ে অন্য একটি গল্প সবচেয়ে বেশি করে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

আরও পড়ুন - মজেছিলেন আকবর থেকে রানি ভিক্টোরিয়া! খিচুড়ির অবাক করা ইতিহাস আজও অজানাই

গল্পটি হল, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সীতা রাম নামে এক পঞ্জাবি ভদ্রলোক পশ্চিম পঞ্জাব থেকে এসে দিল্লির পাহাড়গঞ্জে একটি জায়গায় খাবারের দোকান খোলেন। প্রথমদিকে তিনি এবং তাঁর ছেলেই সেই দোকানটি চালাতেন। মশলাদার ছোলার তরকারির সঙ্গে ছাঁকা তেলে ভাজা বাটুরে বিক্রি করতেন তাঁরাই। মনে করা হয়, এই জদকানের হাত ধরেই মানুষের স্বাদের ঘরে জায়গা করে নেয় ছোলে বাটুরে। তারপর সেই স্বাদের টানেই তা ক্রিমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দেশের অন্যত্রও।

যদিও ছোলে বাটুরের জনপ্রিয়তা ভারতে কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু গল্পকথা রয়েছে। নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারেননি এর জন্মবৃত্তান্ত। তবে উৎপত্তি যাই হোক না কেন, নিঃসন্দেহে বর্তমানে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় খাবারগুলির মধ্যে একটি। শুধু উত্তর ভারত নয় আজ আমাদের বাংলাতেও যথেষ্ট জনপ্রিয় খাবার এটি। সময় এগিয়েছে, বদলেছে খাবার তৈরির প্রক্রিয়াও, কেবল বদলায়নি এই স্বাদের মাহাত্ম্য। পাড়ার দোকান হোক কিংবা নামকরা ধাবা, ছোলে বাটুরের স্বাদযশের গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নেই মোটেও!

More Articles