এখনও কেন লকডাউন চিনে! সাদা কাগজ নিয়ে বিক্ষোভকে ডরাচ্ছে কমিউনিস্ট চিন?
China Infinite lockdown: কোভিড লকডাউনের ফলে অগ্নি নির্বাপক গাড়ি আবাসনে না পৌঁছনোর কারণে হঠাৎ লেগে যাওয়া আগুনে ১০ জন মানুষ মারা যান।
কখনও কখনও একটা স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন হয় বিপ্লবের জন্য। ভেতরের তাপ এবং বাইরের স্ফুলিঙ্গ মিলে এমন কিছু ঘটে যা সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিতে পারে। এই মুহূর্তে চিনে যা ঘটছে, তা তো শুধু স্ফুলিঙ্গ নয়, একটা অগ্নুৎপাত। এখনও একমাস হয়নি রাষ্ট্রপতি শি জিংপিং, তৃতীয়বার চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন, তাঁর বিরোধীদের সরিয়ে। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে তিনি কীভাবে সামলেছেন, তা নিয়ে ভিন্নতর লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেছে, তিনিই চিনের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন এবং নিজেকে এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, মাও সে তুঙের সমতুল্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি ভাবতেও পারেননি, তাঁর বিরোধিতা তাঁর পার্টির অভ্যন্তর থেকে না এসে, বাইরের রাস্তা থেকে আসবে।
অনেকে অনেক কথা বলে থাকেন যে চিন থেকেই কোভিড ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। তারপর সারা বিশ্ব দেখেছে, কীভাবে কঠোর লকডাউন করে এবং প্রতিষেধক দিয়ে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হয়েছে। যদিও সেই পদ্ধতি এবং প্রতিষেধক নিয়ে এখনও নানান মহলে নানান বিতর্ক আছে। অনেকেই ইদানীং বলা শুরু করেছেন, এই পরিমাণ মৃত্যুহারের জন্য, সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়ার কি প্রয়োজনীয়তা ছিল? আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা অবধি হয়েছে, এই প্রতিষেধকের প্রতিক্রিয়াতেও যে বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন তা নিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চিন তাদের ‘শূন্য কোভিড নীতি’ থেকে এতটুকুও সরে আসেনি। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ২৬ নভেম্বর, তাদের দেশেই কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা যেহেতু চল্লিশ হাজার, তাই সরকার এখনও লকডাউন করে মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু এই লকডাউন যে চিনের সরকারের বিরুদ্ধে এত গণক্ষোভ তৈরি করতে পারে, তা সম্ভবত সে দেশের সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান ভাবতে পারেননি।
আরও পড়ুন- অনেক সয়েছি আর না! কেন রাষ্ট্রনেতা বলসোনারোকে ছুড়ে ফেলে দিল ব্রাজিলের জনতা
ঝিংঝিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমছি শহরের একটি বহুতল আবাসনে অগ্নিকাণ্ডে মৃত ১০ জন মানুষকে কেন্দ্র করে এই প্রতিবাদের সূত্রপাত। জানা যাচ্ছে, কোভিড লকডাউনের ফলে অগ্নি নির্বাপক গাড়ি ওই আবাসনে না পৌঁছনোর কারণে হঠাৎ লেগে যাওয়া আগুনে ১০ জন মানুষ মারা যান। তারপরেই চিনের নানান শহরে এই লকডাউনের বিরুদ্ধে মানুষজন রাস্তায় নেমে পড়েন। তাঁদের বেশিরভাগের হাতে একখণ্ড সাদা কাগজ এবং ফুলের স্তবক, যেন তাঁরা চলেছেন মৃত মানুষদের শ্রদ্ধা জানাতে। চিনের খবর সাধারণত বাইরের পৃথিবীতে কম আসে, কিন্তু এই ধরনের আন্দোলনের খবর চেপে রাখাও সম্ভব নয়। এমনিতে আপাতভাবে নিরীহ মনে হলেও এই সাদা একখণ্ড কাগজই হয়ে উঠছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। যদিও প্রতিবাদীদের সংখ্যাটা এখনও হয়তো হাজার ছাড়ায়নি, কিন্তু ইতিমধ্যেই এই প্রতিবাদ সাংহাই, নানজিং ছাড়িয়ে চিনের রাজধানী বেইজিং শহরেও দেখা যাচ্ছে। মূলত কমবয়সী যুবক যুবতীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসছেন লকডাউন ভেঙে। তাঁদের একটাই যুক্তি, সারা বিশ্বে তো কোথাও এইরকম লকডাউন নেই, সারা বিশ্বের বেশিরভাগ চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা যখন বলছেন, এই কোভিডের সঙ্গেই আমাদের ঘর করতে হবে এবং এই রোগটির এমন কিছু মারণক্ষমতা নেই, তাহলে চিনে কেন এখনও এত কড়া লকডাউন চলছে? তাহলে কি সরকারের অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? চিনের সরকার কি আরও স্বৈরতান্ত্রিক হচ্ছে, আরও অনুশাসনে বেঁধে রাখতে চাইছে নাগরিকদের? তাহলে কি কোনও বিরোধিতাই সরকারের বরদাস্ত নয়?
এমনিতেই চিনে প্রতি নাগরিকই সর্বক্ষণ নজরবন্দি, তাঁদের প্রতিটি কার্যকলাপ সরকার নজরে রাখে। ফেসবুক, টুইটার কোনও কিছু করারই স্বাধীনতা নেই। চিন তাদের নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম উই চ্যাট, সাইনা উইবো, ডুবান, টৌটিয়ান তৈরি করেছে। তা নাগরিকরা ব্যবহার করতে পারলেও, সেখানেও কোনওরকম সরকার বিরোধী কথা লেখা যায় না, লিখলেই সরকারের তরফ থেকে বার্তা আসে তা মুছে ফেলার এবং তিনি যে নজরবন্দি আছেন, তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আজ স্বতস্ফূর্তভাবে মানুষজন রাস্তায় নেমে পড়ে সরকারি শৃঙ্খলার বিরোধিতা করছেন।
অনেকেই এই খণ্ড সাদা কাগজের মধ্যে প্রতিবাদের জোরালো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, আমাদের দেশে জরুরি অবস্থা যেদিন ঘোষিত হয়েছিল, তারপরের দিন যেভাবে সম্পাদকীয় বিভাগটি সাদা রাখা হয়েছিল, আজকে চিনের প্রতিবাদ যেন অনেকটা সেইরকম। কিছুদিন আগে হংকংয়ে যে প্রতিবাদ হয়, সেখানেও ছিল সাদা কাগজ। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রতিবাদে রাশিয়ার মস্কোতে যে প্রতিবাদ হয়েছিল, সেখানেও প্রতিবাদীরা এই সাদা কাগজকে অস্ত্র করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে যখন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র বিক্ষোভ হয়, তখন সরকারের তরফ থেকে সেই বিক্ষোভকে কঠোর হাতে দমন করা হয়েছিল। তারপর ১৯৯৯ সালে আরও একটি বিক্ষোভকেও দমন করা হয়েছিল চিন সরকারের পক্ষ থেকে, হাজার হাজার প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তার করে।
আরও পড়ুন- কোভিডের টিকাতেই ছিল মৃত্যুফাঁদ! বিস্ফোরক যে তথ্য আসছে প্রকাশ্যে
২০২০ সালে তাদের সামাজিক মাধ্যমগুলো জুড়ে সরকারের কোভিড সংক্রান্ত উদাসীন মনোভাব নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছিল, কিন্তু তা রাস্তায় নামেনি, কিন্তু এইবারের ‘শূন্য কোভিড নীতি’র জন্য যখন আবারও লকডাউন ঘোষিত হয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বিক্ষোভ শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমে আর সীমাবদ্ধ নেই। একদিকে কাতারে বিশ্বকাপ চলছে, সারা বিশ্ব থেকে মানুষজন কাতার যাচ্ছেন, ওদিকে চিনে কিন্তু এখনও উড়ানযাত্রা স্বাভাবিক হয়নি, তা নিয়েও ক্ষোভ দানা বাঁধছে চিনে।
গত অক্টোবর মাসে যখন চিনে পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, তখন চিনের মানুষজন ভেবেছিলেন যে, এইবার হয়তো কোভিড বিধি শিথিল হবে। কারণ এই লকডাউনের ফলে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। কিন্তু দেখা গেল উল্টোটা। শি জিনপিং, যিনি এই মুহূর্তে চিনের এক এবং অদ্বিতীয় নেতা, তিনি বললেন, তাঁরা কোনওভাবেই নিজেদের নীতি থেকে সরছেন না। আজকের আন্দোলন অত্যন্ত ভ্রূণ অবস্থায় রয়েছে ঠিকই এবং চিনের সরকার কীভাবে এই আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যায়, সেই বিষয়েও সচেষ্ট। তবে গত দু’দিন ধরে একাধারে চিনের পুলিশ প্রশাসন দমন পীড়ন নামিয়ে আনলেও, জিনঝিয়াং প্রদেশে কিছুটা হলেও শিথিল করা হয়েছে কোভিড বিধি। প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, নাগরিকেরা বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন, গণপরিবহনে যাতায়াতও করতে পারবেন। আপাত নিরীহ এই ‘সাদা’ কাগজের প্রতিবাদ যাতে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সর্বময় নেতা শি জিংপিংয়ের বিরুদ্ধে না যায়, সেদিকেও কিন্তু নজর রাখছে প্রশাসন। কিন্তু তাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, “ওঁদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টুটবে।”